ইলিশ ভ্রমণপিয়াসী মৌসুমি মাছ। প্রজনন মৌসুমে এরা সমুদ্র থেকে বড়নদী, ছোটনদী সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। খরস্রোতা মিঠা পানির সন্ধান পেলে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে হাওড়-বিল পেরিয়ে বর্ষাকালে উত্তরের পাহাড়ের কোল পর্যন্ত গিয়ে ডিম ছেড়ে পুনরায় সমুদ্রের দিকে ফিরে আসে। তবে মিঠা পানিতে ডিম ছাড়তে আসার সময় ও সমুদ্রে ফেরার পথে মৎস্য শিকারীদের হাতে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ে।
Advertisement
উন্মুক্ত পানির মাছ বৈদেশিক জলসীমা মানতে জানে না। ইলিশ মাছ এদিক দিয়ে আরো বেশি বেপরোয়া। তারা এক দেশ থেকে আরেক দেশের জলসীমায় অবাধে বিচরণ করতে থাকার সময় দেশে দেশে জেলেদের জালে বন্দী হয়ে যায়। ইলিশ তার অতুলনীয় স্বাদ ও গন্ধের জন্য মানুষের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে। তাই বিভিন্ন দেশে তাদের কদর খুব বেশি এবং মূল্যও অনেক বেশি।
আমাদের দেশে জাতীয় মাছের মর্যাদা লাভ করেছে রুপালী ইলিশ। কিন্তু নির্বিচারে সারা বছর ইলিশ শিকার করায় এই জীববৈচিত্র্য টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। তাই জাতীয় মাছ ইলিশকে রক্ষা ও এর বংশবিস্তার করে টিকিয়ে রাখার তাগিদে এর আহরণে সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বিশেষ নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ইলিশ আহরণের নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রাখতে সরকারের মৎস্য বিভাগ হিমশিম খাচ্ছেন। বিশেষ করে আমাদের দরিদ্র জেলেদেরকে প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময়গলোতে বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় তাদের পরিবারসহ বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা না মানায় মানুষকে সচেতন করার অংশ হিসেবে মোটিভেশন কর্মসূচি চালানো হচ্ছে। এতকিছুর পরেও চুরি করে মৎস্য আহরণ ঠেকানোর জন্য নৌপুলিশ নিয়োগ করা হয়েছে। শাস্তি হিসেবে জাল পুড়িয়ে দেয়া ও জেল-জরিমানার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
Advertisement
কিন্তু বাংলাদেশে ইলিশ আহরণের নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রাখতে যা করা হচ্ছে তাতে তেমন সুফল নেই। ইলিশ বৈদেশিক জলসীমা মানতে জানে না। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর জেলেরা ইলিশ আহরণে আমাদের দেশের সময় নিষেধাজ্ঞা মানবে কেন? তারা গোপনে আমাদের জলসীমায় ঢুকে নির্দ্বিধায় ইলিশ শিকার করে নিয়ে যায়। ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, চীন তাদের দৈত্যাকার বিশাল ফিশিংবোট দিয়ে দিনরাত সমুদ্র থেকে ইলিশসহ নানা মৎস্য আহরণ করে থাকে। আমরা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে মাছের পোনা না ধরে বড় করি আর বিদেশীরা সেগুলো তাদের জলসীমায় ঢুকে গেয়ে ছেঁকে ধরে নিয়ে যায়!
বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারতের ইলিশ আহরণের নিজস্ব সময় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞার সময়সূচি আমাদের দেশের সময়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ইলিশ ধরার জন্য প্রতিবেশী মিয়ানমারের কোনো নিজস্ব সময় নিষেধাজ্ঞা নেই।
এবছর (২০২৪) বাংলাদেশে ২০ মে থেকে ৬৫ দিনের সরকারী সময় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। কিন্তু ভারতের ইলিশ আহরণের নিজস্ব সময় নিষেধাজ্ঞার সাথে বাংলাদেশের সময়ের হেরফের রয়েছে। ভারতের জেলেরা বাংলাদেশের ইলিশ আহরণের সময় নিষেধাজ্ঞা শেষ হবার ৩৭দিন আগেই নদী-সমুদ্রে মাছ ধরতে নেমে গেছেন। এতে তাদের জেলেদের সুবিধা বেড়েছে।
মিয়ানমারের জেলেরা যে কোনো সময় এবং ভারতীয় জেলেরা ৩৭ দিন আগে জলসীমায় ঢুকে ট্রলার ভর্তি করে মাছ ধরে নিয়ে যাবার পর আমাদের জেলেরা যখন নদী-সমুদ্রে নেমেছেন তখন সেখানে মাছশূন্য। আমাদের জেলেরা ট্রলারের তেল পুড়ে, সময় নষ্ট করে রিক্ত হাতে ঘাটে ফিরে আসছেন।
Advertisement
খালি ট্রলার নিয়ে শুণ্য হাতে ঘাটে ফিরে এলে তাদের ঋণের টাকা শোধ হবে কিভাবে? আমাদের জেলেদেরকে ৬৫ দিনের খাবার খরচের ভর্তুকি দেবার উপকারিতা কিভাবে যাচাই করা হবে? দেশী জেলেদের পেটের দায় ও বিদেশী জেলেদের চুরি করে মাছ আহরণ ঠেকানোর প্রবণতা দমন করার উপায় কি?
আমাদের জলসীমা পাহারা দেবার মতো এত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। যদিও কিছ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সেটা অপ্রতুল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের স্থানীয় জেলে ও অধিবাসীদের বিস্তর অভিযোগ শোনা যায়। কারণ তারা নাকি বিদেশী ট্রলাকে অর্থের বিনিময়ে মাছ ধরার সুযোগ করে দেন। বাংলাদেশের ইলিশ আহরণের নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন অনেক সময় আমাদের কিছু অসাধু ট্রলার মাছ ধরে গভীর সমুদ্রে বিদেশে পাচার করে শূন্য হাতে ঘাটে ফিরে আসেন। দেশের বাজারে ইলিশ ক্রয়-বিক্রি নিষেধ থাকায় তারা এধরনের দুর্নীতির আশ্রয় নিতে দ্বিধা করেন না।
দেশের সিংহভাগ মানুষ ইলিশের স্বাদ ভুলেই গেছেন। ধনীরা বিদেশের অভিজাত রেস্টুরেন্টে গিয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করে হলেও চোরাই ইলিশের স্বাদ নিতে চেষ্টা করেন। এসব বিষয় আজকাল চরম বৈপরীত্য সৃষ্টি করে। তাই ইলিশ আহরণে সর্বদেশীয় একক বা অভিন্ন সময় নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করার পাশাপাশি অবৈধভাবে ইলিশ পাচার রোধে অতি কঠোর হওয়া দরকার।
এভাবে সব দিক দিয়ে অন্ধকার আর বিপদ। শুধু ধ্বংস হয় ইলিশ। আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজার ইলিশশূন্য হলেও আমাদের ইলিশ বিদেশের বাজারে সারাবছর দেদারসে ক্রয়-বিক্রয় হয় এবং হচ্ছে। আমরা এবছর যখন ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞায় পড়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে ইলিশ ক্রয়-বিক্রয় এবং খাওয়া থেকে বিরত থাকছি তখন বিদেশের বাজারে বাংলাদেশী ইলিশ অনেক কমমূল্যে বিকিকিনি করতে দেখা যাচ্ছে।
কোলকাতার গড়িয়াহাট, মানিকতলা, যদুবাবুর বাজার কিংবা ইয়াঙ্গুনের সুয়াতি বড় বাজার ছাড়াও লন্ডনের ব্রিকলেনের বাংলাবাজার, নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস্-এর বাঙালি পাড়ার মাছের দোকানে, টোকিওর নিহোমবাসী, তোয়সু-র বাঙালি দোকান ছাড়াও ‘তাক্কিওবিনে’ অর্ডারের মাধ্যমে সবসময় বাংলাদেশী ইলিশমাছ কেনা যায়।
এসব ইলিশমাছের বেশীরভাগ অংশ যোগসাজশের মাধ্যমে গোপনে সমুদ্রথেকে ধরার পর অবৈধপথে বিদেশের বাজারে চালান হয়ে যায়। তারা সরকারকে ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে ইলিশ চোরাচালান করে। বিদেশেী বাজারে ডিমওয়ালা বাংলাদেশী ইলিশ মাছের চাহিদা অনেক বেশি। এসকল ডিমওয়ালা ইলিশ আমাদের দেশে ইলিশ আহরণের নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন গোপনে ধরা হয়ে থাকে। এধরনের চুরি সাধারণ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ঠেকানো কঠিন। নদীর মোহনা ও গভীর সাগর-সবজায়গায় পাহারা বসানোর মতো সক্ষমতা ও নৈতিকতা কি আমাদের আছে?
বাংলাদেশী ডিমওয়ালা ইলিশ যদি বিদেশের বাজারে সারাবছর বিক্রি করা চলে, খাওয়া চলে তাহলে আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে ৬৫ দিনের এত কৃচ্ছ্রতা সাধনের দরকার কি? আরেকটি বিষয় হলো- গ্রামের সাধারণ মানুষ নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে জানার আগেই বিত্তশালীরা অভ্যন্তরীণ বাজারের ছোট ইলিশটিও বেশিদামে কিনে নিয়ে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখে নিজেদের রসনা বিলাসের জন্য। এতে দেশের কতিপয় বড় শহর ছাড়া সারা দেশের জনগণ মৌসুমের সময়ও বাজারে ইলিশ মাছের আগমন দেখতে ভুলে গেছে।
এছাড়া ইলিশ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে পুকুরে ইলিশ চাষ করার মতো চমকপ্রদ কথা শোনা গেলেও সেটার ফলাফল সুদূর পরাহত বলে মনে হচ্ছে। প্রকৃতির নিয়মে বৃষ্টিপাতের সময় পরিবর্তিত হয়েছে। জলবায়ু আগের মতো আচরণ করছে না। নদীতে সময়মতো স্রোত আসে না। ইলিশের ডিম ছাড়ার মৌসুম পরিবর্তিত হয়েছে। এবছর বন্যা, খরা, অনাবৃষ্টি, সমুদ্রঝড়, দীর্ঘ তাপপ্রবাহ ইত্যাদির ফলে ইলিশের গবেষণাক্ষেত্রে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।
আমাদের দেশে ইলিশ আহরণের নিষেধাজ্ঞার সময় বিদেশী ট্রলারের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ইলিশ ধরে নিয়ে যাবার কথা সংবাদমাধ্যমে বেশ ঘটা করে প্রচারিত হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো বিকার লক্ষ্য করা যায়নি। তাইতো এবছর নীতি মেনেও মৌসুমের সময় বাজারে পর্যাপ্ত ইলিশ মেলেনি। অন্যদিকে প্রকৃতিক মৎস্য আহরণে দীর্ঘ নিষেধাজ্ঞায় ঋণগ্রস্ত জেলে পরিবারের মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়ানোর সুযোগ হারিয়ে গেছে। কারণ তাদের জন্য বরাদ্দ নিতান্তই অপ্রতুল বলে প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে।
এসময় তাদের কোন কাজ না থাকায় তারা ঘরে বসে অলস সময় কাটায়। তাদের জন্য মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা সময়সীমা কমিয়ে আনার দাবি উঠেছে। পাশাপাশি কমপক্ষে ভারতের সময়সূচির সাথে মিল রেখে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা সময়সীমা একই সময়মত করার কথা উঠেছে। এজন্য আমাদের ইলিশ বিষয়ক মৎস্য নীতিতে আশু পরিবর্তন আনা দরকার।
ইলিশের প্রজনন ও আহরণে মৌসুমের পরিবর্তনের দিকে খেয়াল রেখে একই সময়ে সর্বদেশীয় বা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা জারি ও সময়মতো তুলে নেবার বিষয়টি খুবই জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে সমুদ্র থেকে গোপনে ইলিশ আহরণ, বৈদেশিক জেলেদের চুরি ঠেকানো, সমুদ্র থেকে চোরাই পথে বিদেশে ইলিশ পাচার ইত্যাদি বিষয়কে অবহেলার চোখে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া দেশের সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করে বিদেশে ইলিশ রপ্তানী করাও খুবই অমানবিক কাজ বলে মনে হয়।
কারণ দেশের সিংহভাগ মানুষ ইলিশের স্বাদ ভুলেই গেছেন। ধনীরা বিদেশের অভিজাত রেস্টুরেন্টে গিয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করে হলেও চোরাই ইলিশের স্বাদ নিতে চেষ্টা করেন। এসব বিষয় আজকাল চরম বৈপরীত্য সৃষ্টি করে। তাই ইলিশ আহরণে সর্বদেশীয় একক বা অভিন্ন সময় নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করার পাশাপাশি অবৈধভাবে ইলিশ পাচার রোধে অতি কঠোর হওয়া দরকার।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। fakrul@ru.ac.bd
এইচআর/জিকেএস