প্রবাস

শৈশবের রকমফের

ছোটদের জন্য মাত্র ছাপান্ন পৃষ্ঠার একটা অসাধারণ বই। শিশু-কিশোরদের জন্য অবশ্যপাঠ্য একটা বই। বইয়ের গল্পটা তৈরি হয়েছে তিনজন শিশু পুতুল, অন্তু আর মরিয়মকে ঘিরে। পুতুল ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তার হৃদযন্ত্রের ভাল্বে কি একটা সমস্যা আছে। তাই তাকে স্কুলে যেতে দেওয়া হয় না। পুতুলের বয়স এগারো। সে বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি। শিক্ষকেরা তাকে বাসায় এসে পড়িয়ে যান। তার কষ্ট কমানোর জন্য তাকে কোলে করে দোতলায় উঠানো হয়। সে এই রুটিন বাঁধা জীবনে খুবই বিরক্ত। এগুলো তার মোটেও ভালো লাগে না।

Advertisement

ছোটমামা তার জীবনের মজার মানুষ। তিনি সারাক্ষণই গল্পগুজব করেন। পুতুলের অবশ্য বাবা মাকেও ভালো লাগে। কিন্তু যখন তাদের মধ্যে ঝগড়া হয় তখন আর তাদের ভালো লাগে না। তার শুধু মনে হয় ঝগড়া করবে ছোটরা। আড়ি দেবে–ভাব নেবে। বড়োরা এ রকম করবে কেন? মা’কে খুব সুন্দর লাগে পুতুলের। তার মা হচ্ছেন পরীর মতো সুন্দর। পুতুলের অবসর কাটে গল্পের বই পড়ে, টিভি দেখে, লেগো খেলে আর তাদের বাসার সামনের বাগানে। তিনটা বিশাল বড়ো বড়ো গাছ আছে, একটা রেনট্রি আর অন্য দুইটা কদম ফুলের গাছ। কদম ফুলের গাছ দুটি পাশাপাশি–যেন দুই জমজ বোন, একজন অন্যজনের গায়ে হেলান দিয়ে আছে। বর্ষাকালে গাছ দুটিতে কী অদ্ভুত ফুল ফোটে। সোনার বলের মতো ফুল।

পুতুলের মা জেসমিন কদম ফুলের গাছ দুটি একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। কারণ হচ্ছে শুয়োপোকা। কদম গাছে খুব শুয়োপোকা হয়। আর শুয়োপোকা দেখলেই মার বমি পেয়ে যায়। তিনি প্রতি শীতকালে একবার করে বলেন, গাছগুলো কাটিয়ে ফেলা দরকার। শেষ পর্যন্ত কেন জানি কাটা হয় না। দেখতে দেখতে বর্ষা এসে যায়। অদ্ভুত কদম ফুলগুলো ফোটে। কী যে ভাল লাগে পুতুলের! কিন্তু এক বছর কেটে ফেলার পরিকল্পনা মোটামুটি পাকা হয়ে গেছে তাই তার খুব মন খারাপ। গাছগুলোর দিকে তাকালেই তার কান্না পেয়ে যায়।

এরপর একদিন খুব ভোরে পুতুল বাসা থেকে পালিয়ে যায়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পুতুলের সঙ্গে দেখা হয় তারই সমবয়সী এক শিশু অন্তুর সাথে। ছেলেটি রোগা ট্যাঙটেঙা। পরনে একটা নীল প্যান্ট। এছাড়া গায়ে দ্বিতীয় কোনো বস্তু নেই। গোলগাল মুখ। সে তেমন কোনো কাজ করে না। অন্তুরা দুই ভাইবোন। অন্তুর বোন মরিয়ম বয়সে তার দু’বছরের ছোট। তাকে তার বয়সের চেয়েও ছোট দেখায়! তাকে দেখে মনে হয়, এই মেয়েটা যেন সবে মাত্র হাঁটতে শিখেছে, এক্ষণি আছাড় খেয়ে পড়বে।

Advertisement

তার গায়ে একটা হলুদ রঙের ফ্রক। ফ্রকের ওপর মোটা একটা খাকী রঙের স্যুয়েটার। রেলপুলিশের এক হাবিলদার এটা দিয়েছে। সে কমলাপুর স্টেশনে অ্যালুমিনিয়ামের একটা জগভর্তি করে পানি বিক্রি করে। অন্তুর মা মারা গেছে আর বাবা ময়মনসিংহ স্টেশনে ভিক্ষা করে।

অন্তুর সাথে পরিচয়ের পর পুতুলের জীবন বদলে যেতে শুরু করে। পুতুল জীবনকে নতুনভাবে দেখার সুযোগ পায়। তার খুবই অবাক লাগে যে একই শহরে তারই বয়সী একটা ছেলে অন্যরকম একটা জীবন যাপন করছে। শুরুতেই পুতুলকে অন্তু ভালোভাবে নেয়নি। সে জানে বড়লোকদের ছেলেপুলে বদের হাড্ডি হয়। এরা নিজেরা মারামারি করতে পারে না কিন্তু অন্যকে দিয়ে মার খাওয়ায়। অন্তুর একটা কুকুরের বাচ্চা আছে যেটাকে পুতুল নাম দেয় ‘ইয়েলো টাইগার’। সেটাকে দেখে পুতুলের মনে পড়ে যায় তাদের পোষা বিড়াল ‘লিলিয়ান’র কথা।

অন্তুর সাথে মিশে পুতুল একদিনে অনেক কিছুই শিখে ফেলে। কীভাবে রিকশার পাম ছেড়ে দিতে হয়। কীভাবে মিছেমিছি খাওয়া দাওয়া করতে হয়। অন্তুর ভাষায় খাওয়া খাদ্য হইল ভাগ্যের ব্যাপার। ভাইগ্যে থাকলে হয়, না থাকলে হয় না। সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে চাড়া খেলা যায়। আবার সব সিগারেটের মূল্যমান একই না। ফাইভ ফাইভের প্যাকেট হইল পাঁচ শ’ টেকা, স্টার হইল দশ টেকা, আর বেনসন হইল হাজার টেকা। আবার এই টেকা রাখনের জায়গা না থাকলে সেটা ছিঁড়ে বাতাসে উড়িয়ে দেয়া যায়। অন্তুর মতে জন্তু-জানোয়ার যখন ছোট থাকে তখন মানুষের কথা বুঝে। বড় হইলে বুঝে না।

ক্ষিধে মেটানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হলো বাদাম কারণ এটা অনেকক্ষণ পেটে থাকে। দু’টাকার বাদাম কিনে ভরপেটে পানি খেলে সারাদিন থাকা যায়। পাউরুটিগুলো এমন জিনিস যে, খাওয়ার পরপরই ক্ষিধে লাগে। অন্তুরা এও জানে বিক্রিবাটা হইল ভাগ্যের ব্যাপার। অন্তুরা জানে শীতের সময় ওম হইল গিয়া গরম। গরিব মাইনষের শীত লাগে না এইটা হইল গিয়া নিয়ম জেনে পুতুল অবাক হয়। তখন পুতুলের মনে প্রশ্ন জাগে আল্লা দু’রকম নিয়ম বানিয়েছেন কেন–ধনী মানুষের জন্যে এক রকম নিয়ম, আবার গরিব মানুষের জন্যে অন্য রকম নিয়ম?

Advertisement

শত অভাবের মধ্যেও অন্তুরা স্বপ্ন দেখে। তারা সবাই মিলে টাকা জমাচ্ছে, যখন পাঁচ শ’ টাকা হবে, তখন জমান শেষ হবে। সবাই মিলে তারা দেশের বাড়িতে চলে যাবে। তাদের বাবা এ টাকায় একটা ছোট্ট দোকান দেবে। ঐ দোকানের টাকায় তাদের সংসার চলবে। দুই ভাই-বোন ভর্তি হবে স্কুলে। তারপর তারা ছোট্ট এক টুকরা জমি কিনবে। সেই জমিতে তাদের বাড়ি হবে। একটা নৌকাও কিনবে। নৌকা নিয়ে বিলে মাছ মারতে যাবে। এছাড়াও একটা গাই গরু কিনবে।

আমাদের সময় মাধ্যমিকের কোনো একটা শ্রেণিতে ইংরেজি দ্রুত পঠনে একটা গল্প ছিল ‘দ্য প্রিন্স অ্যান্ড ডি পপার’ নামে। সেখানে একজন রাজকুমারের সাথে একজন রাস্তার ভিক্ষুক ছেলের গল্প বলা হয়েছিল। পুতুল উপন্যাসটা পড়ে সেই গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। একটাই জীবন কিন্তু অবস্থান ভেদে তার কত রূপ। আধুনিক যুগে আমরা শুধুমাত্র নিজেদের অপুর্ণতাগুলোকে প্রধান করে দেখি কিন্তু আমাদেরই আশেপাশে কতশত মানুষ শত অপূর্ণতা সত্ত্বেও সুখে জীবন যাপন করে চলেছে। তাদের দেখলে নিজের জীবনের কমতিগুলোকে আর বড় করে ধরা পড়ে না। এভাবেই আমরা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারি। আর সেই শিক্ষাটাও আমাদেরকে খুব ছোটবেলা থেকেই দেওয়া জরুরি। ছোট কলেবরের এই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। লেখক বইটি উৎসর্গ করেছেন এইভাবে- নীলু, কল্যাণীয়াসু ‘কত না দিন রাতি, তুমি ছিলে আমার খেলার সাথী’। কথায় আছে আমরা একবারই বাঁচি আর সেটা হলো শৈশবে। এরপর বাকি জীবনে চলে শৈশবের স্মৃতিচারণ করে। তাই হয়তোবা লেখক তার শৈশবের খেলার সাথীকে বইটা উৎসর্গ করেছেন। পরিশেষে একটা কথায় বলতে চায়।

এখনকার সময়ে আমরা সবাই শুধুই ছুটছি আর ছুটছি। আমাদের দুদন্ড অবসর নেই। আমাদের বাচ্চাদেরও আমরা সবকিছুতেই প্রথম হতে হবে সেই লক্ষে বড় করছি। সেটা করতে যেয়ে আমরা তাদের শৈশব কৈশোরটাকে একেবারে আনন্দহীন করে তুলছি। এখনও সময় আছে ওদের শৈশবটাকে দুরন্ত সব স্মৃতি দিয়ে রাঙিয়ে দেওয়ার।

এমআরএম/জিকেএস