মতামত

দুর্নীতি প্রতিরোধে নারী রাখতে পারে অনন্য ভূমিকা

"নারী " কবিতায় জাতীয় কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন-"বিশ্বে যা কিছু মহানসৃষ্টি চির কল্যাণকর,অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।"পরের লাইনেই তিনি লিখেছেন-"বিশ্বে যা কিছু এল পাপ- তাপ বেদনা অশ্রু বারি।অর্ধেক তার আনিয়াছে নর অর্ধেক তার নারী।"

Advertisement

নারী বিশ্ব সাজাতে যেমন পারে, আবার নরক কুন্ড বানাতেও পারে। তিনরূপে নারী পৃথিবীতে জ্বাজ্জল্যমান। নারী কন্যা, নারী জায়া, নারী জননী। নারীর শাশ্বত চিরন্তন রূপ, যা অবিচ্ছেদ্য ও অতুলনীয়।

বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান নারী পুরুষের সমান অধিকার সম মর্যাদা দিয়েছে। নারী অধিকার, নারী নেতৃত্ব, পারিবারিক, সামাজিকও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নারীর সময়ের দাবি।

নারীর ক্ষমতায়নে মাইল ফলক সৃষ্টি করেছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ক্ষমতা আমাদের প্রয়োগ করতে হবে, কাজে লাগাতে হবে ভাল কাজে। নীতি থেকেই দুর্নীতি। সে নীতিতে নারী সমাজকে দুর্নীতি মুক্ত হতে হবো , এ নীতি আত্মস্থ করতে হবে তাহলেই আমরা পেতে পারি দুর্নীতি মুক্ত পরিবার, দুর্নীতি মুক্ত সমাজ ও দুর্নীতি মুক্ত দেশ।

Advertisement

একজন দুর্নীতিবাজের জন্ম ও মায়ের পেটে পিতার ঔরসে হয়। সে জন্মগত ভাবেই দুর্নীতিবাজ হয়ে জন্মায়না। তার পারিপার্শ্বিকতা, সামাজিক আচরণ, অতিলোভ, উচ্চাকাঙ্খা, অসুস্থ প্রতিযোগিতা তাকে দুর্নীতিবাজ করে তুলে।

দুর্নীতির মূল কোথা থেকে বা এর গোড়াপত্তন কোথা থেকে হয়েছে তা নির্ভুল গবেষণার বিষয়। কখন, কোথা থেকে তার জন্ম কেউ জানেনা, তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আজ দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, আমাদের দেশ প্রতিযোগিতায় পিছাবে কেন?

বিদ্যার্জনের জন্য, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আমাদের হাদিসে যেমন সদূর চীন থেকে জ্ঞানার্জনের কথা আছে আবার বর্জনের কথাও আছে। আমাদের দেশের মেধাবী, অ -মেধাবী সবাই দেশ বিদেশ থেকে বেশির ভাগই অর্জনকরে এসেছেন কিভাবে উন্নয়নের মহাসোপানে গতিমান দেশটিকে শেষ করা যায় দূর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে।

এই দুর্নীতিবাজরা শুধু তাদের পরিবারকেই কলুষিত করছে না, ক্ষতি করছে দেশ জাতি তথা সাধারণের। তাদের সন্তানেরাও জন্মগত, মজ্জাগত ভাবেই দুর্নীতিবাজ হিসেবে গড়ে উঠে এবং দ্বিগুণ উৎসাহে ঐ পাপাচারেই লিপ্ত হয়।

Advertisement

আচ্ছা হলফ করে বলুন তো, আমি আপনি, আমার আপনার দাদার বাবা আমাদের প্রপিতামহের নাম জানি কিনা? আপনার পূর্বপুরুষের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জনকরা সম্পদ ভাগ ও ভোগ করছেন, বিক্রি করে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন অথচ তার জন্ম মৃত্যু দিনে তার স্মরণ করা দূরের কথা তার নামটি পর্যন্ত আপনি বা আপনার উত্তরসূরি অবহিত হচ্ছে না তাহলে কেন অবৈধভাবে আপনি সম্পদের পাহাড় গড়বেন? কার জন্য, কীসের জন্য?

দেশের এ দুঃসহ সময়ে দুর্নীতি নামক মহামারি থেকে মুক্তি পেতে নারী সমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। নারীরা সত্যিকার অর্থে নিজে কর্মক্ষেত্রে,পরিবারে, সামাজিক কার্যক্রমে, রাষ্ট্রীয় পদপদবীর অপব্যবহার না করে, নির্লোভী হয়ে সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে অতি সহজেই দাঁড়াতে পারে। দামী গাড়ি, দামী বাড়ি, বিদেশবাড়ি বানানো, দেশ বিদেশী ব্যাংক ব্যালেন্সে কোনো গৌরব ও সন্মান নেই।

সন্মান, যশ, খ্যাতি এমন জিনিস একবার চলেগেলে আর ফেরত আসেনা। গৌরব ও সন্মান আছে সামাজিক মর্যাদা রক্ষার্থে যতটুকু প্রয়োজন তাতেই মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকার মাঝে।

অর্থনৈতিক সচ্ছলতা সীমাহীন, আপনি অসীম ক্ষমতাধর, আপনি ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন, মানুষকে হুমকি ধামকি দিচ্ছেন, আপনাকে সামনাসামনি হয়তো কষ্টে সালাম টুকু দিতে বাধ্য হয়, পিছনে সে অসৎ, অনৈতিক চরিত্রের ভেবে মনের অগোচরেই আপনাকে ঘৃণা করছে, আপনার বিষোদগার করছে।

প্রতিটি পরিবারে নারী নিজে,মা,বোন স্ত্রী,কন্যা, ভাগ্নী সবাই সচেতন হোন। নারীরাই শুধুই মাত্র সম্মিলিত ভাবে দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রতিজ্ঞাবদ্ব হয়ে এ বিষফোড়ার মূল উৎপাটন করতে পারে।

জানা প্রয়োজন চুরি, জালিয়াতি, ঘুষ বাণিজ্য করে পুরুষ নারী কেউ রক্ষা পায়না। আজ অবধি দুর্নীতি দমন কার্যালয়ে ১১৮ জন নারীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, বিগত দশ বছরে ২৯ জন দুর্নীতিবাজ নারীর শাস্তি হয়েছে ২৫ জনের দুবছর তিনবছর মেয়াদে, বাকিদের স্বল্প মেয়াদে।

আমি মনে করি দুর্নীতিবাজদের শাস্তি আরো বাড়ানো উচিৎ। দুবছর আর তিনবছর মেয়াদের শাস্তি কোনো বিষয় ই না। যেখানে অনেক আমলযোগ্য মামলায় শাস্তি যাবৎজীবন সেখানে রাঘব বোয়ালদের দুর্নীতির মামলায় শাস্তি এতো কম হলে কেউ ভয় পাবেনা।

দুর্নীতি দমন কমিশনের নাম শুনলেই নড়েচড়ে বসতে হবে। সাথে প্রয়োজন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন, সৎ, মেধাবী আইনজীবীদের টিম। মাসে একবার হলেও সবাই দুর্নীতি দমন কার্যালয়ে বসবে সমস্ত মামলার অগ্রগতি জানবে এবং জানাবে।

নারী নিজে ঘুষ গ্রহণ করবে না, দুর্নীতির সাথে জড়াবেনা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নারীর ক্ষমতায়ন করেছেন দুর্নীতিবাজ হওয়ার জন্য নয়, নারী নেত্রী বানিয়েছেন পদ বাণিজ্যের জন্য, টেন্ডারবাজি, বদলীবাণিজ্যের জন্য নয়।স্বামীর অস্বাভাবিক টাকা ঘরে এলে লুকিয়ে আলমিরা, তোষকের নিচে না রেখে টাকার উৎস সম্পর্কে জানুন, তাকে অসহযোগিতা করুন, নিবৃত্ত করুন।

আপনার নামে একাউন্ট খুলতে চাইলে অবশ্যই কেন খোলা হচ্ছে যাচাই করুন, চেকে দস্তখত করার আগে পরে পরখ করে নিন। আপনার নামে কেন এতো ফ্লাট হচ্ছে, দালান হচ্ছে, রিসোর্ট হচ্ছে টাকার উৎস কোথায় জানুন আপনি এর দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।

চুরি, ঘুষ, দালালী, অবৈধভাবে উপার্জিত টাকার সুবিধা ভোগী আপনি, শাস্তি তো ভোগ করতেই হবে। আপনার কতশত ভড়ি স্বর্ণালংকার প্রয়োজন? কবরে কিন্তু সাদা কাপড় টি ছাড়া কিছুই যাবেনা। আপনার অর্থ সম্পদই আপনার সন্তানদের কাল হয়ে দাঁড়াবে। আপনার মৃত্যুর পর সম্পদের ভাগাভাগি থেকে মারামারি খুনোখুনি হতে পারে।জননী, আপনার এক টাকা আয়ের যোগ্যতা নেই, আপনার নামে ১৭৫ কোটি টাকা সন্তান কেন রেখেছেন ভেবেছেন?

স্ত্রী, সন্তানদের আয়ের উৎস নেই, কোন কাজ করেন না শতকোটি টাকার ব্যাংক ব্যালেন্স, কত রঙ্গের ঢংয়ের গাড়ি, হোটেল, মোটেল বিনোদন কেন্দ্র আপনার নামে কেন ভেবেছেন কখনো । সজাগ ও সচেতন হোন। পাপ বাপকেও ছাড়ে না।

আসুন আমরা নারীরা সুনীতিতে থেকে দুর্নীতিকে না বলি, প্রতিরোধ করি, প্রতিবাদ করি। জয় হোক কন্যা, জায়া, জননীর।

লেখক: সাবেক সহসভাপতি, সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন।

এইচআর/এমএস