আন্তর্জাতিক

সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা কেমন ভারতে?

ভারতের ইতিহাসে সংরক্ষণ ব্যবস্থা বা কোটার উপস্থিতি দীর্ঘদিনের। সেই ব্রিটিশ আমল, অর্থাৎ ভারতের স্বাধীনতার আগে থেকেই সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। মূলত ব্রাহ্মণদের আধিপত্যের কারণে সে সময় অব্রাহ্মণ এবং অনগ্রসর শ্রেণির অনেক মানুষ বৈষম্যের শিকার ছিলেন।

Advertisement

সংরক্ষণের উদ্দেশ্য ছিল অব্রাহ্মণ এবং অন্যান্য যেসব শ্রেণি বর্ণ বৈষম্য এবং জাতিভেদের শিকার, তাদের অগ্রসর হওয়ার পথ সুগম করা।

আরও পড়ুন>>

কোটিপতির মেয়ে হয়েও গরিব কোটায় সরকারি চাকরি! দেশে দেশে কোটা পদ্ধতি কোটা সংস্কার আন্দোলনে আর প্রশ্রয় দেবে না সরকার

ভারতের স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিমার্জনার মধ্যে দিয়ে বর্তমানের সংরক্ষণ ব্যবস্থা এসে দাঁড়িয়েছে। তবে এই দীর্ঘ ইতিহাসে রাজনৈতিক ছোঁয়া বা বিতর্ক দুটিরই আঁচ লেগেছে কোটা ব্যবস্থার ওপর।

Advertisement

বর্ষীয়ান শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার বলেন, ভারতে সামাজিকভাবে দীর্ঘদিন ধরে যারা বঞ্চনার শিকার হয়েছেন; যেমন- দলিত, অনগ্রসর জাতি, তফসিলি জাতি ও উপজাতি এবং নারীরা, মূলত পিছিয়ে পড়া মানুষদের অগ্রগতির কথা ভেবে এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

কিন্তু কখনো কখনো রাজনীতিতে নির্দিষ্ট একটি শ্রেণির মানুষকে ‘তোষণ’বা ‘বিরোধিতা’ করতে বারবার ব্যবহার করা হয়েছে কোটাকে।

ভারতীয় সংবিধান কী বলছে?

ভারতের সংবিধান অনুচ্ছেদ ১৫ (৪) বলছে- ‘কোনো কিছুই সামাজিকভাবে এবং শিক্ষাগতভাবে পিছিয়ে পড়া তফসিলি জাতি এবং উপজাতি শ্রেণির নাগরিকদের অগ্রগতির জন্য কোনও বিশেষ বিধান করতে রাষ্ট্রকে বাধা দেবে না।’

সংবিধানের ৪৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বিশেষ যত্ন সহকারে অনগ্রসর অংশের শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রচার করবে এবং বিশেষত, তফশিলি জাতি ও উপজাতির নাগরিকদের সামাজিক অবিচার এবং সব ধরনের শোষণ থেকে রক্ষা করবে।’

Advertisement

তফশিলি জাতি এবং উপজাতি মানুষেরা আর্থসামাজিক দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া বর্গ। শিক্ষা, অর্থ এবং সামাজিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষদের সমষ্টিগতভাবে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মধ্যে ধরা হয়।

সংবিধানের ১৫(৪) ও ১৬(৪) ধারায় প্রাথমিকভাবে বলা হয়েছিল যে, সংরক্ষণের সীমা কখনোই ৫০ শতাংশ ছাড়াবে না। তবে তা সংশোধিত হয়েছে। সেই সংশোধন অনুযায়ী, রাজ্য সরকারগুলো অনগ্রসর শ্রেণির সামাজিক অগ্রগতির কথা ভেবে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে পারে।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ও রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বলা হয়েছে, কোনো রাজ্য চাইলে ৫০ শতাংশের বেশি সংরক্ষণ দিতে পারে। তবে তা হতে হবে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যার ভিত্তিতে। কিন্তু কেন্দ্রীয় স্তরে সে সুযোগ এখন পর্যন্ত নেই।

তামিলনাডুতে ৬৯ শতাংশ, তেলেঙ্গানায় ৬২ শতাংশ এবং মহারাষ্ট্রে চাকরির ক্ষেত্রে অনগ্রসর শ্রেণির প্রার্থীদের জন্য ৫২ শতাংশ কোটা রয়েছে। অন্যান্য অনেক রাজ্য সরকারই ৫০ শতাংশের বেশি কোটা রেখেছে।

এর মধ্যে তামিলনাড়ুতে পিছিয়ে থাকা শ্রেণির মধ্যে ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস এবং সর্বাধিক পিছিয়ে থাকা শ্রেণি বা মোস্ট ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসের জন্য ৫০ শতাংশ কোটা রয়েছে। আর তফসিলি জাতি ও উপজাতি মিলিয়ে কোটা রয়েছে ১৯ শতাংশ।

তামিলনাড়ুর সবশেষ (২০১৮-১৯ সালের) হাউসহোল্ড প্যানেল সমীক্ষা অনুযায়ী, রাজ্যটির মোট জনসংখ্যার ৪৫ দশমিক ৫ শতাংশ পিছিয়ে পড়া শ্রেণি এবং ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ সর্বাধিক অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ।

এর মধ্যে, কয়েকটি রাজ্যে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির আওতায় মুসলিমদের বিশেষ সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিজেপির দাবি, ভোটব্যাংকের দিকে তাকিয়ে এই ‘তোষণের রাজনীতি’ চলছে। এ নিয়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তোপ দাগতেও ছাড়েনি তারা। প্রসঙ্গত, ওই রাজ্যের তালিকায় পশ্চিমবঙ্গও রয়েছে।

সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে

সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে (সরাসরি নিয়োগ) সর্বভারতীয় উন্মুক্ত বিভাগে প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থায় তফসিলি জাতি ও উপজাতির জন্য ১৫ শতাংশ ও ৭ দমমিক ৫ শতাংশ কোটা এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্যে ২৭ শতাংশ কোটার কথা বলা হয়েছে।

উন্মুক্ত বিভাগ নয়, এমন সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে তফসিলি জাতি ও উপজাতির জন্য ১৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ ও ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য ২৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ কোটা রয়েছে।

সরকারি চাকরিতে গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি কর্মীর নিয়োগের ক্ষেত্রে মূলত স্থানীয় বা আঞ্চলিক প্রার্থীরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আবেদন করে থাকেন। তাই সংশ্লিষ্ট রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বসবাসকারী তফসিলি জাতি ও উপজাতির সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট করা হয়। অন্যান্য অনগ্রসর গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সংরক্ষণ করা হয় ২৭ শতাংশ।

সরকারি চাকরিতে পদন্নোতির ক্ষেত্রেও (নন সিলেকশন মেথড) সংরক্ষণ রয়েছে। গ্রুপ এ, বি, সি, ডি সব ক্ষেত্রেই তফসিলি জাতির জন্য ১৫ শতাংশ এবং তফসিলি উপজাতির জন্য ৭ দশমিক ৫ শতাংশ কোটা রয়েছে।

বয়সের ঊর্ধ্বসীমার ক্ষেত্রেও সরকারি চাকরিতে তফসিলি জাতি ও উপজাতির প্রার্থীদের বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়ে থাকে।

নিয়োগের সময়, নারীদের বিশেষ প্রাধান্যের কথাও বলা হয়েছে। সেই নিয়ম মেনে ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণসহ তফসিলি জাতি, উপজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য যে সংরক্ষিত বিভাগ রয়েছে সেখানে নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।

বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে চাকরিতে আসন এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে।

ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য চাকরি ও শিক্ষাক্ষেত্রে ১ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করেছে কর্ণাটক। চলতি বছর কলকাতা হাইকোর্টের একটি নির্দেশিকায় পশ্চিমবঙ্গে ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য চাকরিতে ১ শতাংশ কোটার কথা বলা হয়েছে।

সূত্র: বিবিসি বাংলাকেএএ/