ফিচার

দেশে দেশে কোটা পদ্ধতি

শাহ বিলিয়া জুলফিকার

Advertisement

কোটা ব্যবস্থা এমন একটি নীতি, যেখানে সমাজের অনগ্রসর, দলিত, দরিদ্র, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং আদিবাসী জনগণের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক সিট বা সুযোগ বরাদ্দ করা হয়। বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই এ ব্যবস্থা চালু আছে। যার মূল লক্ষ্য সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় নিয়ে আসা এবং তাদের উন্নয়ন ও সমান সুযোগ-সুবিধা দেওয়া।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোটা ব্যবস্থা বিশেষত শিক্ষাক্ষেত্র এবং সরকারি চাকরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখানে শিক্ষার্থীদের ভর্তি ও চাকরি প্রাপ্তিতে নির্দিষ্ট শতাংশ আসন সংরক্ষিত থাকে। কোটা ব্যবস্থা সমাজের অবহেলিত অংশকে শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়, যা সমতার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কোটা ব্যবস্থার উপস্থিতি রয়েছে। বাংলাদেশে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত দেশে ২০ শতাংশ পদে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হতো। বাকি ৮০ শতাংশ পদে নিয়োগ হতো কোটায়। ১৯৭৬ সালে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ৪০ শতাংশে উন্নীত হয়। ১৯৮৫ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে ৪৫ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নিয়ম হয়। বাকি ৫৫ শতাংশ অগ্রাধিকার কোটায় নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আওতায় ছিল ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা ও ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী কোটা। পরে ১ শতাংশ পদ প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের দিয়ে পূরণের নিয়ম চালু হলে কোটা দাঁড়ায় ৫৬ শতাংশে।

Advertisement

২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত নিয়োগে কোটাপদ্ধতি বাতিল করা হয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ বাতিল চ্যালেঞ্জ করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল ২০২১ সালে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করে। গত ৫ জুন রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে সরকারের পরিপত্র বাতিল করে মুক্তিযোদ্ধা ৩০ শতাংশ কোটা বহাল রাখার আদেশ দেওয়া হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করলে ৪ জুলাই আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে নিয়মিত আপিল করতে বলেন। ফলে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ ও আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে কোটা বহাল থাকছে। ফলে বাংলাদেশে বিরূপ পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

ভারত আমাদের প্রতিবেশী দেশ। ভারতে কোটা ব্যবস্থাকে ‘রিজার্ভেশন’ বলা হয়। দেশটিতে কোটা ব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। ভারতে মোট চার ধরনের মানুষের জন্য কোটা রয়েছে। সেগুলো হলো- শিডিউলড কাস্টস (এসসি), শিডিউলড ট্রাইবস (এসটি), আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস (ওবিসি) ও ইকোনোমিক্যালি উইকার সেকশনস (ইডব্লিউএস)। ভারতের সংবিধানে মোট ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ কোটার কথা বলা আছে। শিডিউলড কাস্টসের জন্য ১৫ শতাংশ, শিডিউলড ট্রাইবসের জন্য ৭ দশমিক ৫ শতাংশ, ২৭ শতাংশ ওবিসিদের জন্য এবং দরিদ্র ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অংশের জন্য ১০ শতাংশ।

তবে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা প্রদেশভেদে ভিন্ন। দেশটিতে একটি পরিবারে শুধু একজনই এই কোটা ব্যবহার করতে পারবেন এবং উচ্চশিক্ষায় কোটার ব্যবহার করা হলে চাকরিতে সেই ব্যক্তি আর কোটা ব্যবহার করতে পারবেন না। এগুলো সরকারি খাতের চাকরি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং এমনকি রাজনৈতিক আসনগুলোতেও প্রযোজ্য; যাতে প্রান্তিক সম্প্রদায়গুলো ন্যায়সঙ্গত সুযোগ ও প্রতিনিধিত্ব পায়। ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৬ অনুসারে, নাগরিকদের জন্য রাষ্ট্রীয় চাকরির ক্ষেত্রে সমান সুযোগ থাকা উচিত। কোনো নাগরিককে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ, বংশ, জন্মস্থান বা বাসস্থানের ভিত্তিতে বৈষম্যের শিকার হতে হবে না। তবে রাষ্ট্র পিছিয়ে থাকা শ্রেণির জন্য এবং নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে আদিবাসী এবং তফসিলী জাতির জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা রাখতে পারে। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রেণির জন্যও সংরক্ষণ ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। যা বিদ্যমান সংরক্ষণ ব্যবস্থা ছাড়াও অতিরিক্তভাবে সর্বাধিক দশ শতাংশ পদের জন্য প্রযোজ্য হবে।

শ্রীলঙ্কা কোটা প্রয়োগ করে মূলত জাতিগত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। বিশেষ করে তামিল ও মুসলিমদের জন্য। এ ব্যবস্থার লক্ষ্য একটি জাতিগত সম্প্রীতি ও একতা প্রতিষ্ঠা করা। দেশটিতে কোটা ব্যবস্থা কিছু দেশের তুলনায় কম আনুষ্ঠানিক। কিন্তু সরকারি চাকরিতে বিভিন্ন প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

Advertisement

আরও পড়ুনটিন সার্টিফিকেট কী ও কেন দরকার?সুখ-দুঃখের নীরব সাক্ষী বাংলা বাজার ব্রিজ

নেপালের সংবিধান দলিত, আদিবাসী, নারী ও নেপালের সরকারি চাকরিতে কোটা দুই ভাগে করা আছে। একটি ৫৫ শতাংশ সাধারণ কোটা এবং অন্যটি ৪৫ শতাংশ সংরক্ষিত কোটা। সংরক্ষিত কোটার মধ্যে নারী, উপজাতি, মাদেশি, দলিত সম্প্রদায়, প্রতিবন্ধী এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে রাখা হয়েছে। মাদেশি সম্প্রদায়ের মতো প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোর জন্য সরকারি চাকরি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটার নিশ্চয়তা দেয়। কোটাগুলো এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে, যাতে ঐতিহাসিক অন্যায় সংশোধন করে সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীগুলোর জন্য সুযোগ নিশ্চিত করা যায়। পুরো অনুপাতটিকে আবার কয়েকটি বিশেষ উপ-কোটায় ভাগ করা হয়েছে। মহিলা-৩৩ শতাংশ, উপজাতি-২৪ শতাংশ, মাদেশি-২০ শতাংশ, দলিত সম্প্রদায়-৯ শতাংশ, প্রতিবন্ধী-৩ শতাংশ, মুসলিম-৩ শতাংশ, থারুস-৪ শতাংশ এবং প্রত্যন্ত বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী-৪ শতাংশ। এ কোটা ব্যবস্থা নেপালের আইনসভা কর্তৃক স্বীকৃত। ১৯৯৩ সালে নেপালের আইনসভা প্রণীত ‘সরকারি চাকরি আইন’ নামের বিশেষ একটি আইনের মাধ্যমে এ ব্যবস্থা সুরক্ষিত।

পাকিস্তানের কোটা ব্যবস্থায় নারী, জাতিগত সংখ্যালঘু ও স্বল্পোন্নত অঞ্চলের ব্যক্তিদের জন্য সরকারি চাকরিতে পদ সংরক্ষণ করা হয়েছে। আঞ্চলিক ভারসাম্য ও লিঙ্গ সমতাকে উন্নীত করার লক্ষ্যে ব্যবস্থাটি আঞ্চলিক বৈষম্য মোকাবিলায় পাকিস্তানের যে প্রচেষ্টা, তা প্রতিফলিত করে এবং সরকারি খাতে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে জনগণের সব অংশের ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে। পাকিস্তানে কোটা পদ্ধতি চালু আছে বিভিন্ন অঞ্চলের জনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে। দেশটিতে কোটা পদ্ধতির মূল কারণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সব অঞ্চলের মানুষ যেন সমানভাবে অংশ নিতে পারেন। পাকিস্তানে সাধারণ কোটা-৭.৫ শতাংশ, পাঞ্জাব-৫০ শতাংশ, সিন্ধ-১৯ শতাংশ, খাইবার পাখতুনখোয়া-১১.৫ শতাংশ, বালুচিস্তান-৬ শতাংশ, গিলগিত-বালতিস্তানের উপজাতি সম্প্রদায়-৪ শতাংশ, কাশ্মীর-২ শতাংশ, সিন্ধ কোটা-১৯ শতাংশ। তবে সরকারি চাকরিতে পুরো আসন ব্যবস্থার ওপরে ১০ শতাংশ নারীদের জন্য বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

মালয়েশিয়ায় উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জাতিগত কোটার মোট ৫৫ শতাংশ সুবিধা পেয়ে থাকে মালয় জনগোষ্ঠী। অন্যান্য ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ সুবিধা ভোগ করে মালয় জনগোষ্ঠী আর বাকি ৪০ শতাংশ ভোগ করে অন্যান্য জনগোষ্ঠী। জাপানে বুরাকুমিন সম্প্রদায়কে সরকারি চাকরিতে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ব্যক্তি মালিকানাধীন বা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মীসংখ্যা পাঁচ শতাধিক হলে, বুরাকুমিন এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য ৫ শতাংশ কোটার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। চীনের মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ হচ্ছে বিভিন্ন জাতি ও আদিবাসী সম্প্রদায়। তাদের জন্য সরকারি চাকরিতে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতার বিধান রয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য দেশটিতে এখনো ১ দশমিক ৫ শতাংশ চাকরি সংরক্ষণ করা হয়।

বিভিন্ন দেশের কোটা পদ্ধতির বৈচিত্র্যপূর্ণ চর্চা থেকে বোঝা যায়, সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন এবং সমান সুযোগ-সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে এই ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের কোটা ব্যবস্থা বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্র ও সরকারি চাকরিতে সমাজের অবহেলিত অংশকে সমানাধিকারের পথে এগিয়ে নিতে সহায়তা করেছে। তবে এ ব্যবস্থার অপব্যবহার ও সীমাবদ্ধতাও বিদ্যমান, যা কখনো কখনো বিতর্কের সৃষ্টি করে। অন্যদিকে ভারতের রিজার্ভেশন পদ্ধতি, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, জাপান এবং চীনের কোটা ব্যবস্থা তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রণয়ন করা হয়েছে।

এসইউ/জেআইএম