পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক, অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, আর্থিক দুরবস্থার কারণে দেশ দিন দিন ঋণনির্ভর হয়ে পড়ছে। ধীরে ধীরে ঋণ পাওয়ার সক্ষমতাও কমছে। সরকার বাজেট বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত রাজস্ব আদায় করতে পারছে না। এখন বাজেট বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় টাকাও নেই, ডলারও নেই আমাদের। কীভাবে বাস্তবায়ন হবে? আর্থিক খাতের সংকট মোকাবিলায় রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোনো বিকল্প নেই।
Advertisement
শনিবার (১৩ জুলাই) রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থার কারণ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন এ অর্থনীতিবিদ।
ইআরএফ সম্পাদক আবুল কাশেমের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা। অনুষ্ঠানে ব্যাংকখাতের ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সমকালের বিশেষ প্রতিবেদক ওবায়দুল্লাহ রনি এবং প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সানাউল্লাহ সাকিব।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমাদের বিদ্যুতের ক্ষেত্রে দুই বিলিয়ন ডলার বকেয়া পড়েছে। পর্যাপ্ত ডলার না থাকার কারণে জ্বালানি খাতসহ বিভিন্ন খাতের বিল পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। যদি স্বাস্থ্য ভালো না থাকে তাহলে তার ভার বহনও করা যায় না। ব্যাংকখাতের দুর্বলতার কারণে এখন ব্যাংক ব্যক্তিখাতকেও ঋণ দিতে পারছে না। আবার সরকার ঋণ দিতে পারছে না, সরকার পারবেও না। এখন ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৮ থেকে ৯ শতাংশ। চলতি বছর যদি বাড়ে, তাহলে সেটা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ হতে পারে। সে হিসাবে এবছর আমানত আসবে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। তাহলে নতুন অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংকখাত থেকে ঋণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা কীভাবে দেবে ব্যাংক? সরকার এক লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিলে ব্যক্তিখাত টাকা পাবে না। আবার বাজেটে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ২৭ শতাংশ। এখন পর্যন্ত ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ ২২ থেকে ২৩ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। ব্যাংকখাতের আমানতের প্রবৃদ্ধি যদি না বাড়ে, সরকারকে যদি ঋণ দিতে হয় তাহলে ২৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কীভাবে অর্জন হবে?
Advertisement
আরও পড়ুন:
প্রতি মাসে জানা যাবে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক চিত্রতিনি বলেন, নির্বাচনের আগে সরকার বলেছিল আর্থিক খাতে ব্যাপক সংস্কার আনা হবে। ছয় মাস পার হলেও সংস্কারের কিছুই হয়নি। এটা হতাশাজনক। দেশের স্বার্থেই ব্যাংকখাতের সংস্কার জরুরি। আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ দিয়েছে, এটাকে ভালো চোখেই দেখি। কিন্তু আমাদের নিজেদের স্বার্থেই ব্যাংকখাত সংস্কার করা দরকার। আমরা ব্যাংকের আমানত খেয়ে ফেলছি। এভাবে ব্যাংক কতদিন চলবে? ব্যাংকখাত নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা দরকার। সেটা সরকারকেই করতে হবে, বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়ে নয়। ব্যাংকখাতে আজকের এ অবস্থার কারণ আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।
তিনি বলেন, ঋণ আদায় না করে ঋণের সুদকে আয় দেখিয়ে মুনাফা দেখাচ্ছে ব্যাংকগুলো। সেই মুনাফার অর্থ থেকে লভ্যাংশ দিচ্ছে, সরকারও ট্যাক্স পাচ্ছে। বাস্তবে কোনো আয়ই হয়নি। ব্যাংকখাতের আমানতের অর্থ লুটে খাচ্ছে কয়েকটি গোষ্ঠী, কিছু কিছু পরিবার। সরকারের আশীর্বাদে তারা পুষ্ট হয়ে উঠেছে। তাদের কারণেই এখন আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে কার্পেটের নিচে ময়লা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে অথচ তা লুকিয়ে রাখা যায় না। একটা সময় তা দুর্গন্ধ ছড়াবেই।
প্রবন্ধ উপস্থানকালে ইআরএফের জ্যেষ্ঠ সদস্য ওবাইদুল্লাহ রনি ও সানাউল্লাহ সাকিব জানান, বর্তমান সরকারের সময়ে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেলের মতো অনেক বড় বড় প্রকল্প হয়েছে। এসব প্রকল্পের সুফল হিসেবে যেখানে কর্মসংস্থান বেড়ে মূল্যস্ফীতি নাগালের মধ্যে থাকার কথা। তবে ডলার সংকট, ব্যাংকখাতে দুরবস্থার কারণে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি মানুষকে চরম অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। সরকারের সব অর্জন যেন এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ব্যাংকখাতের দুরবস্থা ম্লান করে দিচ্ছে। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ধরে রাখতে কঠোর নীতির পরিবর্তে একের পর এক নীতি সহায়তার নামে ঋণখেলাপি, অর্থপাচারকারীদের সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ২০১৯ সালে মেয়াদি ঋণ পরিশোধে বিশেষ ছাড় এবং ৯-৬ এর মতো নীতি গ্রহণ করে অর্থনীতিকে বিপর্যয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। দেশের মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রাবাজার পরিস্থিতি এবং ব্যাংকখাতে বিশৃঙ্খলার বিষয়টি সবার জানা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার কাজে ব্যর্থ হয়েছে বলে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ বলেছেন। আবার যথাসময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ায় মূল্যস্ফীতি নিয়ে সবাই এখন অস্বস্তিতে আছে। সর্বশেষ সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি ঠেকেছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। গত ১৩ বছরের মধ্যে যা সর্বোচ্চ।
Advertisement
তারা বলেন, দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে কৃত্রিমভাবে ডলারের দর ৮৪-৮৬ টাকায় ধরে রেখেছিল। তবে করোনা পরবর্তী বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর তা আর ধরে রাখা যায়নি। শুরুর দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানান উপায়ে ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ করে ডলারের দর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। ২০২২ সালের আগস্টে কয়েকটি ব্যাংকের ট্রেজারি হেডকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এমডিদের ব্যাখ্যা তলব করা হয়। এরপর ব্যাংকখাতে আতঙ্ক ছড়িয়ে ডলার বাজার আরও খারাপ হয়। ডলারের দর উঠে যায় ১১০ টাকায়। একদিকে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, একই সঙ্গে দীর্ঘদিন কৃত্রিমভাবে ডলারের দর ধরে রাখার প্রভাবে টানা দুই বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। আবার ধারাবাহিকভাবে রিজার্ভ কমে ২০২১ সালের আগস্টের ৪৮.০৬ বিলিয়ন থেকে এখন ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। তবে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ১৫ বিলিয়নে নেমেছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ ডলার সংকট। অথচ অর্থপাচারকারী, মানি লন্ডারিংয়ের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
বর্তমান গভর্নর যোগদানের পরই এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেন ১০টি দুর্বল ব্যাংক আলাদাভাবে নিবিড় তদারকি করা হবে। এসব ব্যাংকে নির্বাহী পরিচালক পর্যায়ের একজন করে কর্মকর্তাকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ৩৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা বেড়ে গত মার্চ শেষে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা হয়েছে। মোট ঋণের যা ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। কাগজে-কলমে এটা দেখানো হলেও প্রকৃত খেলাপি ঋণ প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা বলে বিভিন্ন বক্তব্যে উঠে আসছে। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে নানান ছাড় দিয়ে কম দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে।
বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ বেশ আগে থেকেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সুদহার বৃদ্ধি ও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির ভঙ্গি গ্রহণ করে এরই মধ্যে সুফল পেতে শুরু করেছে। বেশ আগে থেকেই অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকারসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে বাংলাদেশের সুদহার বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে বর্তমান গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০২২ সালের আগস্টে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘আউট অব বক্স’ সিদ্ধান্ত নিয়ে তিন মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা হবে। ওই বছরের নভেম্বর- ডিসেম্বরের মধ্যে ডলার পরিস্থিতি ঠিক হয়ে আসবে। তবে প্রায় দুই বছর পরও উন্নতি দূরে থাক, আরও অবনতি হয়েছে। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশে বাড়ছে। যখন বৈশ্বিক রেটিং সংস্থা বাংলাদেশের মান অবনমন করে দিয়েছে, তখন গর্ভনর বলেছেন, এটা রাজনৈতিক কারণে কমানো হয়েছে।
ইএআর/এমএইচআর/এএসএম