একুশে বইমেলা

আবু আফজাল সালেহের কবিতায় বৃষ্টি

হুমায়ুন কবীর

Advertisement

আকাশজুড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। ধূলিমলিন প্রকৃতিতে লেগেছে প্রাণের হিল্লোল। এমন সময় কবিতা পড়তে মন চায়। কবি আবু আফজাল সালেহের বৃষ্টি বিষয়ক চমৎকার কিছু কবিতা আছে। কবিতাগুলো বিগত শীত মৌসুমে পড়েছিলাম। তখন মনে হয়েছিল ঝরঝর বৃষ্টি-বেলায় কবিতাগুলো আবার পড়ে দেখবো। আজ সেই বৃষ্টিবেলা সমাগত—‘আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছলছল জলধারে’ বৃক্ষরাজির পাতায় টুপটাপ টুপটাপ—যেন প্রকৃতির এক অনবদ্য সংগীত। এই বৃষ্টিক্ষণে আলমিরা থেকে টেনে নিলাম কবি আবু আফজাল সালেহের কবিতার বই—‘বারবার ফিরে আসি’, ‘বলেই ফেলি ভালোবাসি’, ‘জলপাথরে বন পাহাড়ে’।

বৃষ্টি নিয়ে অনন্য কিছু কবিতার সাক্ষাৎ পেয়ে গেলাম বইগুলোর পাতায় পাতায়। কবিতাগুলোর রূপ-রস-গন্ধের মধ্যে নিমজ্জিত হলাম। দেখলাম, কবির সৃজনখেলার রং-রেখা লেগে আছে তাতে। লক্ষ্য করলাম, বৃষ্টি পতনের ছবি অঙ্কনে কবি যুগপৎ বস্তুনিষ্ঠ ও ব্যক্তিনিষ্ঠ। নিখুঁত বৃষ্টির বস্তুনিষ্ঠ ছবিটি এমন—‘মেঘগুলো কাঁদবে এখনইএকঝাঁক বৃষ্টি হবে বা তারও বেশি।এ শহর বৃষ্টির প্রতীক্ষায়...’বাদলের ধারায় মন সিক্ত হয়ে কবির কল্পনা সাবজেক্টিভ হয়ে পড়ে। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে কবিতায় কবি এঁকে চলেন বর্ষার ছবি।

কবি আবু আফজাল সালেহের মনের মাধুরী সিক্ত, আধুনিক উপমা-অলংকারে নির্মিত কবিতাগুলো অনন্য। এই যেমন দারুণ উপমায় উপমায় শপথের দৃঢতায় তার উচ্চারণে:‘তোমার টোল খাওয়া গালের শপথবৃষ্টি বিন্দুতে ভেজা তোমার ভ্রুর শপথতোমার খোলা চুলের শপথ—ভিজবই আজ।’অন্যত্র কবি বলেন,‘তুমি বললেই একঝাঁক বৃষ্টি শুরু হবেতুমি বললেই বিরাট এক রংধনু সৃষ্টি হবেএই বৃষ্টি তোমার চোখের চেয়ে কমনীয় নয়এই রংধনু তোমার নগ্ন পায়ের চেয়ে উজ্জ্বলতর নয়...’ বৃষ্টির আগমনে কল্পনার বুনন বাস্তবকে ছাপিয়ে চলে—এটি সাবজেক্টিভ। ভাবনাগুলো কবির বৃষ্টি প্রেমের অনবদ্য প্রকাশ।

Advertisement

কবিতা নির্মাণে লাগে ভাব, ভাষা আর ছন্দ। লাগে আবেগ, প্রেরণা আর প্রবল কল্পনা শক্তি। তার পঙক্তি পাঠে মনে হলো, প্রবল কল্পনা শক্তি তাকে টেনে নিয়ে গেছে বৃষ্টিমুখর কবিতার ভুবনে। তীব্র বৃষ্টি আসক্তি কাজ করে কবির রক্তে। সেজন্য তার কবিতায় বারবার ঘুরেফিরে আসে বৃষ্টি। যেমনটি কবি বলেন:‘নীল রঙের মেয়েটি বৃষ্টি হয়ে ঝরছেসে নদী আনতে গিয়েছিলনদী তার হাত ধরেনিসে প্রজাপতি হতে চেয়েছিলকেউ তার ডানা ভেঙেছেসে এখন ঢেউ হয়ে সাগর পাড়ি দেবে।’

কবিতাগুলো ঠিক কোন মৌসুমে লেখা তা জানি না। পড়তে পড়তে মনে হলো হতে পারে আষাঢ়ে, হতে পারে শ্রাবণে। হয়তো তখন কদম ফুলে ছেয়েছিল গাছ, হয়তো তখন কেয়া বনে কেয়া ফুটেছিল। এমন ফুলেল বর্ষায় কবির শিল্পীসত্তা জেগে ওঠা স্বাভাবিক। তার কবিতার শব্দ আর চিত্রভাষ্য দেখে সেটাই মনে হচ্ছে। অবশ্য বসন্তে অথবা গ্রীষ্মে লেখা হলেও ক্ষতি নেই। এই বৃষ্টি—নেশাভরা সন্ধ্যা বেলা বেশ লাগছে। কবির বৃষ্টি-পঙক্তি—এটাই বড় কথা। ‘শরতে বরষা- চিঠি, একটি নস্টালজিয়া’ কবিতায় চোখ পড়লো। এক রিমঝিম বৃষ্টি-দুপুরে পাওয়া চিঠিতে কে একজন ‘কী একটা’ বলবে বলেও বলেনি। না বলাটাই সত্য—বর্ষার দিনে প্রেমিকজন কী যে বলতে চায়, তা এক অমীমাংসিত প্রশ্ন। ওই যে কবি বলেছেন, ‘এমন দিনে তারে বলা যায় এমন ঘনঘোর বরিষায়’। কিন্তু কী যে বলা যায়, তা কবি স্পষ্ট করেননি।

কবিতাগুলো কবি-মনের গহন দ্বার উন্মোচিত করেছে। কবি কান পেতেছেন বৃষ্টি সংগীতে। খেয়াল করার বিষয়, এই সংগীত তিনি একা উপভোগ করতে চান না। এজন্য কবিকে একটা ‘তুমি’ আমদানি করতে হয়েছে। কবির যত ভালোবাসা, যত প্রেম—এই স্বনির্মিত তুমিতে সমর্পিত। অবয়বধারী জীবন্ত কেউ এই প্রেমের পাত্র-পাত্রী হতে ব্যর্থ। কবির উচ্চারণ: ‘আমাকে তুমি ভিজতে নেবে?ইচ্ছে করে, শহরজুড়ে জল নামুকরিমঝিমিয়ে মুষলধারেঝরঝরিয়ে বৃষ্টি নামুক—ছাতাবিহীন তোমার পথে... আজকে তুমি ভিজতে নেবে?’

কবিতাগুলোর দৈহিক সৌন্দর্য রক্ষা এবং একই সাথে অন্তর সৌন্দর্য রক্ষা করতে চেষ্টা করেছেন কবি। কবির সুতীক্ষ্ম সৌন্দর্য চেতনার প্রকাশ কবিতায় এসেছে বিচিত্র পথ ধরে। বৃষ্টিবেলায় মেঘেদের ওড়াউড়ি দেখে কবি-মন যেন হয়েছে মেঘের সঙ্গী, উড়ে চলেছে দিক দিগন্তের পানে। এই প্রকাশ তার কবিতায় ধরা পড়েছে এভাবে:‘মেঘেরা ওড়ে, দেশ-দেশান্তরে;চোখের জল নিয়ে, আনন্দাশ্রু নিয়ে... আমিও সাদা মেঘ হয়েই উড়ে যেতে চাই।’

Advertisement

আরও পড়ুন কম্বুরেখপদাবলি: দেহ আর হৃদয়ের রেখা  তপন বাগচীর সাক্ষাৎকারসংগ্রহ: সাহিত্যের আয়না 

বৃষ্টি-প্রাণ কবি বলেন, ‘বৃষ্টি ছুঁয়ে দেবে আমায়আমি রংধনু হয়ে মিশে যাবআকাশে-দূর নীলিমার আলোয়।’স্বসৃষ্ট মানসীর সাথে ভিজতে আগ্রহী কবি উচ্চারণ করেন, ‘আজ না হয় ভিজতে নাওকতদিনের শখ পূরণেপূর্ণ করো চাওয়াগুলোবৃষ্টি এসো কলকলিয়ে...’

বৃষ্টি পতনে মুগ্ধ কবি বলেন, ‘ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখি,সবুজ পাতায় বৃষ্টিঝরা...এই বৃষ্টি এই রোদজোড়া রাজহাঁস পাহাড়ের ঝিরিতেদুটি প্রাণী ব্যালকনিতে...’

কবিতা সম্পূর্ণভাবে আনন্দের আর আংশিকভাবে অথবা পরিপূর্ণভাবে বুঝে ওঠার। বুঝি না বলে কি আনন্দ পাই না; পাই তো। কবিতার সাথে মস্তিষ্কের সম্পর্ক মুখ্য না, গৌণ। কবিতার সাথে আসলে মননের সম্পর্ক। আবু আফজাল সালেহের কবিতায় মননের সাথে জটিল নয়, সহজ সম্পর্ক দেখতে পাই:‘আবার বৃষ্টি নামুক; অঝরে।অনেক দিনের ইচ্ছে বৃষ্টিতে ভিজব।তুমি কি ভিজবে আমার সাথে?শ্রাবণের মেঘমালা আর তোমার হাসিমিলেমিশে একাকার।’

কবিরা সাধারণত বসন্তপ্রিয়। মনে হচ্ছে, আবু আফজাল সালেহ বসন্ত নয়, বর্ষাপ্রিয়। তার ‘বলেই ফেলি ভালোবাসি’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো ভালোবাসা ও প্রেমের রূপ নিয়ে লেখা। প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে সমন্বয় করে রোমান্টিসিজমের একটা আবহ তৈরি করেছেন কবি। প্রাককথনে একথা নিজেই বলেছেন। কিন্তু লক্ষ্যণীয় যে, সেখানে অনেকগুলো কবিতায় স্পষ্ট প্রাধান্য পেয়েছে বৃষ্টি-প্রেম। মানবীয় প্রেমানুভূতি যা এসেছে; তা পূর্ণতা পেয়েছে বৃষ্টি অনুষঙ্গে। কবি বৃষ্টি ফোঁটায় শিহরিত হয়েছেন, বৃষ্টিতে ভিজতে চেয়েছেন, কাকে যেন বলেছেন, তোমার গালে বৃষ্টির ছাপ এঁকে দেবো। সেই তাকেই বলেছেন,‘এই যে বরষার বৃষ্টির ফোঁটাতোমার খালি পায়ে হাঁটা—জাগায় শিহরণ।’

কিছু কবিতায় বিরহের কথা শোনা যায়। সেখানে বৃষ্টি-ফোঁটায় স্মৃতিরা মেলে ডানা। কবি স্মরণ করেন, দর্শনা কলেজ সংলগ্ন চটকাতলায় তুমুল বৃষ্টিতে ভেজা, বেরসিকের হাসাহাসি, সিডিএলে গল্প আর কবিতা বিনিময়ের সেইসব বৃষ্টিক্ষণ। বৃষ্টির অলস দুপুর-বিকেল এভাবেই কেটে যেত অনায়াসে। আজ সেই স্মৃতি মনের কোণে উঁকিঝুঁকি দেয়। আজ তুমুল বৃষ্টিতে ভিজতে চান কবি। কবিতায় তার কামনা:‘তোমার খোলা চুলের শপথ—ভিজবই আজ।নরম-বৃষ্টির কোলে ভিজতে চাই অনন্তকালতুমুল বৃষ্টির জলে ভিজতে চাই সারাজীবনঝুমবৃষ্টিতে ভিজতে চাই তোমার সঙ্গে।’

বৃষ্টিপতন কবির প্রিয় বিষয়। বৃষ্টি-কবিতাগুচ্ছে কবির প্রাণের খেলা আমাদের মন কাড়ে। বৃষ্টির রূপে কবি মোহাবিষ্ট, মুগ্ধ। এই মুগ্ধতার প্রকাশ ঘটাতে তিনি সক্ষম হয়েছেন কবিতায়। এই বৃষ্টি-কবিতাগুলো কবির সৃষ্টি মুখরতা আর সৌন্দর্যবোধের সাক্ষ্য বহন করে। আসমানি বৃষ্টি-পতন অনন্য সুন্দর হয়ে উঠেছে কবির শিল্পীত বোধে।

এসইউ/জিকেএস