আইন-আদালত

কতজন চাকরিপ্রার্থী প্রশ্ন পেয়েছে জানতে চায় সিআইডি

বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) আইনে করা প্রশ্নফাঁসের মামলায় পিএসসির উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর আলমসহ (৫৮) ছয়জনকে দশ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেছে মামলার তদন্ত সংস্থা সিআইডি। এই ছয়জনসহ গ্রেফতার দশজন বিসিএসসহ পিএসসির বিভিন্ন গ্রেডের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র অর্থের বিনিময়ে পরীক্ষার আগে ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ প্রাথমিক তদন্তে পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এখন পিএসসি আয়োজিত বাংলাদেশ রেলওয়ে সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (নন-ক্যাডার) পদে কতজন নিয়োগপ্রার্থীর কাছে প্রশ্ন এবং প্রশ্নের উত্তর বিতরণ করা হয়েছে তা জানতে চায় সিআইডি। মোট নয়টি বিষয়ে জানতে ছয়জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় সংস্থাটি।

Advertisement

বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমা ছয় আসামিকে দশ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরী আসামিদের উপস্থিতিতে রিমান্ড শুনানির জন্য ১৬ জুলাই দিন ধার্য করেন।

আরও পড়ুনকুলি থেকে কোটিপতি পিএসসির গাড়িচালক আবেদ আলীখলিলের ফাঁস করা প্রশ্নে ৩ বিসিএস ক্যাডার, আতঙ্কে অন্যরাও ছয় আসামির কাছে যে ৯টি বিষয় জানতে চায় সিআইডি রিমান্ড আবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, নয়টি বিষয় জানতে আসামিদের রিমান্ডে নেওয়া প্রয়োজন। বিষয়গুলো হলো:

১. বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (বাংলাদেশ রেলওয়ে), পদের নাম: সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (নন ক্যাডার) নিয়োগ পরীক্ষার মূল প্রশ্ন তারা কীভাবে সংগ্রহ করতো এবং তাদেরকে কে সরবরাহ করতো।

২. প্রশ্ন ফাঁসের এই চক্রটির সঙ্গে আর কারা কারা জড়িত।

Advertisement

৩. কীভাবে তারা প্রশ্নফাঁস করতো।

৪. কারা কারা কীভাবে তাদের কাছ থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করত।

৫. কীভাবে নিয়োগপ্রার্থী পরীক্ষার্থীর কাছে ওই পদের প্রশ্ন এবং প্রশ্নের উত্তর বিতরণ করতো।

৬. কতজন নিয়োগপ্রার্থী পরীক্ষার্থীর কাছে ওই পদের প্রশ্ন এবং প্রশ্নের উত্তর বিতরণ করা হয়েছে।

Advertisement

৭. প্রশ্নফাঁসের এই চক্রটির দ্বারা প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে মোট কত পরিমাণ অর্থ লেনদেন হয়েছে।

৮. লেনদেন করা অর্থের সুবিধাভোগীদের শনাক্ত করা। এবং

৯. মামলা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ আলামত উদ্ধার।

অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন এবং প্রশ্নের উত্তর বিতরণ

রিমান্ড আবেদনে তদন্তকারী কর্মকর্তা আরও উল্লেখ করেন, গত ৫ জুলাই বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন আয়োজিত বাংলাদেশ রেলওয়ে সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (নন ক্যাডার) পদের নিয়োগ পরীক্ষার জন্য একটি সংঘবদ্ধ চক্র পরীক্ষা অনুষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ের আগে ওই পরীক্ষার হুবহু প্রশ্নপত্র ফাঁস করে একদল সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (নন ক্যাডার) পদে নিয়োগপ্রার্থী পরীক্ষার্থীর নিকট অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন এবং প্রশ্নের উত্তর বিতরণ করেছে। তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি অবহিত করলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ প্রাপ্ত সংবাদের সত্যতা যাচাইপূর্বক প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মৌখিক নির্দেশ প্রদান করেন। পরবর্তীতে বাদী এই মামলার ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত আসামিদের শনাক্তপূর্বক গ্রেফতার করে এজাহার দায়ের করেন। স্বল্প সময়ের জিজ্ঞাসাবাদে মামলার ঘটনা সংক্রান্ত সব আসামির কাছ থেকে পূর্ণাঙ্গ তথ্য উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা একটি সংঘবদ্ধ চক্র হিসেবে বিগত বছরগুলোর বিভিন্ন সময়ে বিসিএসসহ পিএসসির বিভিন্ন গ্রেডের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র অর্থের বিনিময়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ের পূর্বে ওই পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়।

আরও পড়ুনপ্রশ্নফাঁসে গ্রেফতার পিএসসির ৫ কর্মকর্তা-কর্মচারী বরখাস্তপ্রশ্নফাঁস নিয়ে পিএসসির আইনে প্রথম মামলা, হতে পারে যে সাজা

যাদের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে তাদের মধ্যে অপর পাঁচ আসামি হলেন- পিএসসির সহকারী পরিচালক এস এম আলমগীর কবির (৪৯), ডিডি আবু জাফর (৫৭), প্রতিরক্ষা ও অর্থ বিভাগ এসিসিডিএফের (বিওএফ) অডিটর প্রিয়নাথ রায় (৫১), মিরপুরের পোশাক কারখানার ব্যবসায়ী নোমান সিদ্দিকী (৪৪) ও ব্যবসায়ী জাহেদুল ইসলাম (২৭)।

এছাড়া কারাগারে থাকা চারজন হলেন- ব্যবসায়ী শাহাদত হোসেন, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের অফিস সহকারী মামুনুর রশিদ, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের টেকনিশিয়ান নিয়ামুল হাসান ও সৈয়দ আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম।

ছয় আসামির কাছে ৯টি বিষয় জানতে চায় সিআইডি

এর আগে ৯ জুলাই গ্রেফতার ১৭ আসামিকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। এসময় আবেদ আলীসহ ছয়জন ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে সম্মত হওয়ায় তা রেকর্ড করার আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমা। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করেন।

তবে, পিএসসির উপ-পরিচালক মো. আবু জাফর ও মো. জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবিরসহ ১১ জনকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিনা হক তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

কারাগারে ১১ আসামি

কারাগারে যাওয়া অপর আসামিরা হলেন- পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম, সাবেক সেনা সদস্য নোমান সিদ্দিকী, অডিটর প্রিয়নাথ রায়, ব্যবসায়ী মো. জাহিদুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত হোসেন, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত মো. মামুনুর রশীদ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিকেল টেকনিশিয়ান মো. নিয়ামুন হাসান ও ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী বর্তমানে মিরপুরের ব্যবসায়ী আবু সোলায়মান মো. সোহেল। এদের মধ্যে সোহেল দায় স্বীকার করতে অস্বীকার করলে তাকেও কারাগারে পাঠানো হয়।

ছয়জনের দায় স্বীকার

প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় করা মামলায় পিএসসির গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ ছয়জন দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। অন্যরা হলেন- পিএসসির অফিস সহায়ক খলিলুর রহমান, অফিস সহায়ক (ডিসপাস) সাজেদুল ইসলাম, ব্যবসায়ী সহোদর সাখাওয়াত হোসেন ও সায়েম হোসেন এবং বেকার যুবক লিটন সরকার।

সোমবার (৮ জুলাই) রাজধানীর পল্টন থানায় এ আইনের ১১/১৫ ধারায় মামলা করেন সিআইডির উপ-পরিদর্শক নিপ্পন চন্দ্র দাস। মামলায় সৈয়দ আবেদ আলীসহ ৩১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় আসামি আরও ৫০ থেকে ৬০ জন। অভিযোগ প্রমাণ হলে আবেদ আলীসহ আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে ১০ বছরের কারাদণ্ড।

মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, আসামিরা সংঘবদ্ধ চক্র হিসেবে বিগত বছরগুলোতে বিসিএসসহ পিএসসির বিভিন্ন গ্রেডের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র টাকার বিনিময়ে ফাঁস করেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা এ তথ্য স্বীকার করেছেন।

আরও পড়ুনপিএসসির উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীরসহ ছয়জনকে রিমান্ডে নিতে আবেদনপ্রশ্নফাঁস: আবেদ আলীসহ চারজনের জামিন নামঞ্জুর

এজাহারে বাদী আরও উল্লেখ করেন, চক্রটি বাংলাদেশ রেলওয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী (নন ক্যাডার) সহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পরীক্ষার আগে অবৈধ উপায়ে সংগ্রহ করেন। এরপর সেগুলো অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করেন। গ্রেফতার আসামিরাসহ জড়িত অন্যরা বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন আইন, ২০২৩ এর ১১/১৫ ধারার অপরাধ করেছেন বিধায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

মামলায় আবেদ আলী ও তার ছেলেসহ গ্রেফতার দেখানো হয়েছে ১৭ জনকে। তারা হলেন, পিএসসির উপ-পরিচালক মো. আবু জাফর ও মো. জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির, অফিস সহায়ক খলিলুর রহমান ও অফিস সহায়ক (ডিসপাস) সাজেদুল ইসলাম।

আদালতে আসামিরা-ছবি জাগো নিউজ

এছাড়াও রয়েছেন- সাবেক সেনাসদস্য নোমান সিদ্দিকী, ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী বর্তমানে মিরপুরের ব্যবসায়ী আবু সোলায়মান মো. সোহেল, অডিটর প্রিয়নাথ রায়, ব্যবসায়ী মো. জাহিদুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত হোসেন, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত মো. মামুনুর রশীদ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিকেল টেকনিশিয়ান মো. নিয়ামুন হাসান, ব্যবসায়ী সহোদর সাখাওয়াত হোসেন ও সায়েম হোসেন এবং বেকার যুবক লিটন সরকার।

পিএসসির সাবেক সহকারী পরিচালক নিখিলসহ ১৪ জন এখনো পলাতক

মামলার পলাতক আসামিরা হলেন- পিএসসির সাবেক সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায়, মো. শরীফুল ইসলাম, দীপক বনিক, খোরশেদ আলম খোকন, কাজী মো. সুমন, একেএম গোলাম পারভেজ, মেহেদী হাসান খান, গোলাম হামিদুর রহমান, মিজানুর রহমান, আতিকুল ইসলাম, এটিএম মোস্তফা, মাহফুজ কালু, আসলাম ও কৌশিক দেবনাথ।

প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্য সামনে আসার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সৈয়দ আবেদ আলীর বিপুল সম্পদের তথ্য তুলে ধরছেন নেটিজেনরা। তার ছেলে ছাত্রলীগ নেতা (বহিষ্কৃত), পড়েছেন বিদেশে। এরপর দেশের একটি ব্যয়বহুল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ঢাকায় দুটি বহুতল ভবন রয়েছে আবেদ আলীর, মাদারীপুরেও রয়েছে আলিশান বাড়ি।

আরও পড়ুনকুলি থেকে কোটিপতি পিএসসির গাড়িচালক আবেদ আলীপিএসসির উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীরসহ ছয়জনকে রিমান্ডে নিতে আবেদন

এমনকি চেয়েছিলেন নতুন উপজেলা ডাসারের উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হতে। এ লক্ষ্যে প্রচার-প্রচারণাও শুরু করেন। এছাড়া সমাজের বিত্তবান ও প্রভাবশালীদের সঙ্গে নিয়মিত চলাফেরা করতেন আবেদ আলী। প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গেও ছিল ওঠাবসা।

এক বেসরকারি টেলিভিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পিএসসির কোনো নিয়োগ পরীক্ষা এলেই প্রশ্নফাঁস করে অর্থ লোপাটে মেতে উঠতো চক্রটি। সংঘবদ্ধ এ চক্র গত ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত রেলওয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলীর নিয়োগ পরীক্ষাকে বেছে নেয়। এ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস করে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়।

জেএ/এসএইচএস/জেআইএম