বিশ্বব্যাপী জীবনের মৌলিক অংশ হিসেবে স্বীকৃত পরিবার পরিকল্পনা, যা জনসংখ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত। জনসংখ্যার বিষয়ে মানুষকে সচেতনতার লক্ষ্যে প্রতি বছর পালন করা হয় ‘বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস’। দিবসটিতে প্রতি বছরই একটি থিম ঠিক করা হয়। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উপাত্ত ব্যবহার করি, সাম্যের ভিত্তিতে সহনশীল ভবিষ্যৎ গড়ি’।
Advertisement
এবারের বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের প্রতিপাদ্য, জনসংখ্যার ঘনত্ব, বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অর্থনীতি, জনজীবন ও ভবিষ্যতে কী ধরনের প্রভাবে পড়বে— এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের শিক্ষক আবু হাসনাত মো. কিশোয়ার হোসেনের সঙ্গে বিস্তারিত কথা হয় জাগো নিউজের। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক আবদুল্লাহ আল মিরাজ।
জাগো নিউজ: এ বছরের প্রতিপাদ্যের মূল লক্ষ্য কি?কিশোয়ার হোসেন: এ প্রতিপাদ্যের মূল লক্ষ্য হচ্ছে জনসংখ্যাকে কেন্দ্রে করে সঠিক তথ্য-উপাত্ত অনেক বেশি দরকার। আমাদের দেশে কোনো কাজ করতে গেলেই তথ্য ঘাটতিতে পড়তে হয়। আবার সঠিক তথ্যও পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জনসংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত দেয়। কিন্তু এর মধ্যে সব ধরনের তথ্য থাকে না। যেমন, তৃতীয় লিঙ্গের তথ্য পরিসংখ্যানে এসেছে। কিন্তু তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চাকরিজীবী কতজন এবং তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যায় না। এছাড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর তথ্য সঠিকভাবে থাকে না। তবে যখন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ও বস্তিবাসীর ওপর কোনো পলিসি মেকিং করতে চাওয়া হয় তখন সঠিক-বিস্তারিত তথ্য প্রয়োজন হয়। এ থিম সেক্টরভিত্তিক তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বিবিএস অনেক এগিয়েছে। তবে এক্ষেত্রে তাদের সঠিক তথ্যের ওপর আরও জোর দিতে হবে। দেখা যায়, বিবিএসের তথ্যের সঙ্গে অন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের তথ্যের তারতম্য থাকে। এ বিষয়ে আরও যত্নশীল হতে হবে।
Advertisement
কিশোয়ার হোসেন: বয়সভিত্তিক জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে বাংলাদেশ লাভবান হচ্ছে। কারণ, আজ থেকে ২০ বছর আগে দেশের জনসংখ্যার বেশিরভাগই ছিল শূন্য থেকে ১৪ বছর বয়সী। তারা যুবকদের ওপর ডিপেন্ডেন্ট (নির্ভরশীল) ছিল। তারা ইকোনমিতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারতো না।
আরও পড়ুন ১১ বছরে চট্টগ্রামে জনসংখ্যা বেড়েছে সাড়ে ১৫ লাখ লক্ষ্মীপুরে পুরুষের চেয়ে এক লাখ বেশি নারী জনসংখ্যার ১১ ভাগ আর্সেনিক দূষণের ঝুঁকিতে২০০০ সালের পর থেকে কর্মক্ষম জনসংখ্যা বাড়ছে। কর্মক্ষম মানুষ বেড়ে যাওয়া মানেই হচ্ছে আয় বৃদ্ধি পাওয়া এবং ডিপেন্ডেন্সি মানুষ কমবে। এটি রাষ্ট্রের জিডিপিতে (মোট দেশজ উৎপাদন) ভূমিকা রাখবে। অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২৯ সালের মধ্যে দেশে বয়স্ক মানুষ বাড়বে। ২০৪৫-২০৪৭ সালের দিকে তাদের আধিক্য আরও বেড়ে যাবে। কারণ, তখন ৬০ এর বেশি বয়স্ক মানুষ বেড়ে যাবে। বর্তমানে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ৬৫ শতাংশ। বয়স্ক মানুষ ৭ শতাংশের কাছাকাছি, যা বাড়তে থাকবে।
এ বিষয়ের ওপর লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আমরা এখন জনসংখ্যার সুফল পাওয়ার সময়ে আছি। ২০২৪ সালে এসে চিন্তা করা যায় আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। আমরা বয়স্ক সোসাইটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের হাতে ২৪ বা ৩৪ বছর সময় আছে। এ সময়ের মধ্যে আমাদের কর্মক্ষম জনসংখ্যা লাভজনক দিকে নিতে হবে, যা সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াসহ অনেক দেশ নিয়েছে।
জাগো নিউজ: জনসংখ্যার লাভজনক দিক ধরে রাখতে সরকারের করণীয় কী হতে পারে?কিশোয়ার হোসেন: আমাদের বয়স্ক সোসাইটিতে যাওয়ার আগে শিক্ষা, চিকিৎসা ও ক্যাপিটাল বাড়াতে হবে। শিক্ষা দিয়ে স্কিলফুল জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে লাভজনক কাজ করে রাষ্ট্রের আয় বাড়াতে পারবো। এর মধ্যে কারিগরি শিক্ষা বাড়াতে হবে। যাতে শিক্ষার্থীরা বেশি মাত্রায় আয় করতে পারে। স্বাস্থ্যখাতে কিছুটা এগিয়েছি। তবে সুস্থ জাতি তৈরি করতে হবে। যাতে মানুষ অধিক কর্মক্ষম থাকে। আমাদের শহরের স্বাস্থ্যসেবা থেকে গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা আগের তুলনায় উন্নত হয়েছে। কিন্তু শহরে জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবার সেরকম উন্নতি হয়নি।
Advertisement
আমাদের পলিসির অভাব নেই, আইনের অভাব নেই, প্রোগ্রামের অভাব নেই। কিন্তু সঠিকভাবে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এটি না হলে কার্যকর কোনো লাভ আসবে না। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর আয়ের অংশ সঞ্চয় থাকে। তারা বয়স্ক হলে তা ইনভেস্টমেন্টে পরিণত হবে। এক্ষেত্রে তারা কর্মক্ষম অবস্থায় কেমন আয় করেছে তার ওপর নির্ভর করছে।
জাগো নিউজ: গড় আয়ু বাড়ার ফলে মানুষকে আরও বেশি সময় কাজে লাগানো যায় কি না?কিশোয়ার হোসেন: আমাদের বর্তমানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় গড় আয়ু বেড়েছে। গড় আয়ু বৃদ্ধি পাওয়া মানুষ বেশি দিন সুস্থ থাকলে তাদের ৬৫ বছরে রিটায়ারমেন্ট (অবসরে) না দিয়ে আরও কাজের সুযোগ দেওয়া উচিত। এসব দিক ওভারকাম করা যাবে।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশের জনসংখ্যা কি বাড়ছে?কিশোয়ার হোসেন: বাংলাদেশের মোট প্রজনন হার (টিএফআর) বর্তমানে জরিপের ভিন্নতায়, যা এখন নেমে এসেছে ২ দশমিক ৩ থেকে ২ দশমিক ১ এ, যা সত্তরের দশকে ছিল ৬ দশমিক ৩। টিএফআর ২-এ থাকলে আমরা ধরে নেই জন্ম-মৃত্যু সমান অবস্থানে আছে। তবে, ২০১১ সাল থেকে টিএফআর ২ দশমিক ১ এ স্থির। এটি কমছে না। কিছু জেলাভিত্তিক ক্ষেত্রে এটির তারতম্য ঘটে।
যেমন, সিলেট বিভাগে ২০১৭ সালে টিএফআর দুই দশমিক ছয় থেকে নেমে ২ দশমিক ৩ হয়েছিল। ২০১৭ তে খুব ভালো অবস্থানে ছিল খুলনা ও রংপুর বিভাগ। খুলনার টিএফআর ছিল ১ দশমিক ৯ আর রংপুরের ২ দশমিক ১। কিন্তু ২০২২ এ এটি খুলনায় বেড়ে হয়েছে ২ দশমিক ২ ও রংপুরে ২ দশমিক ৫, যা চিন্তার বিষয় হয়ে উঠেছে। সব ঠিক থাকলেও এটি কেন বাড়ছে তা চিন্তার কারণ।
এর মধ্যে বর্তমানে বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বাল্যবিয়ে। দেশে এখনো ৫০ শতাংশের মতো বাল্যবিয়ে হচ্ছে। এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) অনুসরণ করে ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে নির্মূল করতে হবে। এটি অর্জন করতে সরকারের কাজের গতি আরও সাতগুণ বাড়াতে হবে। বাল্যবিয়েও টিএফআরে ভূমিকা রাখছে।
আরও পড়ুন তরুণ প্রজন্মকে বিয়েতে উৎসাহিত করতে জোর চেষ্টা জাপানের শীর্ষ দূষণের শহর ঢাকা বসবাসেরও অযোগ্য দেশে বেকার বেড়েছে ১ লাখ ২০ হাজারকরোনাভাইরাসের সময় আমাদের পরিবার পরিকল্পনার সাপ্লাই চেইনে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। বর্তমানে আমরা দেখি জনসংখ্যা একটু বাড়ছে। তবে এর ইমপ্যাক্ট কি হবে সেটা এখনই বোঝা যাবে না। ধারণা করা বিষয়ে পরিবর্তন থাকতেই পারে। সেটা এখনই সঠিক বলা যাবে না।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশ সরকারের কী জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন?কিশোয়ার হোসেন: দেশে জনসংখ্যার আধিক্য পুরোনো বিষয়। বর্তমানে আমরা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বলি না, বলা হয় জনসংখ্যা ম্যানেজমেন্ট। আমাদের বেশি জনসংখ্যা বা শ্রমিক থাকলে তাদের দক্ষ বানিয়ে কাজে লাগাতে পারি। দেশের উন্নতি ঘটবে।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধ সহজ ছিল না। এটি অনেকটা ট্রেনের মতো। যেমন ট্রেনে ব্রেক কষলে থামতে সময় লাগে। বাংলাদেশে জনসংখ্যার হার বৃদ্ধিবিষয়ক যেসব পলিসি নেওয়া হয়েছে তখন থেকেই আমরা এটি বুঝেছি। আমরা কনডম, জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সবই দিলাম। তবুও আমাদের জিরো পপুলেশন গ্রোথে যেতে অনেক সময় লাগবে।
বাংলাদেশ এখন ১৭ কোটি মানুষের কাছাকাছি চলে গেছে। আগে আমরা ভাবতাম এত মানুষকে খাওয়াবো কী। কিন্তু বর্তমানে এ বিষয় নিয়ে আমরা তেমনটা ভাবছি না। এ সমস্যা অনেকটা কাটিয়ে উঠেছি। আগে এলাকায় কেউ রুই মাছ, পাঙাশ মাছ খেতে পেতো না এগুলো নদী থেকে আসতো। কিন্তু বর্তমানে অনেকেই এসব মাছ খেতে চায় না। এছাড়া সামাজিকভাবে পরিবার ব্যবস্থা ভাঙছে। জয়েন্ট ফ্যামিলি থাকছে না। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি হচ্ছে, দেরি করে মানুষ বিয়ে করছে, সময় নিয়ে বাচ্চা নিচ্ছে। আবার বেশি শিশু নেওয়ার বিষয়টি নিয়েও ভাবছে।
এএএম/এমএএইচ/জিকেএস