ক্যাম্পাস

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী-প্রতিবন্ধীদের চাকরির ক্ষেত্রে কোটা থাকা জরুরি

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশজুড়ে সড়ক-মহাসড়ক এবং রেলপথ অবরোধ করে আন্দোলন করে আসছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। শুরুর দিকে শিক্ষার্থীরা চারদফা দাবিতে আন্দোলন করলেও এখন তা ঠেকেছে একদফায়। পালিত হচ্ছে মানববন্ধন, সমাবেশ, বিক্ষোভ ও বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি। কোটা ইস্যুতে নিজেদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন শিক্ষকরাও।

Advertisement

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) চার অধ্যাপকের সঙ্গে কথা বলেছে জাগো নিউজ। চলমান এ ইস্যুতে তারা তাদের মতামত তুলে ধরেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা। যেকোনো ধরনের কোটাব্যবস্থা সমাজে বৈষম্য বাড়ায়। বড়লাটের সন্তান বড়লাট অথবা রাজার সন্তান রাজা—এটা কোনো সভ্য সমাজের সংস্কৃতি হতে পারে না। বৈষম্যহীন সমাজে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকবে। রাজার সন্তান রাজা হতে পারবে কিন্তু সেটা হতে হবে তার নিজের অর্জনে, রাজার কোটায় নয়। সব অর্থে এবং সব পর্যায়ে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার দাবি জানাই।’

একই বিভাগের অধ্যাপক ড. পারভীন জলী বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে কোটা বাতিলের পক্ষে নই, সংস্কারের পক্ষে। এদেশের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী, দলিত, চা শ্রমিক ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাকরির ক্ষেত্রে কোটা থাকা জরুরি। বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরাও কোটার আওতাভুক্ত হতে পারেন। তবে তাকে অবশ্যই সমাজের অনগ্রসর জনগোষ্ঠী থেকে আসতে হবে। সংবিধানে নাগরিকদের অনগ্রসর অংশকে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ বিধানের কথা বলা আছে। তবে বিশেষ বিধানের মাধ্যমে প্রদত্ত সুযোগ যদি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যারা টিকবেন তাদের চাইতে বেশি হয় তা কোনোভাবেই একটি দেশে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করে না।’

Advertisement

৫৬ শতাংশ কোটার ব্যবস্থা বিপুলসংখ্যক মেধাবী শিক্ষার্থীকে প্রজাতন্ত্রে কাজ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে বলে মন্তব্য করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘এটি স্পষ্ট যে, সরকারি চাকরিতে ব্যাপক হারে কোটাব্যবস্থা জারি থাকলে, এ রাষ্ট্র মেধাশূন্য হয়ে পড়বে। কোটা থাকবে কি থাকবে না, নাকি সংস্কার হবে—এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার সংবিধান সরকারকে দিয়েছে। তাই এ বৈষম্য দূর করার দায়িত্বও সরকারকেই নিতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’

নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আকবর হোসেন বলেন, ‘কোটা ভিত্তিতে সরকারি চাকরিপ্রার্থী বনাম মেধাভিত্তিতে সরকারি চাকরিপ্রার্থী এখন পরস্পর বিরোধী হয়ে রাজপথে অবস্থান নিয়েছেন। এক্ষেত্রে কিছু বিষয় ভেবে দেখা প্রয়োজন। তা হলো মুক্তিযোদ্ধারা নিঃসন্দেহে দেশপ্রেমিক ছিলেন। তারা নিজের পরিবার ও ছেলেমেয়েদের জন্য যুদ্ধ করেননি। তারা দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন। কোটা ব্যবস্থা রাখা হয় অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপের সম্পৃক্ত করার জন্য। দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার অনগ্রসর—এরকম ভাবনা কোনো জাতিই ভাবতে পারে না। অন্যদিকে কোটা হচ্ছে সরাসরি মেধার বিপরীতে। ফলে কোটাধারী অর্থাৎ মেধাহীন ব্যক্তিকে সরকারি চাকরির প্রথম শ্রেণির/ক্যাডারগুলোতে না দিয়ে তৃতীয় বা চতুর্থ পর্যায়ের/শ্রেণির চাকরিগুলোতে নিয়োগ করলে রাষ্ট্র যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না তেমন কোটাধারীরাও পারিবারিকভাবে উপকৃত হবেন।’

তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান কিংবা নাতি-নাতনিরা মেধাহীন নয়। তারা কি এতই অযোগ্য এবং মেধাহীন যে, তারা মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকরির বিরোধিতা করছেন? মেধা এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরির বিপক্ষে তাদের অবস্থান দেশপ্রেমের পরিচয় বহন করে না। মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকরি পাওয়া দেশের আগামী দিনের নাগরিকের জন্য অধিকার, যোগ্যতাকে প্রাধান্য দেওয়া, প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকার জন্য দক্ষ জনশক্তিকে নিয়োগ দেওয়া এবং সর্বোপরি দেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রশ্ন।’

‘বাংলাদেশের সামাজিক এবং পারিবারিক প্রেক্ষাপটে এমন বিষয় ভাবা খুব কঠিন যে, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলো আত্মীয়তার ক্ষেত্রে কেবলমাত্র অন্য মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সঙ্গে করেছে। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানের প্রজন্ম এবং নাতি-নাতনি প্রজন্মের ক্ষেত্রে পরিচিতি ভিন্ন হতে পারে। কোটাধারী যে কারও নানা-নানি, দাদা-দাদির মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ এবং অমুক্তিযোদ্ধা থাকতে পারে। তাহলে তিনি শুধু সুবিধার অংশটুকুই নেবেন এবং বাকি অংশটুকু সমাজ নিরপেক্ষ হবেন অথবা অস্বীকার করবেন কীভাবে?’, যোগ করেন অধ্যাপক ড. আকবর হোসেন।

Advertisement

ইতিহাস বিভাগের আরেক অধ্যাপক সুলতানা আক্তার বলেন, ‘জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্য যে কোটা ব্যবস্থার পুনর্বহাল করা হচ্ছে আমি তার প্রতিবাদ জানাই। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ হওয়া দরকার। আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান করি। তাদের সন্তান পর্যন্ত কোটা বহাল রাখা হোক। কিন্তু নাতি-নাতনি পর্যন্ত সেটি হতে পারে না। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে আমি একাত্মতা প্রকাশ করছি।’

এসআর/জেআইএম