জাতীয়

যেভাবে ফাঁস হতো পিএসসির প্রশ্ন

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) প্রশ্নফাঁস নিয়ে বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল। একযুগে ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসে জড়িত ছিলেন বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) তিন কর্মকর্তা। তারা ব্যবহার করতেন অফিস সহায়ক, গাড়ি চালকদের। এভাবে লুটে নিতেন কোটি কোটি টাকা।

Advertisement

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্তে উঠে এসেছে অনেক হাইপ্রোফাইলের নামও। পিএসসির উপ-পরিচালক মো. আবু জাফর ও মো. জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির প্রশ্নফাঁসের মূলহোতা। তারা ব্যবহার করতেন অফিস সহায়ক খলিলুর রহমান ও অফিস সহায়ক (ডিসপাস) সাজেদুল ইসলামকে।

আরও পড়ুনপ্রশ্নফাঁসে গ্রেফতার পিএসসির ৫ কর্মকর্তা-কর্মচারী বরখাস্তপিএসসির প্রশ্নফাঁস: আবেদ আলীসহ ছয়জনের দায় স্বীকারপ্রশ্নফাঁস: আবেদ আলীসহ ১৭ জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ

সিআইডির তথ্যমতে, পিএসসির উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর, জাফর ও সহকারী পরিচালক আলমগীর প্রশ্নফাঁস করতেন। এরপর খলিলুর রহমান ও সাজেদুল ইসলামের মাধ্যমে চাকরিপ্রার্থীদের প্রশ্ন সরবরাহ করতেন। মোটা অঙ্কের টাকা বিনিময়ে পরীক্ষার্থীদের বাসায় এনে উত্তরপত্র পড়াতেন তারা। আর পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যানের গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী টাকা লেনদেন ও প্রশ্নফাঁসের বুথ পরিচালনা করতেন।

সিআইডি বলছে, পিএসসির কোনো নিয়োগ পরীক্ষা এলেই চক্রের সদস্যরা প্রশ্নফাঁস করে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতেন। গত ৫ জুলাই রেলওয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস করেন তারা। চুক্তি অনুযায়ী পরীক্ষার আগের রাতে পরীক্ষার্থীদের বাসায় এনে প্রশ্ন ও উত্তরপত্র দিয়েছেন। তদন্তে এখন পর্যন্ত অনেকের নাম সামনে এসেছে। তাদের মধ্যে হাইপ্রোফাইল ব্যক্তিও রয়েছে। সবার তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় হবে।

Advertisement

বিসিএসসহ পিএসসির অধীনে অনুষ্ঠিত ‘বিসিএস প্রিলি–লিখিতসহ গুরুত্বপূর্ণ ৩০ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস’ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে বিষয়টি দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরপর সোমবার (৮ জুলাই) রাতে বিপিএসসির তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। রাতেই রাজধানীর পল্টন থানায় বিপিএসসি আইনে মামলাটি দায়ের করেন সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের সাইবার ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশনস বিভাগের উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এসআই) নিপ্পন চন্দ্র চন্দ। মামলায় ৩১ জনের নামোল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৫০/৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে গ্রেফতার ১৭ জনকে আজ আদালতে হাজির করা হয়েছে।

গ্রেফতারদের পরিচয় ও পেশা

মামলার এক নম্বর আসামি সৈয়দ আবেদ আলী (৫২)। তিনি রেন্ট-এ কার ব্যবসায়ী। তবে তিনি দীর্ঘদিন পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যানের গাড়িচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দুই নম্বর আসামি নোমান সিদ্দিক (৪৪)। লক্ষ্মীপুরের রামগতি এলাকার বাসিন্দা নোমান থাকতেন মিরপুর-১০ সেনপাড়া পর্বতা এলাকায়। পেশায় তিনি গার্মেন্টস (পোশাক) ব্যবসায়ী। তিন নম্বর আসামি খলিলুর রহমান (৩৮)। চার নম্বর আসামি মো. সাজেদুল ইসলাম (৪১)। পাঁচ নম্বর আসামি আবু সোলেমান মো. সোহেল (৩৫)। তিনি মিরপুর ইসিবি চত্বরের ডেভেলপার ব্যবসায়ী। ছয় নম্বর আসামি পিএসসির উপ-পরিচালক (সিলেট) জাহাঙ্গীর আলম (৫৮)। সাত নম্বর আসামি পিএসসির সহকারী পরিচালক এসএম আলমগীর কবীর (৪৯)। আট নম্বর আসামি গাজীপুর সেনানিবাসের অডিটর প্রিয়নাথ রায় (৫১)। নয় নম্বর আসামি মিরপুরের জাহিদুল ইসলাম (২৭)। দশ নম্বর আসামি পিএসসির উপ-পরিচালক মো. আবু জাফর (৫৭)।

বাকি আসামিরা হলেন- নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত হোসেন, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত মো. মামুনুর রশীদ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিকেল টেকনিশিয়ান মো. নিয়ামুল হাসান, ব্যবসায়ী সহোদর সাখাওয়াত হোসেন ও সায়েম হোসেন এবং একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র লিটন সরকার ও সৈয়দ আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম।

এখনো যারা পলাতক

পিএসসির সাবেক সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায়, শরীফুল ইসলাম ভূঁইয়া, দীপক বনিক, খোরশেদ আলম খোকন, কাজী মো. সুমন, এ কে এম গোলাম পারভেজ, মেহেদী হাসান খান, গোলাম হামিদুর রহমান, মুহা. মিজানুর রহমান, আতিকুল ইসলাম, এটিএম মোস্তফা, মাহফুজ কালু, আসলাম ও কৌশিক দেবনাথ।

Advertisement

সিআইডি জানায়, গত ৫ জুলাই পিএসসির আয়োজিত রেলওয়ের সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারের (নন ক্যাডার) নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন হুবহু ফাঁস হয়েছে। পরীক্ষার নির্ধারিত সময়ের আগে চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন এবং উত্তর বিতরণ করেছে একটি সংঘবদ্ধচক্র।

যেভাবে শুরু সিআইডির অভিযান

গোপন তথ্য ও প্রযুক্তির সহায়তায় রাজধানীর শ্যামলী, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, মতিঝিল, বসুন্ধরাসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে আসামিদের অবস্থানের তথ্য পায় সিআইডি। এরপর তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় গত ৭ জুলাই রাতে রাজধানীর শ্যামলী এলাকা থেকে প্রথমে লিটন সরকারকে গ্রেফতার করা হয়।

লিটনকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে সিআইডিকে জানায়, তার সহযোগী প্রিয়নাথ ও জাহিদের কাছ থেকে তিনি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পেতেন। প্রশ্ন ও উত্তরের বিনিময়ে তাদের টাকা দিতেন।

তার তথ্যের ভিত্তিতে একই রাতে মহাখালী এসকেএস টাওয়ারের ফুডভিলা হোটেল থেকে প্রিয়নাথ রায়কে গ্রেফতার করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তিনি অভিযুক্ত জাহিদের কাছ থেকে প্রশ্নপত্র পেতেন। প্রশ্ন ও উত্তরের বিনিময়ে তিনিও নিদিষ্ট পরিমাণে টাকা জাহিদুলকে দিতেন।

  আরও পড়ুনপ্রশ্নফাঁস: পিএসসির তিন কর্মকর্তাসহ কারাগারে ১১ জনআবেদ আলীর অভ্যাসই ‘অপকর্মে জড়ানো’দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিতে সম্মত আবেদ আলীসহ ৭ জন  

এরপর ওই রাতেই শ্যামলী এলাকা থেকে জাহিদুলকে গ্রেফতার করে সিআইডি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তার পরিচিত রংপুর জেলার সুমনের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র জোগাড় করতেন তিনি। জাহিদ টাকার একটা বড় অংশ সুমনকে দিতেন।

এরপর চক্রের সক্রিয় সদস্য নোমান সিদ্দিকীকে মিরপুর-১০ এলাকার নিজ ফ্ল্যাট থেকে গ্রেফতার করা হয়। প্রশ্নফাঁসে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেন সোমান। তার প্রাথমিক স্বীকারোক্তিতে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় পিএসসির উপ-পরিচালক (সিলেট) জাহাঙ্গীর আলমকে। এরপর পর্যায়ক্রমে শাহাদাত হোসেনকে মিরপুর থেকে, শেরেবাংলা নগর এলাকা থেকে মামুন ও নিয়ামুলকে গ্রেফতার করা হয়।

যেভাবে চক্রের মূলহোতার নাম উঠে আসে

খলিলই গত ৫ জুলাই রেলওয়ের নিয়োগ পরীক্ষা সবাইকে সরবরাহ করেছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছেন। এমন তথ্যের ভিত্তিতে মিরপুর পীরেরবাগে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে সিআইডি।

খলিলকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তাকে এসব পরীক্ষার প্রশ্ন সরবরাহ করতেন পিএসসির সহকারী পরিচালক আলমগীর। তিনি রেলওয়েসহ দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছেন। গতকাল ৮ জুলাই ভোর সাড়ে ৪টার দিকে মিরপুর এলাকার সরকারি আবাসন থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলামের নাম উঠে আসে।

গ্রেফতার সাজেদুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করতেন পিএসসির উপ-পরিচালক আবু জাফর। তার মাধ্যমে ফাঁস করা প্রশ্ন সংগ্রহ করতেন তিনি। এরপর সহযোগী সাখাওয়াত ও সিদ্ধেশ্বরী কলেজের শিক্ষার্থী সাইম হোসেনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে চাকরিপ্রার্থী সংগ্রহ করে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় ভাড়াবাসা বা হোটেলে জড়ো করতেন তিনি।

নিয়োগ পরীক্ষার এক-দুদিন আগে অর্থের বিনিময়ে হুবহু প্রশ্ন ও উত্তরপত্র বিতরণ করতেন সাজেদুল। একই কায়দায় গত ৫ জুলাই রেলওয়ের নিয়োগ পরীক্ষার জন্য পল্টন এবং খিলগাঁও এলাকার ভাড়াবাসায় চাকরিপ্রার্থীদের নিয়ে প্রশ্ন ও উত্তরপত্র দেন নিয়ামুল।

যেভাবে সামনে আসে গাড়িচালক আবেদ আলীর নাম

আটক সাজেদুল ইসলামের বক্তব্যে উঠে আসে পিএসসি সাবেক চেয়ারম্যানের গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর নাম। সহযোগীদের মাধ্যমে চাকরিপ্রত্যাশীদের সংগ্রহ করার পাশাপাশি টাকার বিনিময়ে আবেদ আলীর কাছে রেলওয়ের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন এবং উত্তর বিতরণ করা হয়।

সাজেদুলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সাখাওয়াত হোসেন ও সায়েম হোসেনকে মতিঝিলের এজিবি কলোনির বাসা থেকে এবং সৈয়দ আবেদ আলীকে শেওড়াপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয়। একই সঙ্গে আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়ামকেও গ্রেফতার করে সিআইডি।

সৈয়দ আবেদ আলীর বক্তব্যে উঠে আসে আবু সোলেমান মো. সোহেলের নাম। তিনি রেলওয়ের নিয়োগ পরীক্ষার জন্য প্রার্থী সরবরাহ করেছেন।

আরও পড়ুনআবেদপুত্রের ফেসবুক পোস্ট: ‘প্রতিশোধের চেয়ে উত্তম সবর ও দুআ’প্রশ্নফাঁসে জড়িতদের নিয়ে চারদিকে হইচই

তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, রেলওয়ের নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ের আগেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং বিতরণ কাজে জড়িত ছিলেন পলাতক ১৪ আসামিসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৫০/৬০ জন। আসামিরা একটি সংঘবদ্ধচক্র হিসেবে বিগত বছরগুলোতে বিসিএসসহ পিএসসির বিভিন্ন গ্রেডের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র অর্থের বিনিময়ে ফাঁস করতেন।

জানতে চাইলে সিআইডির তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, প্রশ্নফাঁসে অভিযুক্ত পিএসসির উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর, জাফর ও সহকারী পরিচালক আলমগীর নিজেরা প্রশ্নফাঁস করতেন। এরপর অফিস সহকারী সাজেদুল, খলিলদের মাধ্যমে প্রশ্ন সরবরাহ করতেন। বাসায় ডেকে প্রার্থীদের তা পড়ানো হতো। নেওয়া হতো মোটা অঙ্কের টাকা। এখানে সৈয়দ আবেদ আলী লেনদেন ও প্রশ্নফাঁসের বুথ পরিচালনা করতেন।

তিনি জানান, এখন পর্যন্ত তদন্তে আরও অনেকের নাম পেয়েছি। হাইপ্রোফাইল কিছু নামও সামনে আসছে। সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে।

সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) বিশেষ পুলিশ সুপার মো. তৌহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, মামলায় এখন পর্যন্ত ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সাবেক পিএসসি চেয়ারম্যানের গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ সাতজন দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। গ্রেফতারদের থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত নিয়ে যাচাই-বাছাই চলছে। এ চক্রের সঙ্গে আরও যারা জড়িত রয়েছেন প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে।

টিটি/এমএএইচ/এএসএম