যুক্তরাজ্যে নতুন সরকার গঠন করেছে লেবারপার্টি। দীর্ঘ ১৪ বছর পর ক্ষমতায় বসলো দলটি। যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক স্বাধীনতার সময় থেকেই। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশটি বাংলাদেশের পক্ষ নেয়। পালিয়ে যাওয়া কূটনীতিকদের আশ্রয়ও দেয়। অভিবাসীবান্ধব নতুন এ সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সেই সম্পর্ক বহুমাত্রিক রূপ পাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
Advertisement
পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্যে সর্বাধিক প্রবাসী বাংলাদেশির বাস। প্রায় পাঁচ লাখেরও বেশি বাঙালি সেখানে বসবাস করেন। যে কারণে দেশটির অভিবাসন নীতি ও সরকার টু সরকারের সম্পর্কের দিকে সবার নজরও বেশি। যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কেরও অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। আমদানি কমে গত এক দশকে রপ্তানি বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি।
জানা যায়, ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ যুক্তরাজ্যে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে এবং যুক্তরাজ্য থেকে পণ্য ও সেবা আমদানি করে ২ বিলিয়ন ডলারের। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসে দুই দেশের মোট আমদানি-রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলারে। তবে এই সময়ে রপ্তানি দ্বিগুণের বেশি হয়ে কমেছে আমদানি। ৫ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলারে মধ্যে আমদানি মাত্র ৪১৫ দশমিক ৩২ মিলিয়ন ডলার।
আরও পড়ুন
Advertisement
যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত সাবেক হাই কমিশনার, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও অভিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নতুন সরকার ও তাদের দল অভিবাসীবান্ধব। এমনিতেই দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ইতিবাচক ও প্রশংসনীয়। পাশাপাশি দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কও ভালো।
এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার মো. আব্দুল হান্নান জাগো নিউজকে বলেন, ‘নিশ্চিতভাবে বলা যায়, নতুন সরকার অভিবাসনের পক্ষেই থাকবে। বরাবরই লেবার পার্টি অভিবাসনের পক্ষে ছিল। অনেককে নাগরিকত্ব দিয়েছে। লেবার পার্টির নেতৃত্বে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্কের আরও উন্নয়ন ঘটবে। কনজারভেটিভ পার্টির সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো ছিল।’
নিশ্চিতভাবে বলা যায়, নতুন সরকার অভিবাসনের পক্ষেই থাকবে। বরাবরই লেবার পার্টি অভিবাসনের পক্ষে ছিল। লেবার পার্টির নেতৃত্বে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্কের আরও উন্নয়ন ঘটবে। কনজারভেটিভ পার্টির সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো ছিল।- যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার মো. আব্দুল হান্নান
‘লেবার পার্টিতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অভিবাসীরা সংখ্যায় অধিক। চারজন নারী এমপি নির্বাচিত হওয়া অত্যন্ত ইতিবাচক দিক। রৌশনারা আলী এমপি, কনজারভেটিভ সরকারের সময়ও যুক্তরাজ্য -বাংলাদেশ বাণিজ্য প্রসারে নেতৃত্ব দেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সম্পর্কও খুব ভালো। আশা করা যায়, যুক্তরাজ্যের নতুন সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের বহুমাত্রিক উন্নয়ন হবে।’
Advertisement
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘যুক্তরাজ্যের সরকার পরিবর্তনে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের তেমন পরিবর্তন হবে বলে আমার মনে হয় না। এমনিতেই চারজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি হয়েছেন। অনেকের আশা, তাদের এক-দুজন বড় পদও পেতে পারেন, সেটা দেখা যাক হয় কি না। তবে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার মতো কিছু নেই।’
তিনি বলেন, ‘অভিবাসী বিষয়টি তো সব দেশের, শুধু বাংলাদেশের বিষয় নয়। তারপরও তেমন পরিবর্তন হওয়ার কারণ দেখি না। যেহেতু পশ্চিমা দেশ, এদের মধ্যে ডানপন্থি কাঠামো তৈরি হচ্ছে ধীরে ধীরে। সেটা একটু চিন্তার ব্যাপার। কনজারভেটিভ পার্টির অনেক পলিসি লেবার পার্টিও ধারণ করছে।’
যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক হাসান আল জাভেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র উত্তরণে যুক্তরাজ্য কোন পথে যাবে, এটা বলা মুশকিল। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশের সঙ্গে অ্যাসাইলাম সিকারদের নিয়ে করা ফার্স্টট্র্যাক চুক্তির পরিবর্তন নাও আসতে পারে। কারণ যুক্তরাজ্যসহ অধিকাংশ উন্নত দেশই চায় আনডকুমেন্টেড বা যারা আইনের সবগুলো ধাপে হেরে এদেশে থাকার বৈধতা হারিয়েছে তাদের ফেরত পাঠাতে। বাংলাদেশের সঙ্গে এই চুক্তিতে নতুন কিছু নেই, শুধু প্রসেসিং দ্রুত হবে।’
তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে নতুন সরকার রুয়ান্ডা বিল (সাগরপথে যারা এসেছে তাদের রুয়ান্ডা পাঠানোর চুক্তি) বাতিল ঘোষণা করেছে। দলটি অভিবাসীদের ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয় হলেও বড় পরিবর্তন আসবে না। কারণ কেউই বাড়তি অভিবাসী বা আনডকুমেন্টেডদের চাপ নেবে না।’
যুক্তরাজ্যের সরকার পরিবর্তনে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের তেমন পরিবর্তন হবে বলে আমার মনে হয় না। এমনিতেই চারজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি হয়েছেন। অনেকের আশা, তাদের এক-দুজন বড় পদও পেতে পারেন, সেটা দেখা যাক হয় কি না। তবে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার মতো কিছু নেই।- অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ
যুক্তরাজ্য প্রবাসী আরেক সাংবাদিক শাহেদ শফিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘যুক্তরাজ্যের নতুন সরকার বলেছে তারা অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর যে চুক্তি রয়েছে সেটি বাস্তবায়ন করবে। এতে দুই দেশের সম্পর্ক আরও গভীর হবে।’
তিনি বলেন, ‘লেবার পার্টির মূলনীতিই অভিবাসনবান্ধব। তবে অভিবাসনপ্রত্যাশীরা যাতে নতুন করে যুক্তরাজ্যে ভিড় করতে না পারে সেজন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে তারা। সুনাক সরকারের বিতর্কিত রুয়ান্ডা নীতি বাতিল ঘোষণা করেছে। অভিবাসন নিয়ে যাই করুক না কেন এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘন করে কোনো কিছু করতে পারবে না যুক্তরাজ্য সরকার।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের আগে লেবারপার্টি প্রধান বাংলাদেশিদের নিয়ে যে বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন, সেটির ব্যাখ্যাও দিয়েছে দলটি। মূলত অবৈধভাবে যারা বসবাস করছেন তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়েই তিনি ওই মন্তব্য করেন। বিষয়টি কেন্দ্র করে বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যে বিশাল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। অনেকেই প্রচার করেন লেবার নেতা বাংলাদেশকে খাটো করেছেন। এর কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের কোনো অবনতি হবে বলে মনে করি না।’
ব্রিটেনে সংসদের নিম্নকক্ষ হাউজ অব কমন্সে মোট আসন সংখ্যা ৬৫০টি। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ৩২৬টি আসনে বিজয়ী হতে হয়। প্রাপ্ত ফলাফলে লেবার পার্টি ৪১২টি আসনে জয় পেয়েছে। আর কনজারভেটিভ পার্টির ঘরে গেছে ১২১টি আসন।
জয়ের পরেই লেবার নেতা কিয়ের স্টারমারকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন রাজা চার্লস। পরে সরকার গঠন করে তার দল।
এসইউজে/এএসএ/এমএস