২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে মূল দাবি ছিল ক্যাডার সার্ভিসে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করা। তখন পুরো কোটা পদ্ধতিই বাতিল করে পরিপত্র জারি করেছিল সরকার। সম্প্রতি সেই পরিপত্রটি ‘অবৈধ’ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এরপরই ছয় বছর আগের সেই পরিপত্রটি পুনর্বহালসহ চার দফা দাবিতে আন্দোলনে নামেন কোটাবিরোধীরা। এরই মধ্যে শিক্ষার্থীদের সেই আন্দোলন ঢাকাসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
Advertisement
হাইকোর্টের রায়ে পুরো কোটা প্রথা বহাল, নাকি শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ কোটা বহাল রাখা হয়েছে তা নিয়েও জল্পনা বাড়ছে। পূর্ণাঙ্গ রায়ে ২০১৮ সালের পুরো গেজেটটি বাতিল করা হয়েছে নাকি আংশিক সংশোধন করে শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখা হয়েছে, সেটিও এখন বড় প্রশ্ন।
তবে সরকারি চাকরির নিয়োগে শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটা, নাকি আগের মতো সব কোটাই ফিরছে, সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্বাধীনতার পর সংবিধান প্রণয়নের আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা প্রবর্তন করা হয়। এটি চলমান অবস্থায় ২০১৮ সালে সরকার পরিপত্রের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ শতাংশ কোটা নবম থেকে ১৩তম গ্রেডের ক্ষেত্রে বাতিল করে দেয়। এটি অপমানজনক।- আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী
Advertisement
সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত বা আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন করপোরেশনে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একটি রিট করা হয়েছিল। যার চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে গত ৫ জুন হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করেন।
আরও পড়ুন কী ছিল আলোচিত ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপনে? কোটা বণ্টনে সংস্কার জরুরি, সমাধানের সূত্র সরকারের হাতেই যেভাবে বাতিল হয়েছিল কোটারাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মুহাম্মদ (এসকে) সাইফুজ্জামান জামান জাগো নিউজকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের ঘোষিত রায়ে সব কোটা ফিরছে বলে প্রতীয়মান হয়। তবে সব কোটা, নাকি শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফিরছে, তা হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে বলা যাবে।
তিনি বলেন, ওরা (রিটকারীপক্ষ) তো চ্যালেঞ্জ করেছে ২০১৮ সলের গেজেট। যে গেজেটে মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ অন্য সব কোটা বাতিল করে গেজেট জারি করা হয়েছিল। ওই গেজেটটি চ্যালেঞ্জ করে রিট করা হয়েছে। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, ‘দ্য কোটা মাস্ট বি ফলো’। যদি কোটা ফুলফিল না হয় তাহলে পদগুলো রিজার্ভ থাকবে।
হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশেল আগে এ নিয়ে বিশেষ কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে বলেও জানান এসকে জামান।
Advertisement
পরিপত্র পুনর্বহালসহ যে চার দফা দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা সেই দাবিগুলো হলো- (১) ২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখা; (২) ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারি চাকরিতে (সকল গ্রেডে) অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দেওয়া এবং সংবিধান অনুযায়ী শুধু অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করা; (৩) সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না এবং কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া এবং (৪) দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।
সরকারি চাকরিতে স্বাধীনতার পর থেকেই কোটা ছিল। বিভিন্ন সময় তা কমে এবং বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮ সালে এসে তা দাঁড়ায় ৫৬ শতাংশে। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা, ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এবং ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা। শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছিল। পরে এ কোটায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং তারপর নাতি-নাতনি যুক্ত করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের ঘোষিত রায়ে সব কোটা ফিরছে বলে প্রতীয়মান হয়। তবে সব কোটা, নাকি শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফিরছে, তা হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে বলা যাবে।- ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল
এ কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে ২০১৮ সালে আন্দোলনে নামে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। আন্দোলনের একপর্যায়ে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে নবম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত কোটাপদ্ধতি তুলে দেয় সরকার। এ বিষয়ে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পরিপত্র জারি করে।
এ পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে রিট করেন চাকরিপ্রত্যাশী ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। অহিদুল জাগো নিউজকে বলেন, ২০১৮ সালের ওই পরিপত্রের আগে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ সব মিলিয়ে ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল। ২০১৩ সালে আপিল বিভাগের এক রায়ে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংরক্ষণ ও তা যথাযথভাবে অনুসরণ করতে বলা হয়। এ রায় থাকা সত্ত্বেও কোটা পদ্ধতি বাতিল সংক্রান্ত পরিপত্রের বৈধতা নিয়ে রিট করা হয়।
‘নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের জন্য রিটটি করেছিলেন তারা। এখন হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে’- বলেন অহিদুল ইসলাম।
সরকারের জারি করা পরিপত্র অনুযায়ী, নবম গ্রেড এবং দশম থেকে ১৩তম গ্রেডের ক্ষেত্রে মেধাভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়। একই সঙ্গে এসব গ্রেডে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হয়। প্রসঙ্গত, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে (১৪তম থেকে ২০তম গ্রেড) কোটা পদ্ধতি বহাল রয়েছে।
সরকারের এ পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে করা রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল জারি করেন। রুলে পরিপত্রের পাশাপাশি এর আগে দেওয়া হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের আদেশ প্রতিপালন না করা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাপ্য অধিকারের প্রতি অবজ্ঞার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করা হয়।
আরও পড়ুন কোটা বাতিলের পর সরকারি নিয়োগে নারীর অবস্থান কোথায়? ১২ বছরে সব নিয়োগ পরীক্ষা সুষ্ঠু হয়েছে, এটি প্রমাণিত: পিএসসি বিসিএসে নারীরা পিছিয়ে নয় বরং এগিয়ে যাচ্ছে: জনপ্রশাসনমন্ত্রীগত ৫ জুন হাইকোর্ট রায় ঘোষণার পর রিটকারী পক্ষের আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে আর কোনো বাধা থাকলো না। স্বাধীনতার পর সংবিধান প্রণয়নের আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা প্রবর্তন করা হয়। এটি চলমান অবস্থায় ২০১৮ সালে সরকার পরিপত্রের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ শতাংশ কোটা নবম থেকে ১৩তম গ্রেডের ক্ষেত্রে বাতিল করে দেয়। এটি অপমানজনক।
সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে ৩০ শতাংশ কোটা বাস্তবায়ন করার বিষয়টি স্পষ্টতই উল্লেখ রয়েছে বলেও জানান তিনি।
কোটা পদ্ধতি পুনর্বহালের বিষয়ে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে, যা গত ৯ জুন চেম্বার আদালতে ওঠে। ওইদিন আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত আবেদনটি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে ৪ জুলাই শুনানির জন্য নির্ধারণ করেন। নির্ধারিত দিনে আপিল বিভাগে রিটকারীপক্ষ একদিনের সময় চেয়ে আর্জি জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৪ জুলাই আপিল বিভাগ ‘নট টুডে’ মর্মে আদেশ দেন।
আপিল বিভাগের আদেশের বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এএম) আমিন উদ্দিন সোমবার (৮ জুলাই) সাংবাদিকদের বলেন, আপিল বিভাগে গত সপ্তাহে কোটা নিয়ে দায়ের করা আপিলের শুনানি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওইদিন আদালত হাইকোর্টের রায় প্রকাশ করার পর এ বিষয়ে শুনানি করতে চেয়ে ‘নট টুডে’ আদেশ দেন। আমরা আশা করছি, আগামী বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে আপিল বিভাগে শুনানি হতে পারে। কিন্তু এর আগে যদি (বুধবার) পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ পায় তাহলে আমরা আপিল বিভাগকে জানাতে পারবো।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা আরও বলেন, আদালত (হাইকোর্ট) আদেশ (কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা) দিয়েছেন। সরকার সে আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে গিয়েছে। ফলে এ মুহূর্তে যে আন্দোলনটা (কোটাবিরোধীদের) চলছে, আমি মনে করি এটা না করাই উচিত হবে।
কোটাবিরোধী চলমান আন্দোলন নিয়ে এক প্রশ্নে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি সরকারের পক্ষ থেকে এ মামলাটা করেছি। আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি না। আগে রায়টা পাই, আমরা অবশ্যই দেখবো। আমরা শুধু আইনগত বিষয়টি দেখছিলাম। এটি সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত। এখানে আদালত কতটুকু হস্তক্ষেপ করতে পারে সেটাই আমরা আদালতের সামনে তুলে ধরেছি। পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো।
এফএইচ/এমকেআর/জিকেএস