প্রবাস

এক মেসবাড়ির গল্প

পান্থনিবাস বোর্ডিং হাউস, ১১-বি কাঁঠাল বাগান লেন (দোতালা) ঢাকা-৯। ছোট কলেবরের উপন্যাসটির শুরু হয়েছে ঠিকানাটা দিয়ে কারণ গল্পটা এখানে যারা বাস করে তাদের নিয়েই। ছোট একটা মেসবাড়ি আর তার সভ্যদের নিয়ে এগিয়ে চলেছে কাহিনি। শুরুতেই এই মেসবাড়ির বর্ণনা দিয়েছেন লেখক। চিঠি লিখলে এই ঠিকানায় চিঠি আসে। খুঁজে বের করতে গেলেই মুশকিল।

Advertisement

দু’জন মানুষ পাশাপাশি চলতে পারে না। এ রকম একটা গলির পাশে ঘুপচি ধরনের দোতলা বাড়ি। কত দিনের পুরনো বাড়ি সেটি কে জানে। চিতি পরে সমস্ত বাড়ি কালচে সবুজ বর্ণ ধারণ করেছে। দোতলায় একটি ভাঙা জানালায় ছেড়া চট ঝুলছে। বাড়িটির ডান পাশের দেয়ালের একটি অংশ সম্পূর্ণ ধসে গিয়েছে। সামনের নর্দমায় একটি মরা বেড়াল; দূষিত গন্ধ আসছে সেখান থেকে।

পান্থ নিবাস বোর্ডিং হাউসের সদস্যরা হলেন- সফিক, নিশানাথ জ্যোতির্ষাণব, নবী সাহেব, আজীজ সাহেব, করিম সাহেব, সিরাজ সাহেব, সুলতান উদ্দিন প্রমুখ। আর শেষে এসে যোগ দেয় রঞ্জু যার জবানিতে আমরা এই মেসবাড়ির সদস্যদের নিত্যকার দিনের গল্পগুলো শুনি। এই মাসির পরতে পরতে কল গল্প লুকিয়ে আছে। কারো আছে স্বপ্নের গল্প। আবার কারো আছে স্বপ্ন ভঙ্গের গল্প। তবুও তাদের দিন কেটে যায়। এই মেসবাড়ির ম্যানেজার রশীদ মিয়া। লোকটি ছোটখাটো। সামনের দুটি দাঁত সোনা দিয়ে বঁধানো। সেই দাঁত দুটি ছাড়া আর সমস্ত দাঁতে কুৎসিত হলুদ রঙ। আর কাদের এই মেসের বাবুর্চি-টাবুর্চি হবে।

পরিবারের আদুরে ছেলে ছিল সফিক। কী যে ক্যাবলা ছিল। ক্লাস ফোরে পড়া ছেলে মায়ের হাত ছাড়া খেতে পারতো না! চমৎকার চেহারা ছিল সফিকের। স্কুলে থাকতে ‘মুকুট’ নাটকে অভিনয় করেছিল। সে হয়েছিল মধ্যম রাজকুমার। সত্যিকার রাজপুত্রের মতো লাগছিল সেদিন তাকে। কমিশনার সাহেবের বৌ তাকে ডেকে পাঠিয়ে কত কি বলেছিলেন। সেই সফিক বড় বদলে গেছে। তার শরীর খুব খারাপ হয়েছে। রঞ্জু প্রথম দেখে চিনতেই পারেনি। এখন তাকে দেশে থাকা মা ও ছোট বোন অনুর জন্য টাকা পাঠাতে হয় নিয়মিত। সেটা করতে গিয়ে তাকে এমন অনেক কাজ করতে হয় যেটা কল্পনারও বাইরে। একটা সময় সুচেব ব্যবসা পর্যন্ত করতে হয়েছে। সেটা ছিল খুব লাভের ব্যবসা। পাঁচ টাকার সুচে দশ টাকা লাভ হতো। সেটা করতে গিয়ে একদিন তার ক্লাসের একটা মেয়ে আভার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখে একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটিই তাকে কম্পোজিটারের একটা চাকরি জোগাড় করে দিয়েছিল। অবশ্য সেটাও বেশিদিন করতে পারেনি।

Advertisement

এরপর লালুর সাথে সস্তা দরে দোকান থেকে কাটা কাপড়ের পিস কিনে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বিক্রি পর্যন্ত করেছে। এভাবেই সে নিজেকে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তার স্বপ্ন সে রঞ্জুকে নিয়ে ‘নীলগঞ্জ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’ নামে একটা চায়ের দোকান দেবে। নিশানাথ হবে তার ম্যানেজার।

নিশানাথ জ্যোতির্ষাণব একজন জ্যোতিষী। তার কথা থেকে জানা যায় তার ঠাকুরদা সুসং দুর্গাপুরের জমিদার ভূপতি সিংহের গণক ছিলেন। এখন আর তার তেমন যশ খ্যাতি নেই। কোনোরকমে জোড়াতালি দিয়ে দিন চলে যায়। লোকজন হাত দেখাতে আসে কালে ভদ্রে। পান্থ নিবাসের টাকা আবার বাকি পড়ে। জ্যোতির্ষাণব মুখ নিচু করে থাকেন। অবশেষে তার ভাগ্য ফেরাতে সফিক সবার সাথে পরামর্শ করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়। অবশ্য এতেও তার ভাগ্যের কোনো হেরফের হয় না। নিশানাথ বাবু সেই বিজ্ঞাপন দেখে খুবই রেগে গিয়েছিলেন। ‘পাক ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত জ্যোতিষ–শ্ৰী নিশানাথ চক্রবর্তী, জ্যোতির্ষিণব। এম. এ. (ফলিত গণিত) বহু রাজা মহারাজার প্রশংসাপত্র আছে। আসুন পরীক্ষা করুন। দর্শনী নামমাত্র।’

নবী সাহেব ছিলেন গার্লস স্কুলের অ্যাসিসটেন্ট হেড মাস্টার। রিটায়ার করেছেন। দুই মেয়ে থাকে ঢাকা–জামাইরা বড় চাকুরে, তারা নেবার চেষ্টা কম করে নাই। ছোট মেয়েটা অনেক কান্না কাটি করেছিল। আজীজ সাহেব রেলে চাকরি করেন। তিনি আবার খুবই স্বাস্থ্য সচেতন। একদিন রঞ্জুকে জোর করে টেনে নিয়ে বেলের সরবত খাইয়ে দিলেন। এতে নাকি পেট ঠান্ডা থাকে। তার ঘরটি বেশ বড়। তিনি এবং করিম সাহেব দুজনে মিলে থাকেন। করিম সাহেব লোকটি কংকালসার। মাথায় কোনো চুল নেই। কিন্তু মুখ ভর্তি প্রকাণ্ড গোফ।

সিরাজ সাহেবের পয়ত্ৰিশের মকো বয়স হয়েছে। বিয়ে করেছেন মাত্র গত বছর। বিয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই লাজুক ভঙ্গিতে বলেন, শুধু পয়সার অভাবে দেরি করলাম। কিন্তু বড় বেশি দেরি করে ফেলেছি। বউটার বয়স অল্প রে ভাই। মনে মনে বোধহয় কষ্ট পায়–বুড়ো হাসবেন্ড। কোয়ার্টার পেলে নিয়ে আসতে হবে। অফিসার্স গ্রেডে গেলেই পাব। সুন্দর কোয়ার্টার। বেড রুম দুইটা। বারান্দা আছে। ফুলের টব রাখা যায়। আপনার ভাবীর আবার গাছের শখ। বয়সে রঞ্জুর চেয়ে দশ বারো বৎসরের বড়। কিন্তু এমন ভাবে কথা বলেন, যেন তারা দীর্ঘ দিনের বন্ধু। আর গল্পের বেশিরভাগ অংশ জুড়েই থাকে নতুন বউয়ের কথা। নয় নম্বরে থাকে সুলতান উদ্দিন নামে একটা ছেলে। সে এক পত্রিকার অফিসে কাজ করে। তার সব সময় নাইট ডিউটি থাকে। তাই সারাদিন দরজা বন্ধ করে ঘুমায়, কারো সঙ্গে কথাবার্তা বলে না। মেসে সে খায় না। ছুটি-ছাঁটার দিন তার কেরোসিন চুলায় নিজেই দেখি রান্না করে। তার ঘর নবী সাহেবের ঘরের মতো গোছানো। দেখেই মনে হয় নারীর স্পর্শ আছে। দেয়ালে আবার নীলরঙ্গা একটি তৈলচিত্র। জ্যোৎস্না রাত্রির ছবি। অসম্ভব সুন্দর এই ছবিটি ঘরের চেহারা পাল্টে ফেলেছে। তার ছোট ভাইয়ের আঁকা। আর্ট কলেজে ফোর্থ ইয়ারে পড়ে সে।

Advertisement

পান্থনিবাসে সবাই নিজেদের দুঃখ কষ্ট ভুলে থাকার চেষ্টা করে। তবু একেক বার মন ভেঙে যেতে চায়। বাড়ি থেকে চিঠি আসলেই সবার মনকষ্ট শুরু হয়। মাঝে মাঝে দেশ থেকে তাদের কাছে আত্মীয়-স্বজন বেড়াতে আসেন। সিরাজ সাহেব প্রতি শনিবার দেশে বেড়াতে যান। পরপর দুই সপ্তাহ যেতে না পারলে তার বউ এসে হাজির হল। এতে করে মেসবাড়ির নিস্তরঙ্গ জীবনে কিছুটা আলোড়ন তৈরি হয়। একবার এসেছিলেন রঞ্জুর বাবা। সিরাজ সাহেবের সাথে তার সবচেয়ে বেশি খাতির হয়ে গেল। এরপর তার সাথে দেশের বাড়িতে বেড়াতে গেলেন। সেখানে যেয়ে তার বোন রেবার সাথে সফিকের বিয়েও ঠিক করে ফেললেন। এমনকি মেয়েটার একটা ছবি পর্যন্ত সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন।

সফিক রেবার ছবিটি যত্ন করে একটা খামে ভরে রাখতো। সেই খামটি তার টিনের ট্রাঙ্কে তালাবন্ধ থাকে। তার লজ্জা টজা একটু কম কিন্তু রেবার প্রসঙ্গ উঠলেই সে কেমন লজ্জা পায়। নিশানাথ বাবু অনেকবার বলেছিলেন, সিরাজ সাহেবের বোনের ব্যাপারটা নিয়ে কিছু করা দরকার। ভাল মেয়ে দেবী অংশে জন্ম। এই সব মেয়ে হাতছাড়া করা ঠিক না। বলতে বলতে আড় চোখে তাকাতেন সফিকের দিকে। সফিক নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলতো, বিয়ে নিশ্চয়ই হয়ে গেছে এতদিনে? অবশ্য একদিন সত্যি সত্যিই তার বিয়ে হয়ে যায়।

জ্যোতির্ষাণব একদিন ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। শুধু নিশানাথ নয়। নবী সাহেবও পান্থ নিবাস ছেড়ে চলে গেলেন। স্কুল থেকে মহাসমারোহে তাকে বিদায় দেয়া হয়েছে। মেসবাসীরাও তার বিদায় উপলক্ষে একটু বিশেষ খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করলো। কিন্তু তিনি কিছুই খেতে পারলেন না। খাওয়া বন্ধ করে একবার ফিসফিস করে বললেন, আমি আর বেশিদিন বাঁচব না। পান্থ নিবাসে শিকড় গজিয়ে গেছে। বলতে বলতে তার চোখ দিয়ে পানি পরতে লাগলো।

সিরাজ সাহেবের প্রমোশন হয়ে অফির্সাস গ্রেড পেয়েছেন। অফিস থেকে তাকে কোয়ার্টার দেওয়া হয়েছে। সুন্দর কোয়ার্টার। দক্ষিণ দিকে চমৎকার বারান্দা। হুঁ হুঁ করে হাওয়া বয়। সিরাজ সাহেবও পান্থনিবাস ছেড়ে চলে গেলেন। যাবার আগের দিন রাতে বিদায় নিতে এলেন কথা সরে না তার মুখে। অনেকক্ষণ বসে রইলেন চুপ চাপ। এক সময় বললেন, সুখেই ছিলাম ভাই আপনাদের সাথে। আনন্দেই ছিলাম। নিশানাথ বাবুর খালি ঘরটা দেখলে চোখে পানি আসে। আমার স্ত্রীকে তিনি বড় স্নেহ করতেন।

এরপর একটা সময় রঞ্জুরও যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসে। শুধু সফিকের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। মেসবাড়িতে নতুন নতুন ঘর তোলা শুরু হয়। সে পণ করে, শুধু জ্যোতির্ষিণব কেন রঞ্জুও যদি তাকে ছেড়ে চলে যায় তাতে তার কিছুই যাবে আসবে না। সে ঠিক উঠে দাঁড়াব। সেই রাত্রে রঞ্জু একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে। যেন আদিগন্ত বিস্তৃত একটি সবুজ মাঠ। মাঠের ঠিক মাঝখানে সফিক দাঁড়িয়ে আছে একা একা। তার গায়ে মুকুট নাটকের মধ্যম রাজকুমারের পোশাক। আকাশ ভরা জ্যোৎস্না। জ্যোৎস্না ভেজা সেই রাতে সবুজ মাঠের মাঝখান থেকে সফিক যেন হঠাৎ ভয় পেয়ে ছুটতে শুরু করলো।

বইটির ভূমিকায় লেখক লিখেছেন- অন্যদিন গল্পটি স্বাধীনতা সংখ্যা বিচিত্রায় (১৯৭৬) প্রথম প্রকাশিত হয়। পুস্তকাকারে প্রকাশের সময় গল্পটি আবার নতুন করে লিখেছি। একটা সময় নূরুননবী শেখ এবং জনাব ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ‘অন্যদিন’ গল্পটির জন্য গাঢ় ভালোবাসা প্রকাশ করেছিলেন। সেই ভালোবাসা এখনো আছে কি না জানি না। কিন্তু এই বই পড়লে যে কেউই এই বইয়ের মেসবাড়ি পান্থ নিবাস এবং সদস্যদের প্রতি গভীর ভালোবাসা অনুভব করবেন।

মজার ব্যাপার হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদের কোনো উপন্যাস সমগ্রতে এই উপন্যাসটা পেলাম না। জানি না এর পেছনে কারণটা কি? মেসবাড়ির ঐতিহ্য আমাদের দেশ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে তাই হয়তোবা এই উপন্যাসটাও হারিয়ে যেতে বসেছে। তবুও আমরা আসায় বুক বাঁধি। জীবন থেকে দুঃসময় কেটে একসময় সুসময় আসবেই। বইয়ের শুরুতে লেখক দুটো চরণ তুলে দিয়েছেন। সেটা দিয়েই লেখাটা শেষ করি-

‘এই দিনত দিন নয় আরো দিন আছে এই দিনেরে নেব আমি সেই দিনের কাছে।’

এমআরএম/এএসএম