বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে-পরে সকল আন্দোলন শুরু হয়েছে শিক্ষাঙ্গন থেকে। শিক্ষার মানে যেমন তেমন, রাজনৈতিক অর্জন আর ইতিহাস বিবেচনায় নিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ তো বটেই বিশ্ব র্যাঙ্কিঙে ওপরের দিকেই থাকবে। বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই, স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মূল নেতৃত্বটা ছিল ছাত্রদের হাতেই।
Advertisement
এরশাদ গোটা দেশ শাসন করেছেন, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এরশাদ বা চ্যালা-চামুন্ডরা ঢুকতেই পারেনি কখনো। প্রবল পরাক্রমশালী ১/১১এর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধটা গড়ে উঠেছিল এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মাঠের আন্দোলনের ব্যাপারে ওস্তাদ। কীভাবে আন্দোলন করতে হয় সেটা যেমন তারা জানে; কোন কৌশলে আন্দোলন দমিয়ে রাখতে হয়, সেটাও তাদের ভালোই জানা। আওয়ামী লীগের টানা চার মেয়াদে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার মূল কৌশলটাও সেখানেই।
ক্ষমতায় থাকার জন্য আওয়ামী লীগ শিক্ষাঙ্গনকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশলটাই বেছে নিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ইস্যুভিত্তিক নানা আন্দোলন হয়েছে বটে, তবে সারাদেশের সব শিক্ষাঙ্গনে আওয়ামী লীগের একক কর্তৃত্বের লাগামটা আলগা হয়নি কখনো। ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিলে ফলাফল কী হবে সেটা সবাই জানেন। তাই তো একবার ডাকসু নির্বাচন দিয়ে সরকবার আর সেপথে হাঁটেনি। নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক, তবে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই এখন ছাত্রলীগের দখলে। শুধু ছাত্র রাজনীতি নয়, শিক্ষক রাজনীতিও এখন সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণে।
সব মিলে দেশের অন্য সব ক্ষেত্রের মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও সরকারি দলের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল। হঠাৎ সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। শিক্ষকরা আন্দোলনে নেমেছেন সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হওয়া নিয়ে আর শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছে কোটা ব্যবস্থা ফিরে আসায়।
Advertisement
এরই মধ্যে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছে। সবসময়ই আগুন লাগলে তাতে আলু পুড়ে খাওয়ার লোকের অভাব হয় না। বিএনপির নিজেদের আন্দোলন গড়ে তোলার সামর্থ্য নেই। কখনো আমেরিকার ওপর ভর করে, কখনো শিক্ষক, কখনো শিক্ষার্থীদের ওপর ভর করে তারা সফল হতে চায়।
আলাদা ইস্যুতে হলেও শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলছে প্রায় সমান্তরালেই। ফলে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বন্ধ রয়েছে ক্লাশ-পরীক্ষা। আন্দোলনের দাবি ন্যায্য না অন্যায্য; তারচেয়ে বড় কথা হলো আন্দোলনে কতটা চাপ সৃষ্টি করা গেল। আপনি যত বেশি অচলাবস্থা সৃষ্টি করতে পারবেন, তত তাড়াতাড়ি আপনার আন্দোলন সফল হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। আন্দোলন করে অন্যায্য দাবি আদায়ের নজিরও বাংলাদেশে রয়েছে।
গতবছর ১৭ আগস্ট চালু হয়েছিল সর্বজনীন পেনশন স্কিম। সব মানুষকে পেনশন সুবিধার আওতায় আনতে চালু হওয়া স্কিমটি গত প্রায় একবছরে যতটা আশা করা হয়েছিল ততটা সাড়া জাগাতে পারেনি। আমার বিবেচনায় সরকার এখন পর্যন্ত যত প্রকল্প নিয়েছে, তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি জনসম্পৃক্ত প্রকল্প হলো সর্বজনীন পেনশন স্কিম। এটা সরকার এবং গ্রাহক দুই পক্ষের জন্যই লাভজনক। কারণ সরকার এখন টাকা পেলেও এই মুহুর্তে তাকে শোধ দিতে হবে না। সর্বোচ্চ ৪২ বছর পর সরকারকে টাকা শোধ করতে হবে। আবার যারা এখন টাকা জমাবেন, তারা মেয়াদ শেষে ভালো অঙ্কের পেনশন পাবেন।
এই সময়ে সরকার পেনশন স্কিমের টাকা বিনিয়োগ করে লাভবান হতে পারবে। তবে এই প্রকল্প টেকসই করতে এতে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষকে সম্পৃক্ত করা জরুরি। কিন্তু দুই পক্ষের জন্যই লাভজনক এই প্রকল্প জনগণের মধ্যে কাঙ্খিত সাড়া জাগাতে না পারায় বিপাকে পড়ে সরকার। এখন এই স্কিমের আওতা বাড়াতে সরকার নানা উদ্যোগ নিচ্ছে।
Advertisement
আমরা চাই, সরকারের সংশ্লিষ্ট লোকজন আন্দোলনকারীদের সাথে কথা বলুক; তাদের ক্ষোভের জায়গাটা মমতার সাথে শুনুক। তারপর ব্যবস্থা নিক। আর সর্বোচ্চ আদালতের রায় তো রাজপথের আন্দোলন দিয়ে পাল্টানো যাবে না, যাওয়া উচিত নয়। কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীরা আরো বড় উকিল নিয়ে আদালতে যাক, তাদের ক্ষোভের কথা বলুক।
শুরুতে প্রগতি, সুরক্ষা, প্রবাস, সমতা এই চারটি প্যাকেজ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও গত ১ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে ‘প্রত্যয়’ নামে আরেকটি প্যাকেজ। শোনা যাচ্ছে, আগামী বছরের ১ জুলাই থেকে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ‘সেবক’ নামে আরেকটি প্যাকেজ চালু হবে।
নতুন চালু হওয়া প্রত্যয় প্যাকেজে স্ব-শাসিত, স্বায়ত্বশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারির অন্তর্ভুক্ত হবেন। এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা চারশরও বেশি। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালেয়র শিক্ষকরা এই প্যাকেজে অন্তর্ভূক্ত হতে চাচ্ছেন না। তারা স্বার্থপরের মত নিজেদের এর আওতামুক্ত করার আন্দোলনে নেমেছেন। শিক্ষকরা সমাজের সবচেয়ে সচেতন অংশ। যদি পেনশন স্কিম বা প্রত্যয় প্যাকেজ খারাপই হয়, তাহলে সেটা তো সবার জন্যই খারাপ। শিক্ষকরা শুধু নিজেদের জন্য আন্দোলন করছেন কেন। শিক্ষকদের বাদ দিলেই তো পেনশন স্কিমের সব সমস্যা মিটে যাবে না।
এটা ঠিক, তাড়াহুড়ো করে চালু হওয়া পেনশন স্কিমে কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। সমস্যাগুলোর সমাধান করে সর্বজনীন পেনশন স্কিমকে সত্যিকার অর্থেই সর্বজনীন করে তুলতে হবে। আর এটা সম্ভব আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই। যারা পেনশন স্কিম নিয়ে আন্দোলন করছেন, তারা প্রায় সবাই সরকার সমর্থক।
আর সরকার সমর্থকরাই যদি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে, তাহলে বুঝতে হবে কোথাও একটা বড় গলদ রয়ে গেছে। শিক্ষকদের আন্দোলন যত স্বার্থপরই হোক, তাদের কথা শুনতে হবে। সময়ের সাথে সাথে একজন মানুষের সুবিধা বাড়ে। কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে গেলে শিক্ষকদের সুবিধা কমে যাবে। এটা তারা সহজে মানবেন বলে মনে হয় না। পেটে টান পড়লে সরকারের সমর্থক না বিরোধী তাতে কিছু যায় আসে না।
শিক্ষকদের মত শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন স্বার্থপর আন্দোলন। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত অংশের কথা না ভেবে শিক্ষার্থীরা নিজেদের চাকরি নিশ্চিত করার জন্য আন্দোলনে নেমেছে। ২০১৮ সালে আন্দোলনের মুখে সরকার কোটা পদ্ধতি বাতিল করেছিল। কিন্তু হাইকোর্ট আবার সরকারি চাকরিতে কোটা বহাল করেছেন। আপিল বিভাগও হাইকোর্টের রায় বহাল রেখেছে।
আপিল বিভাগ এমন প্রশ্নও করেছেন, আন্দোলন করে তো আদালতের রায় বদলানো যাবে না। আসলে দাবিটা যৌক্তিক না অযৌক্তিক সেটাই হওয়া উচিত মূল বিবেচ্য। কত জন মানুষ আন্দোলন করছেন, কত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেন, কত মানুষ ভোগান্তির শিকার হলেন; সেটা দাবি আদায়ের হাতিয়ার হতে পারে না। প্রতিবন্ধীরা, আদিবাসীরা, নারীরা, সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরা আন্দোলন করতে পারবেন না বলে কি তারা বারবার বঞ্চিত হবেন, বঞ্চিতই থাকবেন।
সরকার কীভাবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন মোকাবেলা করবে, সেটা তাদের বিবেচনা। তবে গায়ের জোরে যেন আন্দোলন দমনের চেষ্টা করা না হয়। দাবি যৌক্তিক হোক আর অযৌক্তিক, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করার অধিকার সবার আছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশ-পরীক্ষা বন্ধ রেখে, শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন জিম্মি করে, রাস্তা আটকে মানুষের ভোগান্তির সৃষ্টি করে দিনের পর দিন আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া কারো জন্যই কাম্য নয়।
আমরা চাই, সরকারের সংশ্লিষ্ট লোকজন আন্দোলনকারীদের সাথে কথা বলুক; তাদের ক্ষোভের জায়গাটা মমতার সাথে শুনুক। তারপর ব্যবস্থা নিক। আর সর্বোচ্চ আদালতের রায় তো রাজপথের আন্দোলন দিয়ে পাল্টানো যাবে না, যাওয়া উচিত নয়। কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীরা আরো বড় উকিল নিয়ে আদালতে যাক, তাদের ক্ষোভের কথা বলুক।
সরকারকে মনে রাখতে হবে বিরোধী দলের আন্দোলন আর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এক নয়। তাই দুই আন্দোলন এক স্টাইলে দমন করা যাবে না। নিষ্ঠুর কায়দায় আন্দোলন দমনের অতি আত্মবিশ্বাস সরকারের জন্য কাল হতে পারে। এ নিয়ে সময়ক্ষেপণও কাম্য নয়।
রাজনীতি-আন্দোলন নয়, শিক্ষাঙ্গনে মূল কাজ শিক্ষা। সেই পরিবেশ যেন দ্রুত ফিরে আসে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/জেআইএম