সোশ্যাল মিডিয়া

ভাইরাল যেন না হয় ভাইরাস

মো. রিয়াজ উদ্দিন ইফান

Advertisement

সাধারণত ভাইরাল বলতে এমন একটি তথ্য বা মিডিয়াকে বোঝায়, যা অত্যন্ত দ্রুত এবং ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়। এটি প্রধানত ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং সাধারণত সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলে। ভাইরাল হওয়ার পেছনে বিশেষ কোনো শর্ত নেই। তবে এর প্রভাব ও ফলাফল ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে পরিবর্তনশীল হতে পারে।

ভাইরাল হওয়ার মূল কারণ হলো সমসাময়িকতা এবং সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব। একটি বিষয় যদি ব্যক্তিরা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করেন, তাহলে সেটি প্রচারিত হয় এবং আরও বেশি মানুষ এতে আকৃষ্ট হয়। ভাইরাল টপিকের আধিক্যে প্রায়ই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আড়ালে চলে যায়। শিক্ষণীয় বা দেশের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো কখনো ট্রেন্ডে আসতে চায় না। যখন যা ভাইরাল হয়, আমরা তা শেয়ার করতে থাকি সোশ্যাল মিডিয়ায়। তা পজিটিভ হোক কিংবা নেগেটিভ। এই সবজান্তা মনোভাবের ফলে প্রায়শই অপ্রয়োজনীয় তথ্য ছড়িয়ে পড়ে।

বিষয়টি অনুধাবনের জন্য বর্তমানের কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করা যাক। সম্প্রতি এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হলে একটি মেয়ে ভুলক্রমে সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে পরীক্ষার হল ভেবে চলে যায়। কিন্তু একজন পুলিশ সহায়তা করে তার নিজ কেন্দ্রে নেওয়ার চেষ্টা করেন; যেখানে নিয়ে যায় সেটাও ভুল কেন্দ্র। পরিতাপের বিষয় হলো, সকালে সাহায্য করার ভিডিও দেখে মানুষ এ মহৎ কাজে পুলিশের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং দুপুরে পুলিশের ভুল কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার ভিডিও নিয়ে নানা রকম ট্রল করে মানুষটিকে জোকার বানিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া বর্তমানে রাসেলস ভাইপার নিয়ে যে যার মতো মনগড়া কথা বলে ও কন্টেন্ট বানিয়ে পুরো দেশে একটি ভীতি ছড়িয়ে দিয়েছে। প্রশ্ন হলো, এগুলো কি আদৌ আমাদের দুশ্চিন্তার বিষয়? যদি না হয়, তাহলে এ ভাইরাল সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কী?

Advertisement

একজন আদর্শ নাগরিক হিসেবে আমাদের ভাইরাল বিষয়ের ক্ষতিকর এবং ভালো দিকগুলো জানতে হবে। ভাইরাল বিষয়গুলো প্রায়ই সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। এর মাধ্যমে সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলো, মিথ্যা তথ্য ও ভুল তথ্যের প্রচার। অনেক সময় ভাইরাল বিষয়ে মিথ্যা ও অসত্য তথ্য প্রচারিত হয়, যা লোকদের প্রতি ভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। যেমন- ২০১৯ সালের ২০ জুলাই চার বছরের সন্তান তুবাকে ভর্তির জন্য রাজধানীর বাড্ডার একটি স্কুলে খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন তাসলিমা বেগম রেণু। কিন্তু ফিরলেন লাশ হয়েই। তুবাকে আর স্কুলে ভর্তি করাতে পারলেন না রেণু। ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে মুহূর্তেই ঝরে গেল একজন মায়ের প্রাণ। তাছাড়া ‘পদ্মা সেতু নির্মাণে মাথা লাগবে’ এমন গুজব তো আমরা কম-বেশি সবাই জানি। যা সারাদেশে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। এ গুজবে ৯ জেলায় অন্তত ১৯ জন গণপিটুনির শিকার হয়েছেন। মারা গেছেন ৯ জন। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পরে যে, লবণের দাম বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। দেশবাসী হুজুগের বশবর্তী হয়ে লবণ কিনতে থাকে। একদিন পরেই জানা যায়, লবণের দাম আদৌ বাড়েনি এবং মজুত আছে প্রচুর।

আরও পড়ুন রিকশার প্যাডেল ঘুরলেও ঘোরে না ভাগ্যের চাকা  পরীক্ষার ফলাফল কি সফলতার মানদণ্ড? 

ভাইরাল বিষয় সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। কখনো কখনো হিন্দু-মুসলিমদের মাঝে ভাইরাল টপিক নিয়ে হইচই শুরু হয়। এগুলো ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়। সবার ধর্মই শান্তি কামনা করে। ধর্মীয় বিষয়গুলো নিয়ে ভুল-ভ্রান্তি ভাইরাল করা হচ্ছে, যা সমাজকে হিংসাত্মক করে তুলছে। ফলে ভাইরাল কন্টেন্ট অসামাজিক প্রচার সৃষ্টি করে। অনৈতিক কিছু কন্টেন্ট ঢালাও ভাবে প্রচার হয়। যেসব যুবসমাজের জন্য ক্ষতিকর। অনেকে নিজের মনের খোরাকের জন্য এসব ভিডিও শেয়ার করেন। এসব থেকে আমাদের সবার দূরে থাকতে হবে এবং সচেতন থাকতে হবে।

ভাইরাল শব্দটি ভাইরাসের সঙ্গে সংঘটিতপূর্ণ কিংবা বর্তমানে মিস ইউজড করা হলেও আমাদের ভাইরালকে ভালো কাজের দিকে ডাইভার্ট করতে হবে। কেননা ভাইরালের ভালো দিকও আছে। প্রথমত, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারি। কোথাও অনিয়ম হলে তা ভিডিওর মাধ্যমে তুলে ধরা যায়। এলাকার রাস্তা-ঘাটের সমস্যা তুলে ধরা যায়। সামাজিক অবক্ষয়ের বিষয় তুলে ধরাসহ অনেক কিছু আছে, যা দেশ ও সমাজের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। দ্বিতীয়ত, এমন কিছু প্রশংসনীয় অবদান রাখতে পারি, যা ভাইরাল বিষয়ে কোনো ভালো কাজের জন্য অবদান রাখতে পারে। যেমন- ২০২২ সালে সিলেটে হঠাৎ বন্যা হওয়ার কারণে ওই এলাকার মানুষ বিপদে পড়ে যায়। সেসময় অনেক সেচ্ছাসেবী তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। আর্থিক অনুদানের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় তথ্য শেয়ার করেন, যা ভাইরাল হয়। তারপর সহযোগিতার হাত বাড়ায় দেশের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। তৃতীয়ত, শিক্ষণীয় কন্টেন্ট ভাইরালে মিলবে উপকার। কেননা দৈনন্দিন কাজ শেষে বিনোদনের প্রয়োজন আছে। তবে তা যদি হয় শিক্ষণীয়, মনোরম বা মজাদার কন্টেন্ট; তাহলে তো কথাই নেই।

বর্তমানে অনেক ভালো ভালো কন্টেন্ট ক্রিয়েটর আছেন, যারা এই ধরনের কন্টেন্ট বানান। তাছাড়া কিছু ট্রাভেলার বা ব্লগার আছেন। অনেকে ফুল, ফল, গাছ নিয়ে নানা তথ্য তুলে ধরেন। তাই আমাদের উচিত, সোশ্যাল মিডিয়ার যথাযথ ব্যবহার করা। ভালো কিছু শেয়ার করা এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করা। ভাইরাল বিষয়গুলো যেন ভাইরাস হয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। দেশ ও সমাজের স্বার্থে ভালো কন্টেন্ট শেয়ার করা এবং সবজান্তা মনোভাব থেকে দূরে থাকা জরুরি। তবেই একটি সুন্দর, সচেতন এবং সহায়ক পরিবেশ তৈরি হবে।

Advertisement

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ।

এসইউ/জিকেএস