রাষ্ট্রীয় সফরে সোমবার (৮ জুলাই) চীনে যাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর এই প্রথম চীনে যাচ্ছেন তিনি।
Advertisement
এর আগে, গত জুনে দ্বিপাক্ষিক রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি রেল ট্রানজিটসহ বিভিন্ন বিষয়ে দশটি সমঝোতা স্মারক সই করেন।
ভারত সফরের দুই সপ্তাহ পর শেখ হাসিনার চীন সফর কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক, উভয়দিক থেকেই বাংলাদেশের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। জানা যাচ্ছে, এই সফরের মাধ্যমে নতুন বাজেটের ঘাটতি পূরণসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ পাওয়ার আশা করছে বাংলাদেশ।
আরও পড়ুন:
Advertisement
গত ১৫ বছরে চীনকে বাংলাদেশের বেশকিছু মেগা-প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি বাস্তবায়নকারীর ভূমিকাতেও অবতীর্ণ হতে দেখা গেছে। বহুল আলোচিত পদ্মা সেতুর অবকাঠামো নির্মাণ ও কর্ণফুলি টানেল তৈরির পর দেশটি এখন বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্পেও যুক্ত হতে চাচ্ছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে চীন এত আগ্রহ দেখাচ্ছে কেন? এতে তাদের লাভ কী? বাংলাদেশে চীনের ঠিক কী কী ধরনের স্বার্থ রয়েছে এবং এই ভূখণ্ডে নিজেদের উপস্থিতি বাড়িয়ে তারা আসলে কী অর্জন করতে চাচ্ছে?
চীনা ঋণ ও বিনিয়োগ
গত দেড় দশকে এক ডজনেরও বেশি বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ। এসব প্রকল্পের মধ্যে পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, কর্ণফুলি নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, ঢাকায় বাস র্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্পসহ বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থঋণ দিয়েছে চীন।
Advertisement
বস্তুত, চীন এখন বাংলাদেশে শীর্ষ ঋণদাতা দেশগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যমতে, গত চার অর্থবছরে চীন এককভাবে বাংলাদেশকে প্রায় তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দিয়েছে।
গত সাত বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে/ ছবি: সংগৃহীত
আর ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটে’র (এইআই) ২০২৩ সালের এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ রয়েছে সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি।
বর্তমানে আফ্রিকা থেকে শুরু করে এশিয়া, এমনকী, ইউরোপের বিভিন্ন দেশকেও ঋণ দিচ্ছে চীন। কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় অন্যদেশের তুলনায় বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়াটা তাদের জন্য বেশি লাভজনক বলে জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়া বেশি লাভজনক হিসেবে দেখার কারণ হলো- ঋণ দিয়ে একদিকে তারা সুদের টাকা পাচ্ছে, অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে চীনা ঠিকাদাররাই ওইসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সেইসঙ্গে, বাংলাদেশের উপরেও চীনের প্রভাব বজায় থাকছে।
কর্মসংস্থান
বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার ফলে চীনা নাগরিকদেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ হচ্ছে। যেসব প্রকল্পে চীন ঋণ দিচ্ছে, দেখা যাচ্ছে চীনা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোই সেখানে কাজ করছে। লোকবলেরও একটা বড় অংশ তাদের, বিবিসি বাংলাকে বলেন তৌহিদ হোসেন।
প্রায় দেড়শ কোটির মানুষের দেশ চীনে করোনা মহামারির পর ২০২৩ সালে বেকারত্বের হার রেকর্ড সংখ্যায় বেড়েছে। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে দেশটিতে ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে বলে চীনের সরকারি বলা হয়েছে। কাজেই বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে অর্থ বিনিয়োগ করার মাধ্যমে চীনের সরকার তাদের বেকার নাগরিকদের কাজের সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে।
আরও পড়ুন:
এ বছর এলএনজি আমদানিতে রেকর্ড করতে পারে চীন ৬ বছর আগেই নবায়নযোগ্য শক্তির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করছে চীন চীনা কোম্পানির বিক্রি বেড়েছে ২১ শতাংশ, চ্যালেঞ্জের মুখে টেসলাবাংলাদেশের সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এ দেশে কর্মরত বিদেশিদের মধ্যে চীনা নাগরিকরাই শীর্ষে অবস্থান করছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, অনুমতি নিয়ে কাজ করতে আসা চীনা নাগরিকের সংখ্যা ছয় হাজারের কিছু বেশি বলে উল্লেখ করা হলেও, প্রকৃত সংখ্যা আরও কয়েক গুণ বেশি বলে মনে করেন অনেকে।
বাণিজ্যিক স্বার্থ
এইআই’র হিসাবে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাৎসরিক দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যি প্রায় ২ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের পৌঁছেছে। বিশাল এই অঙ্কের প্রায় সবটাই আমদানি করে বাংলাদেশ।
একক দেশ হিসেবে চীনের কাছ থেকেই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে দেখা যাচ্ছে, গত ১০ বছরে চীন থেকে পণ্য আমদানি প্রায় তিন গুণ বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে চীন থেকে বছরে যেখানে সাড়ে ছয়শ কোটি মার্কিন ডলারের মতো পণ্য আমদানি করা হতো। এখন সেটি বেড়ে প্রায় দুই হাজার কোটি ডলারে পৌঁছেছে।
বিভিন্ন পণ্যের পাশাপাশি চীনের কাছ থেকে সামরিক সরঞ্জামও কিনে থাকে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালে চীন থেকে দুটি সাবমেরিনও কিনেছে দেশটি। ফলে চীনের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ
অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থের পাশাপাশি ভূ-রাজনীতির কৌশলগত দিক থেকেও চীনের কাছে বাংলাদেশ একটা বাড়তি গুরুত্ব রয়েছে বলে জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বাড়তি এই গুরুত্বের প্রধান কারণ বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান।
বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, সুপার পাওয়ার হতে চাওয়া চীন মূলতঃ এ অঞ্চলে একটা আধিপত্য রাখতে চায়। বিশেষত, বঙ্গোপসাগরে। আর, বঙ্গোপসাগরকে চীন যে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়, তার প্রধান কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি’।
আরও পড়ুন:
২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতিতে দাপট দেখাবে যেসব দেশ যেভাবে একটিও গুলি খরচ না করে তাওয়াইন দখল করতে পারে চীন চীনা গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পথে হাঁটছে ইইউ২০২১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই স্ট্রাটেজি ঘোষণা করে। এতে চীনকে বাদ দিয়ে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, ফিলিপাইন, বাংলাদেশ-সহ অন্য দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে একটি নিরাপদ ‘ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল’ গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
মূলত, ইন্দো-প্যাসিফিক বা ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ বসবাস করে। ফলে যেকোনো পণ্যের বাজার হিসেবে এই অঞ্চলটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একইসঙ্গে, সমুদ্র বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এ অঞ্চলটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।
সেই কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে এই অঞ্চলের জন্য আলাদা কৌশল ঘোষণা করেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। অবশ্য, যুক্তরাষ্ট্রের আগেই ২০১৩ সালে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ নামে একটি উন্নয়ন কৌশল ও কাঠামো উপস্থাপন করেছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এশিয়া, ইউরোপসহ বিশ্বের ৬০টি দেশের সঙ্গে সড়ক ও রেলপথে সরাসরি সংযুক্ত হতে চায় চীন।
দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি নেভির যুদ্ধজাহাজ/ ছবি: সংগৃহীত
বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরই) নামের যে মহাপরিকল্পনা নিয়ে চীন বিভিন্ন দেশে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আর সেটি ঠেকানোর কৌশল হিসেবেই ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি’ ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
এই কৌশলের অংশ হিসেবে জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতকে সঙ্গে নিয়ে একটি নিরাপত্তা জোটও গঠন করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সেটি ‘কোয়াড্রিলেটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ’ (কোয়াড) নামে পরিচিত।
মার্কিন নেতৃত্বাধীন ওই জোটে বাংলাদেশ অংশ নিক, চীন সেটি চায় না। এ বিষয়ে সতর্ক করে ২০২১ সালের মে মাসে ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেছিলেন, কোয়াডে অংশগ্রহণ চীন ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে যথেষ্ট খারাপ করবে।
চীন কী বলছে?
বাংলাদেশের সঙ্গে থাকা বর্তমান সম্পর্ককে আরও গভীর করার মাধ্যমে ‘নতুন উচ্চতায়’ নিয়ে যেতে চায় চীন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং সাংবাদিকদের বলেন, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে কীভাবে আরও গভীর করা যায় ও পারস্পরিক লাভজনক সহযোগিতা সম্প্রসারণের পাশাপাশি অভিন্ন স্বার্থের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো নিয়ে দুই দেশের নেতারা কথা বলবেন।
আরও পড়ুন:
২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতিতে দাপট দেখাবে যেসব দেশ এক ভুলেই দেউলিয়া বিশ্বের বৃহত্তম সিফুড রেস্তোরাঁ? বিশ্বে মিলিয়নিয়ারের সংখ্যা বেড়ে ২ কোটি ২৮ লাখতিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনার এবারের সফরের মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নেওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত রয়েছে চীন।
কীভাবে ও কোন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ‘নতুন উচ্চতায়’ পৌঁছাবে- এমন প্রশ্নের জবাবে মাও নিং যে পদক্ষেপগুলোর উল্লেখ করেছেন, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি পদক্ষেপ হচ্ছে, চীনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পাঁচটি মূলনীতি বা পঞ্চশীল চেতনা এবং ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ সহযোগিতাকে এগিয়ে নেওয়া। মূলত, এই প্রকল্পের অংশ হিসেবেই বাংলাদেশের রেল ও সড়কপথ উন্নয়নে ঋণ দিচ্ছে চীন।
চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের উপর নিজের একটি লেখায় ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলছেন, ২০২৩ সালকে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যকার বেল্ট অ্যান্ড রোড সহযোগিতার সুফল পাওয়ার মৌসুম হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কেননা, ওই বছর ডজনখানেক মেগা প্রকল্পের মধ্যে বেশ কয়েকটির কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া বাকিগুলোর কাজেও বেশ অগ্রগতি হয়েছে বলে দাবি করেন চীনা রাষ্ট্রদূত।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এসএএইচ