বছর খানেক আগে হঠাৎ সংবাদ বের হয়েছিল, ‘ইংরেজি শিখছেন লিওনেল মেসি।’ তোলপাড় পড়ে গেলো পুরো ফুটবল বিশ্বে। কেন হঠাৎ করে মেসির ইংরেজি শেখার প্রয়োজন হলো? কি কারণে ইংরেজি শিখছেন তিনি? তাহলে কী লিওনেল মেসি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের কোনো ক্লাবে নাম লেখাতে যাচ্ছেন? ফুটবল বিশ্বে তোলপাড়, কেন তিনি ইংরেজি শিখছেন? আর বাংলাদেশের ভক্তরা অবাক হয়েছেন, মেসি ইংরেজি জানেন না? এতবড় ফুটবলার, অথচ ইংরেজি জানেন না তিনি। কী অবাক করা কাণ্ড! শুধু মেসি কেন, লাতিন আমেরিকা থেকে উঠে আসা বিশ্বের অনেক নামকরা ফুটবলারও ইংরেজি জানতেন না। এমনকি মেসির বর্তমান সতীর্থ নেইমারও ঠিকমত ইংরেজি বলতে পারেন না। তাতে অবশ্য তাদের কোথাও কোনো সমস্যায় পড়তে হয়েছে বলে শোনা যায়নি কখনও।এখন হয়তো কিছু কিছু ইংরেজি জানেন মেসি। কিংবা তার সাক্ষাৎকার নিতে হলে ইউরোপের দুঁদে সাংবাদিকদেরও স্প্যানিশ ভাষা শিখতে হয়। না হলে তো মেসির সঙ্গে প্রাঞ্জল ভাষায় কথা বলা যাবে না। সাক্ষাৎকারে তিনি কী বলতে চেয়েছেন, সেটার অন্তর্নিহিত অর্থও বোঝা যাবে না। মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে রক্ত দিয়েছে, বাংলাদেশ ছাড়া এমন দ্বিতীয় কোনো দেশ নেই আর। পাকিস্তানি শোষকদের চাপিয়ে দেয়া মাতৃভাষা `উর্দু মানি না’- বলে যে স্লোগান উঠেছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশে আমতলায়, তাতে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল পাকজান্তারা। তাতে রক্ত ঝরেছিল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারদের তরতাজা প্রাণের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি এই মাতৃভাষা বাংলা। ১৯৯৯ সালে বাংলার জন্য এই ত্যাগের স্বীকৃতি আসে জাতিসংঘের তরফ থেকে। ২১ ফেব্রুয়ারিকে ঘোষণা করা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে। সরকারি উদ্যেগে ঢাকার সেগুনবাগিচায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। মাতৃভাষা নিয়ে গবেষণাই এর উদ্দেশ্যে। তবে উদ্দেশ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এর কার্যক্রম কতদূর প্রসারিত, সে সম্পর্কে সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের জানা নেই। তাতে বাংলা ভাষার প্রসার ও প্রচার হচ্ছে কি না সেটাও আমরা জানি না।তবে বাংলার প্রসার ঘটিয়েছেন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে যোগ দেয়া বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী, বিমান বাহিনী, পুলিশ কিংবা র্যাবের জওয়ানরা। সিয়েরালিওনসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশে এখন বাংলা বেশ জনপ্রিয় ভাষা। সিয়েরালিওন তো বাংলাকে তাদের দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবেই স্বীকৃতি দিয়েছে। আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত দেশটির মানুষের মুখে মুখে এখন শোনা যায় বাংলা ভাষা।এছাড়া বাংলা ভাষার কিছুটা প্রসার ঘটছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাংলাদেশি কিংবা বাংলা ভাষা-ভাষী জনগণের মাধ্যমে। তাতে অবশ্য ভিনদেশি মানুষদের মধ্যে বাংলা ভাষা শেখার প্রবণতা কখনওই দেখা যায়নি। বিদেশের মাটিতে নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় হয়তো বাংলা ভাষা-ভাষীরা বাংলাতেই করে থাকেন। কিন্তু সে সব দেশে গিয়ে সেখানকার সমাজ-পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে বাংলাদেশের মানুষকে সেখানকার ভাষাকেই আপন করে নিতে হয়। ইংরেজি, আরবী, হিন্দি, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ থেকে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভাষা শিখেই বাংলাদেশি প্রবাসীদের শিক্ষা অর্জন কিংবা কাজ করতে হয়। যেমনি বাংলাদেশে এসেও বিদেশিদের অনেককেই দেখা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ইনস্টিটিউটে ছুটতে। কাজের জন্য যেটুকু বাংলা না শিখলেই নয়, সেটুকু তারা শিখে নিচ্ছে। দেশের বাইরে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনছাড়া কখনও কোথাও দেখা যায়নি, কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও বাংলার প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে। কিংবা বাংলাকে শেখার বিষয় হিসেবে নিয়েছে। অথচ এই প্রথম দেখা গেলো কোথাও বাংলাকে নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সেটা শুধু একা এক মুস্তাফিজুর রহমানের কল্যাণেই। সাতক্ষীরার অজ-পাড়া গাঁ থেকে হঠাৎই উত্থান ঘটলো ২০ বছর বয়সী বাঁ-হাতি পেসার মুস্তাফিজের। উত্থানের সময়ই যে আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে দিয়েছেন লিকলিকে গড়নের এই তরুণ, সেটা মুহূর্তেই পৌঁছে গেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। বিশেষ করে ক্রিকেট বিশ্বে। অভিষেকের পর মাত্রই এক বছর পার করলেন, তাতেই পুরো ক্রিকেট বিশ্বের প্রধান আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছেন তিনি। এমনও হতে পারে, কিছুদিনের মধ্যেই মুস্তাফিজের বোলিং রহস্য ভেদ করার জন্য উন্নত কোনো দেশ রিসার্স ইনস্টিটিউট খুলে বসেছে। তাদের উঠতি ক্রিকেটারদের শেখাবে মুস্তাফিজ কাটার, মুস্তাফিজ স্লোয়ার কিংবা ইয়র্কার। তার বোলিংয়ের রহস্য এমন্যই যে, তা এখনও পর্যন্ত বিশ্বের বড় বড় ব্যাটসম্যানরা আবিষ্কার করতে পারেনি! সুতরাং, মাল্টি বিলিয়ন ডলারের ফ্রাঞ্জাইজি ভিত্তিক লিগগুলোতে মুস্তাফিজ এখন পুরোই হটকেক। ফ্রাঞ্জাইজি লিগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জমজমাট এবং আকর্ষণীয় ভারতের আইপিএল। এই লিগের ফ্রাঞ্চাইজিগুলোর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে সৌভাগ্যবান সানরাইজার্স হায়দারাবাদ। মাত্র ১ কোটি ৪০ লাখ রুপিতে তারা কিনতে পেরেছে মুস্তাফিজকে। তারা যে কতটা সৌভাগ্যবান, সেটা আইপিএল শুরু হওয়ার পরই বোঝা গিয়েছে। শুরু থেকেই বিস্ময় ছড়িয়ে পুরো ক্রিকেট বিশ্বের সব আলো কেড়ে নিয়েছেন তিনি। সানরাইজার্স তাকে আদর করে ডাকে, ‘ফিজ’ নামে।সেই ফিজ কিন্তু অজ-পাড়া গাঁ থেকে উঠে আসা এক তরুণ। মাতৃভাষা বাংলাই যার ভাব প্রকাশের একমাত্র অবলম্বন। আইপিএলে গিয়ে তিনি ভাব বিনিময় করবেন কিভাবে? সেখানে হয় হিন্দি, নয়তো ইংরেজিতে কথা বলতে হবে; কিন্তু মুস্তাফিজ তো কোনোটাই জানেন না। আবার এমন এক পারফরমার তিনি, তাকে কোনোভাবেই সাইডলাইনে বসিয়ে রাখা যায় না। তাকে সামনে আনতেই হবে। তাকে নিয়েই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে রণ পরিকল্পনা সাজাতে হবে।সুতরাং, মুস্তাফিজের সঙ্গেই ভাব বিনিময়ের প্রয়োজন দেখা দিল সানরাইজার্স হায়দারাবাদের অস্ট্রেলিয়ান কোচ টম মুটি, অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নার, মেন্টর ভিভিএস লক্ষ্মণ থেকে শুরু করে অন্য সবার। মুস্তাফিজকে সতীর্থ হিসেবে পাওয়া ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড কিংবা অস্ট্রেলিয়ানদের বাধ্য হয়েই বাংলার প্রতি আগ্রহী হতে হচ্ছে। এখন বিষয়টা বাধ্য হওয়া নয়, আগ্রহ নিয়েই বাংলা শিখতে শুরু করে দিয়েছেন তারা।নিউজিল্যান্ডের পেসার ট্রেন্ট বোল্টকে বাংলায় ‘কেমন আছ`- প্রশ্ন করতে শোনা গেছে মুস্তাফিজকে। অন্যরাও একইভাবে তার কাছ থেকে বাংলা শেখার বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। তার সঙ্গে দ্রুত ভাব বিনিময়ের জন্য হয়তো দোভাষী নিয়োগ দিতে হয়েছে; কিন্তু তাতে কী আর চলে! সুতরাং গুগল ট্রান্সলেটরের সাহায্য নিয়ে টম মুডি, লক্ষ্মণ, ওয়ার্নাররা বসে গেছেন বাংলা শেখার আসরে।ডেভিড ওয়ার্নার তো বলেই দিয়েছেন, তার এক বন্ধু আছে যিনি বাংলাও জানেন। গুগল ট্রান্সলেটের মাধ্যমে না হলে, তিনি বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন মুস্তাফিজের বাংলা বোঝার জন্য। টম মুডি তো গুগল ট্রান্সলেটে মুস্তাফিজ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ভজঘটই পাকিয়ে ফেললেন। তিনি বাংলায় লিখতে চেয়েছিলেন ‘ওয়ান্ডারফুল ফানি এন্ড ট্যালেন্টেড ইয়ং ম্যান’। কিন্তু সেটা গুগলের বদান্যতায় হয়ে গেছে অন্য রকম, ‘বন্দের্ফুল্লি ফানি এন্ড তালেন্তেদ ইউং ম্যান।’ লক্ষ্মণ অবশ্য তার সঠিক বাংলা করেছেন। জবাব দিয়ে লিখেছেন, ‘হি ইজ উজ্জ্বল ও আমুদে।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘মুস্তাফিজকে পেয়ে সানরাইজার্স আনন্দিত।’ অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নার আবার টুইট করেছেন, ‘ফিজের জন্য আমি গুগল ট্রান্সলেটর ব্যবহার করছি। বাংলা শেখার চেষ্টা করছি।’ শুধু কি সানরাইজার্স হায়দারাবাদের কোচ-খেলোয়াড়? দর্শকরাও বাদ যাবে কেন? রাজীব গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামে উপস্থিত দর্শকরা তাদের ওয়ান্ডারবয় ফিজের জন্য শিখছেন বাংলা। মুস্তাফিজ বোলিং করতে এলেই বাংলায় তারা উল্লাস ধ্বনি করছে। এক বাংলাদেশির জন্য বিদেশের কোন স্টেডিয়ামের গ্যালারি বাংলায় চিৎকার করছে, এ যেন স্বপ্নকেও হার মানানো কোন চিন্তা-ভাবনা। এমনটা কে কখন ভাবতে পেরেছিল! অথচ, সেটাকেই সম্ভব করলেন মুস্তাফিজ।এরপর একই মাঠে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের বিপক্ষে বাংলাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলেন সাতক্ষীরার এই তরুণ। ম্যাচ সেরা পুরস্কার নেয়ার পর সঞ্চালক পাকিস্তানি রমিজ রাজার সামনে যেতে হয়েছে তাকে। ইংরেজি বলতে পারবেন না দেখে তার মধ্যে কোনো সংকোচবোধ দেখা যায়নি। বাধ্য হয়েই রমিজ রাজা বললেন, ‘সে সামথিং ইন বেঙ্গলি (বাংলাতেই কিছু বলুন)।’ মুস্তাফিজও একগাল হাসি দিয়ে বললেন, ‘সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। গেমটা অনেক ভালো হইসে। সবাই এনজয় করছে। থ্যাঙ্ক ইউ।’বিদেশের মাটিতে আবারও বাংলা ভাষাকে উর্ধ্বে তুলে ধরলেন বাংলাদেশের বিস্ময় বালক। বাংলাকে গর্বিত করে তুলেছেন তিনি। তার জন্য বিদেশীরা শিখছে বাংলা। আইপিএলের পর মুস্তাফিজ খেলতে যাবেন ইংল্যান্ডে। ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেটে। এরপর হয়তো তার ডাক আসবে অস্ট্রেলিয়ার বিগব্যাশ লিগে, দক্ষিণ আফ্রিকার র্যাম-স্লাম লিগে, পাকিস্তানের পিএসএল কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজের সিপিএলে।যে বিস্ময় আর প্রতিভা নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে হাজির হয়েছেন মুস্তাফিজ, তাতে সবগুলো ফ্রাঞ্জাইজি ভিত্তিক লিগেই তিনি হবেন হটকেক। খেলতেও হয়তো যাবেন। তবে আমরা বাংলাদেশিরা আশা করবো, ‘মুস্তাফিজ তোমার আর ইংরেজি শিখে তথাকথিত স্মার্ট হওয়ার প্রয়োজন নেই। মাতৃভাষা বাংলাই তোমার শ্রেষ্ঠ সম্বল। তুমি তাকিয়ে দেখো, লিওনেল মেসি থেকে শুরু করে বিশ্বের নামকরা ফুটবলাররা নিজেদের মাতৃভাষাতেই কথা বলে। তাদের জন্য অন্যরা তাদের মাতৃভাষা শেখে। তুমিও যেখানেই যাবে, সেখানকার মানুষরা তোমার জন্য বাংলা শিখবে। শিখতে আগ্রহী হবে কিংবা বাধ্য হবে। ইংল্যান্ড থেকে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সবাই বাংলা শিখবে। এমনকি যারা আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল, সেই পাকিস্তানিরাও হয়তো একদিন দেখা যাবে তোমার জন্যই শুধু বাংলা শিখতে বসে গেছে। কারণ তুমি তো বাংলার প্রাণ, এই বাংলাদেশেরই ছেলে। তোমার কল্যাণে বাংলা হয়ে উঠুক বিশ্বময়।’লেখক : স্পোর্টস এডিটর, জাগো নিউজএইচআর/আরআইপি
Advertisement