শিক্ষা

ষাণ্মাসিক মূল্যায়নের প্রশ্ন ফেসবুক-ইউটিউবে, মিলছে সমাধানও

নতুন শিক্ষাক্রমে বদলে যাওয়া নিয়মে পরীক্ষার পরিবর্তে নেওয়া হচ্ছে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন। প্রথম দিনে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণিতে চারটি বিষয়ের মূল্যায়ন অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্কুলে স্কুলে শিক্ষার্থীদের বেশ উৎসবমুখর পরিবেশে এতে অংশ নিতে দেখা যায়। তবে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই আগের রাতে এ মূল্যায়নের নির্দেশিকা বা প্রশ্নপত্র হাতে পেয়েছে। প্রশ্নপত্রের আলোকে সমাধানও (কীভাবে কাজ করতে হবে) বাসায় বসেই শিখেছে শিক্ষার্থীরা। স্কুলে গিয়ে শুধু সেগুলো করে দিয়ে এসেছে তারা।

Advertisement

শিক্ষাবিদ ও শিক্ষকরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমের যে উদ্দেশ্য, তা এ ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নে প্রতিফলিত হয়নি। আগেই কী কাজ করতে হবে, তা শিক্ষার্থী জেনে সেটা আত্মস্থ করে স্কুলে এসেছে। এটা পরীক্ষায় অনেকটা নকল করার মতোই।

জানা গেছে, প্রথম দিনে ষষ্ঠ শ্রেণিতে বাংলা, সপ্তমে ধর্ম, অষ্টমে জীবন ও জীবিকা এবং নবম শ্রেণিতে ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ মূল্যায়নের জন্য যে প্রশ্নপত্র বা নির্দেশিকা শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়েছে, তা পরীক্ষার তিন ঘণ্টা আগে শিক্ষকদের ডাউনলোড করার কথা ছিল।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ষাণ্মাসিক মূল্যায়নের প্রশ্নপত্র একদিন আগেই শিক্ষকরা হাতে পেয়েছেন। তারা সেই প্রশ্নপত্র ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপে শেয়ার করেছেন, যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। প্রশ্নপত্র পেয়ে যাওয়ায় অনেক প্রাইভেট ও টিউশন শিক্ষক আগের দিনই তার সমাধান করে ফেসবুক ও ইউটিউবে ছড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে মূল্যায়নে বসার আগের রাতে কী কাজ করতে হবে, তা শিক্ষার্থীরা আত্মস্থ করে এসেছে।

Advertisement

আরও পড়ুন ষাণ্মাসিক মূল্যায়ন ৩ জুলাই, পদ্ধতিই জানেন না শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ‘ভালো-খারাপের বিশ্বাস ভেঙে দিতেই নতুন শিক্ষাক্রম’

ফেসবুকে শিক্ষকদের বিভিন্ন গ্রুপ, শিক্ষাবিষয়ক পেজ, শিক্ষকদের বিভিন্ন সংগঠনের নামে চালানো ফেসবুক পেজে একাধিক ব্যক্তিকে প্রশ্নপত্র শেয়ার করতে দেখা গেছে। অন্যদিকে ছড়িয়ে পড়া প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে তা নিয়ে ভিডিও তৈরি করেছেন অনেক কোচিং সেন্টারের শিক্ষকরা। অনেকে ইউটিউবে শিক্ষাবিষয়ক চ্যানেলে এ প্রশ্নের সমাধান প্রক্রিয়া কী হবে, তা আলোচনা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন।

ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা, নবমের ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞানের কিছু প্রশ্নপত্র ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করেন জাগো নিউজের এ প্রতিবেদক। বুধবার (৩ জুলাই) সকালে রাজধানীর দুটি স্কুলে সরেজমিনে গিয়েও একই প্রশ্নপত্রে মূল্যায়নে অংশ নিতে দেখা গেছে। ফেসবুকে ছড়ানো প্রশ্নপত্রের সঙ্গে অনুষ্ঠিত মূল্যায়নের প্রশ্নপত্রে হুবহু মিল পাওয়া গেছে।

আজিজুল ইসলাম নামে সিলেটের একজন অভিভাবক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার ছোট ভাই নবম শ্রেণির ছাত্র। আগের দিন তার বন্ধুরা প্রশ্নপত্র পেয়ে গেছে। আমি ছোট ভাইকে বলেছিলাম, সেগুলো যেন না দেখে। নিজের মতো করে প্রস্তুতি নিতে বলি। অথচ আজকে পরীক্ষা দিতে গিয়ে একই প্রশ্নপত্র পেয়েছে সে। অন্যরা আগেই প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়ায় তার চেয়ে ভালো করেছে। এটা স্পষ্ট বৈষম্য।’

 

রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরাও প্রশ্নপত্র হাতে পেয়েছেন। যেসব শিক্ষক প্রাইভেট পড়ান, তারাই মূলত শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের নিয়ে চালু করা গ্রুপে এ প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে দিয়েছেন। ভিকারুননিসার আজিমপুর শাখার সপ্তম শ্রেণির একজন ছাত্রীর মা নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগের রাতে শিক্ষকরা গ্রুপে প্রশ্ন দিয়ে দিয়েছেন। সেটা দেখে সবাই প্রস্তুতি নিয়ে স্কুলে গেছে। এভাবে প্রশ্নফাঁস করলে তো সবাই একই কাজ করবে। কারও কাজে ভিন্নতা থাকবে না।’

Advertisement

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের শামসুল হুদা দাখিল মাদরাসার শিক্ষক সোহেল কবীর ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে উল্লেখ করেছেন, আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি নাকি সুইডেনের সঙ্গে মিলিয়ে করা হয়েছে। আমার প্রশ্ন হলো- সুইডেনের শিক্ষার্থীরা কি পরীক্ষার আগের দিন অনলাইন থেকে প্রশ্ন ডাউনলোড করে ইউটিউব দেখে উত্তর দিয়ে শিক্ষকের মাধ্যমে মূল্যায়িত হয়?

যেভাবে ছড়ালো প্রশ্নপত্র বা মূল্যায়ন নির্দেশিকা

নৈপুণ্য অ্যাপে নির্দেশনা ছিল পরীক্ষার তিন ঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্র বা মূল্যায়ন নির্দেশিকা ডাউনলোড করা যাবে। তবে অনেক শিক্ষক আগেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রশ্নপত্র পাঠানোর দাবি করতে থাকেন। বেশি কিছু উপজেলা/থানা শিক্ষা অফিসে ধরনাও দেন তারা।

ওই শিক্ষকরা তখন জানান, তাদের স্কুলে প্রিন্টার না থাকায় সকালে প্রশ্নপত্র ডাউনলোড করে তা আবার ফটোকপি করা সম্ভব হবে না। এজন্য আগেই প্রশ্নপত্র দরকার। বিষয়টি বিবেচনা করে স্ব স্ব উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে আগেই তাদের প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়। সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র।

আরও পড়ুন থাকছে না জিপিএ-নম্বর, আসছে চিহ্নভিত্তিক মূল্যায়ন ‘পরীক্ষাবিহীন’ পড়াশোনায় আস্থা নেই অভিভাবকদের

তবে শুধু মফস্বলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নয়, রাজধানীর প্রায় সব স্কুলের শিক্ষকরাও আগেই প্রশ্নপত্র পেয়ে গেছেন। তাদের অনেকে বুঝে, অনেকে আবার না বুঝে প্রশ্নপত্র ফেসবুকে শেয়ার করেছেন।

ঢাকার একটি বেসরকারি স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির শ্রেণি শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, প্রশ্ন দেখে অনেকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেছেন। আমিও মজার ছলে প্রশ্নের দুটো পৃষ্ঠা ফেসবুকে দিয়েছিলাম। এটা দণ্ডনীয় অপরাধ জেনে আমি সেটা ডিলিট করে দিয়েছি।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের স্কুলের কোনো শিক্ষার্থী আগে মূল্যায়ন নির্দেশিকা (প্রশ্নপত্র) পায়নি। এমন কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেবো।’

জানতে চাইলে মাউশির মাধ্যমিক বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ জাফর আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রশ্নপত্র কখন শিক্ষকরা পাবেন, কীভাবে পাবেন; সেটা নিয়ে এনসিটিবি কাজ করেছে। তবে আমাদের নির্দেশনা ছিল প্রশ্নপত্র বা মূল্যায়ন নির্দেশিকা যেন ফাঁস না হয়। এটি করার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য এলে আমরা ব্যবস্থা নেবো। আগামী মূল্যায়নের দিনগুলোতে যেন এমন ঘটনা না ঘটে, সেদিকেও খেয়াল রাখা হবে।’

বিষয়টি নিয়ে জানতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামানের সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে মঙ্গলবার (২ জুলাই) রাতে তিনি জাগো নিউজকে বলেছিলেন, ‘যে মূল্যায়ন নির্দেশিকা (প্রশ্নপত্র) ফেসবুকে ছড়িয়েছে, সেটা সঠিক কি না, তা-ও নিশ্চিত হতে হবে।’

তাছাড়া নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতির প্রশ্ন আগে কেউ জেনে গেলেও দক্ষতা না থাকলে শিক্ষার্থীরা কিছু করতে পারবে না বলে মন্তব্য করেছিলেন তিনি।

প্রশ্নফাঁস হলেও তার প্রভাব নেই, দাবি শিক্ষামন্ত্রীর

এদিকে, নতুন শিক্ষাক্রমে প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও তাতে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। বুধবার রাজধানীর বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।

শিক্ষামন্ত্রীর ভাষ্য, ‘শিক্ষার্থীরা যদি আগে থেকে জানেও যে প্রশ্নপত্র কী হবে; তবুও তাতে কোনো গতি নেই। এখানে ফাঁস হওয়ার কোনো বিষয় নেই। প্রশ্নফাঁস করলেও সেটার কোনো উপকারিতা নেই। শিক্ষার্থীকে অবশ্যই কার্যক্রমে অংশ নিয়ে পারদর্শিতার স্তর অতিক্রম করতে হবে।’

এএএইচ/এমকেআর/জিকেএস