সবার জানা টিম বাংলাদেশে একঝাঁক ভিনদেশি কোচিং স্টাফ। হেড কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে, প্রধান সহকারী কোচ নিক পোথাস, পেস বোলিং কোচ আন্দ্রে অ্যাডামস, স্পিন কোচ মোশতাক আহমেদ, ব্যাটিং কোচ ডেভিড হ্যাম্প, ট্রেনার, ফিজিও আর কম্পিউটার অ্যানালিস্ট- গুনে গুনে আটজন বিদেশি কোচিং স্টাফ বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলে।
Advertisement
তাদের আগেও অনেকেই কাজ করে গেছেন এবং বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এই সাত-আটজন বিদেশি কোচের পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। এসব বিদেশি প্রশিক্ষক বিপুল পরিমাণ অর্থ পান। মোটা অঙ্কের টাকা বেতন নেন। জানা গেছে, এক হেড কোচ হাথুরসিংহের বেতনই মাসে ৩৫ লাখ টাকার বেশি। প্রধান সহকারীে কোচ, ব্যাটিং, পেস ও স্পিন বোলিং কোচের গড়পড়তা মাসিক বেতনও ১৫ থেকে ২০ লাখের মতো।
কিন্তু এসব বিদেশি কোচের সাফল্য কী? তাদের হাতের ছোঁয়ায় কোনো ক্রিকেটারের কী উন্নতি হয়েছে?
অনেকেরই মত, তুলনামূলক ভাবে দক্ষিণ আফ্রিকান সাবেক পেস বোলার অ্যালান ডোনাল্ডই বাংলাদেশের পেসারদের ঘষে-মেজে তৈরি করেছেন। তার টিপস আর দেখানো কৌশলে তাসকিন, মোস্তাফিজ, শরিফুল, এবাদত সবারই কম-বেশি উন্নতি হয়েছে। বলের ধার ও কারুকাজ বেড়েছে।
Advertisement
আর অন্য কারো কোচিংয়েই কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটেনি। কারো কোচিংয়ের কোনো নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যও চোখে পড়েনি। অতিবড় বাংলাদেশ সমর্থকও বলতে পারবেন না যে, অমুক কোচের কোচিংয়ে তমুক ক্রিকেটারের ব্যাটিং, বোলিং কিংবা ফিল্ডিংয়ের চোখে পড়ার মতো উন্নতি হয়েছে।
এমন নয় যে অমুকে আগে ব্যাকফুটে ভালো খেলতেন না, এখন নিক পোথাস বা মাঝে কাজ করে যাওয়া জেমি সিডন্স কিংবা অন্য কোনো ব্যাটিং কোচের ছোঁয়ায় এখন সামনের পায়ের পাশাপাশি ব্যাকফুটেও ভালো খেলেন। কিংবা অমুকের ‘ওই’ শটের ওপর দখল ছিল না, পুল, কাট কিং ফ্লিক ভালো খেলতেন না। কোচ আসার পর এখন খুব ভালো শিখেছেন। কিংবা অমুকের আর তমুকের ড্রাইভ শট ভালো হতো না, এখন তিনি ড্রাইভ ভালো খেলেন। আগে ভালো দৌড়াতে পারতেন না, একই অ্যাকশনে পিকআপ আর থ্রো করতে সমস্যা হতো, এখন তা অনায়াসে খুব ভালো পারেন- তেমন কোনো নজির কেউ দেখাতে পারবে না।
সর্বোপরি গেম প্ল্যান, উইকেট, কন্ডিশন আর প্রতিপক্ষ দলের শক্তি, ধরন দেখে কার্যকর কৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রেও নেই উন্নতি। আগেও বাংলাদেশ যে ছক, কৌশলে খেলতো, এখনও তাই খেলে। তাহলে এত টাকা ব্যয়ে একঝাঁক বিদেশি কোচ রেখে লাভ কি? তারা আসলে কী করেন? দলে তাদের কাজটা কী?
এ নিয়ে সবার কৌতূহল ও প্রশ্নের শেষ নেই। বিভিন্ন সময় এ সম্পর্কে অনেকেই মন্তব্য করেছেন। একঝাঁক ভিনদেশি কোচের পেছনে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় যে আসলে তেমন কোনো কাজে আসেনি বা আসেও না- সেটা জানা হয়ে গেছে।
Advertisement
আসলে এই কোচরা কী করেন? কেন তাদের একদমই আউটপুট পাওয়া যায় না? কেনইবা এত এত বিদেশি কোচের অধীনে কোনো উন্নতি হচ্ছে না? শুধু কি বিদেশি কোচদেরই ব্যর্থতা বা দোষ? নাকি স্থানীয় ক্রিকেটাররাও তাদের কথা শোনেন না বা বোঝেন না? নাকি আত্মস্থ করা সম্ভব হয় না?
জাতীয় দলের সাবেক প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু দিয়েছেন সে কৌতূহলী প্রশ্নের জবাব। দীর্ঘ প্রায় এক যুগ তিনি জাতীয় দলের সাথে ছিলেন। সেই ডেভ হোয়াটমোর, স্টুয়ার্ট ল, জেমি সিডন্স, হাথুরুসিংহেসহ সব বিদেশি কোচের সাথেই তিনি কাজ করেছেন। তার নিজের দেখা অভিজ্ঞতা থেকে নান্নু শুনিয়েছেন নতুন গল্প।
তার কাছে প্রশ্ন ছিল, ‘আচ্ছা! আপনি তো ১২-১৩ বছর জাতীয় দলের নির্বাচক ছিলেন, সব কোচিং স্টাফকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। সবার সম্পর্কে ভালো জানেন। এসব কোচের এত মোটা অঙ্কের টাকা বেতন দিয়ে রেখে লাভ কী? এতগুলো বিদেশি কোচ রাখা কী খুব দরকার?
জবাবে নান্নু বলেন, ‘আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল আর বিশ্ব পর্যায়ে স্ট্যান্ডার্ড মেনটেইন করতে হলে আপনাকে বিদেশি কোচের স্মরণাপন্ন হতেই হবে। বিদেশি কোচের কনসেপ্ট এখন আর নতুন বা অপ্রয়োজনীয় কিছু নয়। প্রায় দেশেই দেখেন এখন বিদেশি কোচিং স্টাফ আছে। আমি মনে করি না যে ভিনদেশি কোচ রাখার চিন্তা ভুল।’
তবে এটুকুই শেষ নয়। নান্নুর আসল কথা হলো, ‘আমরা বিদেশি কোচদের সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারছি কি না? তারা স্কিল ট্রেনিং করাতে পারছেন কি না? বা স্কিল ট্রেনিংয়ে যথেষ্ট সময় ব্যয় করছেন কি না? সেটা নিশ্চিত করা খুব জরুরি।’
নান্নু আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ‘সেই কাজগুলো হয়নি। হয় না। আমার জানা মতে, আমরা এমনভাবে কোচদের সাথে চুক্তি করি এবং তাদের কাজের ধরন ও গতি প্রকৃতি এমন যে, তাদের কাছ থেকে সেরাটা নেওয়ার ও পাওয়ার সুযোগই কম।’
সেটা কেমন? ‘বিদেশি কোচ নিয়ে আসি ঠিক আছে; কিন্তু এদের দিয়ে আরও বেশি কাজ করানো যায়। কিন্তু আমরা তা করাই না। করাতে পারি না। ভিনদেশি কোচদের যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয় না। আমরা ব্যবহার করতে পারি না। ন্যাশনাল টিম উন্নত করার জন্য বিদেশি কোচের দরকার আছে। কিন্তু এদের দিয়ে স্কিলের কাজ করিয়ে নিতে হয়। আমাদের ক্রিকেটারদের স্কিল ডেভেলপ করার জন্য ওসব স্পেশালিস্ট কোচের যথাযথভাবে ব্যবহার করা যায়; কিন্তু তা আমরা করতে পারি না।’
‘স্কিল ট্রেনিং করতে গেলে ভিনদেশি কোচদেরও তো একটা সুযোগ করে দিতে হবে। তারা তো আর ফরেন ট্যুরের আগে কিংবা হোম সিরিজ বা বড় বড় আসরের আগে বা সিরিজ চলাকালীন স্কিল ট্রেনিং করাবেন না। করানো সম্ভবও নয়। এসব স্কিল ট্রেনিং করাতে হয় অন্য সময়ে। যখন জাতীয় দলের কোনো অ্যাসাইনমেন্ট থাকে না, তখন ব্যক্তিগত পর্যায়ে ক্রিকেটারদের ওয়ান টু ওয়ান স্কিল ট্রেনিং করাতে হয়। কিন্তু তা হয় না।’
‘হবে কোত্থেকে? আমরা তো ফরেন কোচদের সে সুযোগই করে দেই না। তারা যখন হোম সিরিজ বা ফরেন ট্যুরে থাকে, তখনই কয়েক দিনের জন্য এসে জাতীয় দলের সাথে কাজ করেন। দেশে সিরিজ হলে থাকেন আর বিদেশ ট্যুর হলে জাতীয় দলের সাথে বাইরে চলে যান। অন্য সময় কোনো বিদেশি কোচ দেশেই থাকেন না, ছুটিতে চলে যান নিজ নিজ দেশে। একজন কোচও আমাদের দেশের ডমেস্টিক ক্রিকেট ফলো করেন না। কারেন্টজাতীয় দলের কার কী অবস্থা? তা চোখে দেখেন না।’
‘নতুন নতুন প্রতিভার উন্মেষ ঘটছে কি না? কেউ বেশি ভালো বা অতি মাত্রায় খারাপ খেললো কি না? কিছুই দেখেন না, জানেনও না। দেখা গেলো, সেই অফ ফর্ম প্লেয়ার দেশে কদিন নেট করে চলে গেলো বিদেশে। তখন কিন্তু আর তার সমস্যা সমাধানের সময় ও অবকাশ থাকে না। সে অফ ফর্মের প্লেয়ারই খেলতে থাকেন। আর অবধারিতভাবে খারাপ করেন। পরিণতি হয় খারাপ।’
‘এবারের বিশ্বকাপেও তাই হয়েছে। আসলে কোন সিরিজ, সফর আর টুর্নামেন্টের আগে ও পরে সময় নিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কাজ করতে হয়; কিন্তু প্রতিটি সিরিজ শেষে সব কোচ একত্রে দল বেঁধে চলে যান ছুটিতে। খারাপ ফর্ম আর টেকনিকে ত্রুটি থাকা ক্রিকেটারদের নিয়ে কাজ করার আর কেউ থাকেন না। এভাবেই চলছে দিনের পর দিন। মাসের পর মাস। বছরের পর বছর। তাই বিদেশি কোচদের সত্যিকার আউটপুট মিলছে না।’
এআরবি/আইএইচএস/