জাতীয়

শাহবাগ থানা সরলে ১ বছরেই শেষ হবে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্প

বারবার মেয়াদ বৃদ্ধি করেও শতভাগ শেষ হচ্ছে না ‘ঢাকাস্থ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ’ (তৃতীয় পর্যায়ের প্রথম সংশোধিত) প্রকল্পের কাজ। প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রধান বাধা শাহবাগ থানা। এরই মধ্যে শাহবাগ থানা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের বিপরীত দিকে সাকুরা রেস্তোরাঁ ও বারের পেছনে স্থানান্তর করার অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। সেই সঙ্গে প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। আইএমইডির পরিদর্শন রিপোর্টে এ প্রস্তাব করা হয়েছে।

Advertisement

আইএমইডির সেক্টর-১ এর সহকারী পরিচালক মো. জুলহাজ আলী সরকার গত ২ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ কাজ সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রকল্প পরিচালক ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। পরিদর্শন রিপোর্টে বলা হয়েছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবস্থিত শাহবাগ থানা, গারদখানা, কম্পিউটার রুম পুলিশের মাধ্যমে সরিয়ে নেওয়া হয়নি। শাহবাগ থানার নতুন ভবনও নির্মাণ করা হয়নি। এসব কারণেই প্রকল্প বাস্তবায়নে জটিলতা দেখা গেছে। রেসকোর্স গ্যালারির সংস্কার কাজ এবং ফুলের দোকান উচ্ছেদ করে নতুন দোকান নির্মাণ করা হয়নি। এসব কারণেই কাঙ্ক্ষিতভাবে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না প্রকল্পের কাজ। প্রকল্পের কাজ শতভাগ বাস্তবায়ন করতে হলে এসব স্থাপনা দ্রুত সময়ে সরিয়ে নিতে হবে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবস্থিত শাহবাগ থানা, গারদখানা, কম্পিউটার রুম পুলিশের মাধ্যমে সরিয়ে নেওয়া হয়নি। শাহবাগ থানার নতুন ভবনও নির্মাণ করা হয়নি। এসব কারণেই প্রকল্প বাস্তবায়নে জটিলতা দেখা গেছে।

প্রকল্পটির শুরু থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত আর্থিক অগ্রগতি ১৯২ কোটি ৪৫ লাখ ৭৪ হাজার টাকা, যা প্রাক্কলিত ব্যয়ের ৪৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ। তবে প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি ৮৩ শতাংশ। প্রকল্পের মোট ব্যয় ২৬৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।

Advertisement

আরও পড়ুন

শাহবাগ থানা ভবন যাচ্ছে সাকুরা রেস্তোরাঁর পেছনে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণে ফের ব্যয় ও সময় বাড়ছে বঙ্গবন্ধুর ১৯ ফুট উঁচু ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য হচ্ছে সোহরাওয়ার্দীতে মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব

আইএমইডির পরিদর্শনে উঠে এসেছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান সংক্রান্ত ভাস্কর্যের কাজ এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের ভাস্কর্য নির্মাণ কাজও সময়সাপেক্ষ। বর্তমানে এ দুটি ভাস্কর্যের ভৌত অগ্রগতি ৫০ শতাংশ। প্রকল্পের শিশু পার্কে র‌্যাম্পের ম্যুরাল সংযোজনের কাজটির ভৌত অগ্রগতি ১০ শতাংশ বিধায় ডিপিপিভুক্ত (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) সবগুলো কাজ সমাপ্ত করার স্বার্থে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত অর্থাৎ আরও এক বছর বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।

গলার কাঁটা শাহবাগ থানা-ফুলের মার্কেট

প্রকল্পের কাজ সঠিক সময়ে বাস্তবায়নের জন্য কিছু সুপারিশ দিয়েছে আইএমইডি। ৭ই মার্চের ভাষণসহ যে সব ভাস্কর্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি আছে সে সব ভাস্কর্যে জাতির পিতার সঠিক অবয়ব এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণের স্থান ও ইন্দিরা মঞ্চসহ সব ভাস্কর্য পূর্ণ সতর্কতার সঙ্গে যথাযথভাবে নির্মাণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে। বর্ধিত মেয়াদকালের কর্মপরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতি তিন মাস অন্তর আইএমইডিকে জানাতে হবে। প্রকল্প এলাকার বর্তমান নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয় বলে পরিদর্শনকালে প্রমাণিত হয়েছে। এজন্য যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

সবগুলো কাজ সমাপ্ত করার স্বার্থে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।

Advertisement

এ ব্যাপারে আইএমইডির সেক্টর-১ এর সহকারী পরিচালক মো. জুলহাজ আলী সরকার বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্প নির্মাণে প্রধান বাধা শাহবাগ থানা ও ফুলের মার্কেট। এসব স্থাপনা সরে গেলেই প্রকল্পের কাজ শতভাগ বাস্তবায়ন হবে। থানা সরানো নিয়ে সমস্যা ছিল। তবে এটা সমাধান হয়ে গেছে। থানা সরানো হলে ফুলের দোকানও সরে যাবে। বিষয়টি আমি রিপোর্টে তুলে ধরেছি। এছাড়া প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তাজনিত সমস্যা আছে। অনেক ভবঘুরে মানুষ এখানে নেশা করে। তাই নিরাপত্তা জোরদার করা জরুরি।’

স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরা, জাতীয় দিবসে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও কার্যক্রম সংগঠিত করা, যা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের চিরস্থায়ী স্মৃতি স্মরণ এবং বাংলাদেশের জনগণের মাঝে স্বাধীনতাযুদ্ধের মর্মস্পর্শী অনুভূতি পুরুজ্জীবিত করে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতের বর্ণনা এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ সংরক্ষণ করা; স্বাধীনতা স্তম্ভের ভূগর্ভস্থ জাদুঘরে বিভিন্ন ধরনের প্রদর্শনী স্থাপন, যা একনজরে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রতিফলিত করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার জন্য যে সব মহৎ প্রাণ মানুষ তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে তাদের বিভিন্ন মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা এবং দেশের মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরার পাশাপাশি মানসিক বিনোদনের সুযোগ দেওয়া।

আরও পড়ুন

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করে গ্লাস টাওয়ার দেশপ্রেমে প্রোজ্জ্বল শিখা চিরন্তন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পুরোটাই সংরক্ষণের দাবি সংসদে ১৯৯৮ সাল থেকে কাজ চলছে

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। প্রকল্পটির প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু হয় ১৯৯৮ সালে, শেষ হয় ২০০৭ সালে। প্রথম পর্যায়ে নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮১ কোটি ২৭ লাখ টাকা। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয়, শেষ হয় ২০১৪ সালে। তখন এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ১৮১ কোটি ৬১ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে তৃতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয়, শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৯ সালে। শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। এ সময়েও শেষ না হওয়ায় দ্বিতীয়বার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় আবার মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রকল্পের প্রথম দুই পর্যায়ে নির্মিত হয়েছে কাচের টাওয়ার, শিখা চিরন্তন, স্বাধীনতা জাদুঘর, ফোয়ারা, জলাধার ও উন্মুক্ত মঞ্চ। বর্তমানে শিশুপার্ক ভেঙে নতুন করে সাজানো হচ্ছে। তৃতীয় পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের স্থান, পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ স্থান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ স্থানসহ ১০টি স্থানে স্থাপনা হচ্ছে। এছাড়া হচ্ছে থিম পার্ক, ভূগর্ভস্থ পার্কিং, লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো, ফোয়ারা, মসজিদ, ওয়াকওয়ে, ফুড কিওস্ক, বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন ইত্যাদি।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভের তৃতীয় পর্যায়ের প্রকল্পের নির্মাণসংশ্লিষ্ট অধিকাংশ কাজ মূলত শাহবাগসংলগ্ন এলাকায়। প্রকল্প বাস্তবায়ন না হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ ও মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ভাস্কর্যের দৃশ্য ব্যাহত হবে। আবার এ প্রকল্প এলাকায় শাহবাগ থানা হওয়ায় এটি স্থানান্তর করা না হলে প্রকল্পটির নান্দনিকতা ফুটিয়ে তোলাসহ সার্বিক কার্যক্রমের সুষ্ঠু বাস্তবায়নে অসুবিধা হবে।

এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় গত মার্চে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দিয়েছিল। তাতে বলা হয়, স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের সুবিধার্থে প্রকল্প এলাকার অভ্যন্তর থেকে শাহবাগ থানা সরানো জরুরি।

শাহবাগ থানা সরবে কবে?

গত ৩ জুন মন্ত্রিসভার বৈঠকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকা থেকে শাহবাগ থানা সরিয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের পাশে রমনা মৌজার সাকুরা রেস্তোরাঁ এলাকায় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের জানান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পের কারণে ওখানে যে থানা আছে, সেটা স্থানান্তর করার দরকার ছিল। মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, থানাটা এখন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের উল্টো পাশে সাকুরার পেছনে যে জায়গাটা রয়েছে, সেখানে যাবে।

সাকুরা বার ভেঙে রমনা থানা ভবন হবে কি না- জানতে চাইলে মাহবুব হোসেন বলেন, ‘ম্যাপটা ওটার বাইরে কি না আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। রমনা মৌজার ৪৫ নম্বর দাগে ৩৯ দশমিক ৭০ শতাংশ জমি আছে, ওই জমিটা। সেটা সাকুরাসহ কি না, সেটা অবশ্য এখানে লেখা নেই।’

কত দিনের মধ্যে স্থানান্তর হবে, জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এখন সিদ্ধান্ত হয়েছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই হবে।

প্রকল্পের বিষয়ে বক্তব্যের জন্য যোগাযোগ করলে ‘ঢাকাস্থ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ’ প্রকল্পের পরিচালক (যুগ্মসচিব) প্রণব কুমার সাহা বলেন, ‘আপনাকে আমি চিনি না, আপনার সঙ্গে কীসের কথা বলবো?’ এই বলে প্রকল্পের বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি তিনি।

এমওএস/এমএমএআর/এএসএম