আগামীকাল সোমবার (১ জুলাই) ১০৪তম বছরে পদার্পণ করছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। ব্রিটিশ শাসন থেকে শুরু করে আজ অবধি দেশের মাটি ও মানুষের সবধরনের ক্রান্তিলগ্নে সামনের সারিতে থেকে পথের দিশা, আলোর ঝলকানি দেখিয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। বঙ্গভঙ্গের কারণে ক্ষুণ্ণ হওয়া পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার জন্য জন্ম নিয়ে পরে দেশভাগ থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, ৬ দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সব যৌক্তিক আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়।
Advertisement
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মতো বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী, আছে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো জগদ্বিখ্যাত পণ্ডিত। শুধু অতীতই নয়, বর্তমানেও বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তির তিন-চতুর্থাংশই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সেটা হোক রাজনীতি, অর্থনীতি, আমলা কিংবা ব্যবসায়। সর্বত্র আজও নেতৃত্বের স্থান ধরে রেখেছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু, এত প্রাপ্তির পরও যেন প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেন এখনো তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। শতপ্রাপ্তির মধ্যেও যেন সর্বত্রই শূন্যতা বিরাজমান।
শত বছর পরেও এখনো অনেক কিছু নেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের। নেই পর্যাপ্ত গবেষণা; গবেষণার জন্য নেই পর্যাপ্ত বরাদ্দ। একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজে ডিজিটালাইজেশন নেই, ফলে জটিলতারও শেষ নেই। আবার শিক্ষার্থী, সাবেক শিক্ষার্থী ও পুরো দেশবাসীরও এ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে প্রত্যাশার শেষ নেই।
দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘তরুণ প্রজন্মের দক্ষতা উন্নয়নে উচ্চশিক্ষা’। এ উপলক্ষে দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। দিনটি সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৩ বছরের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশাসহ নানান প্রসঙ্গে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষাবিদদের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। সেখানে আলোচনায় দীর্ঘদিনের পথচলায় প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার মেলবন্ধনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তারা।
Advertisement
বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. মাহমুদ হাসান বলেন, ১০৩ বছরের দীর্ঘ এ সাফল্য-ব্যর্থতার পথে বাংলাদেশ তথা পুরো বিশ্বে জ্ঞানী এবং আলোকিত মানুষ তৈরির ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য। একজন সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে এ আনন্দঘন দিনে আমার প্রত্যাশা থাকবে শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের সর্বোত্তম উষ্ণ সম্পর্কের পথ বেগবান করা। এ সম্পর্কের ওপর ভর করেই যেন প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় শুধু শিক্ষকদের জন্যই নয়, শিক্ষার্থীদের গবেষণার ধারণাও বাস্তবে পরিণত করতে প্রয়োজনীয় বাজেট এবং সুযোগ-সুবিধা দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, গত ১০৩ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের জন্য উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মোচন করেছে। যখন এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয় তখন বাঙালি মুসলমান সমাজে উচ্চশিক্ষার হার খুবই কম ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই দ্বার উন্মোচন করেছে। নারীশিক্ষায় একটা অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বিশ্ববিদ্যালয় বাঙালি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজের গোড়াপত্তন করেছে, যে সমাজ জনগণের অধিকার সচেতন। তারা অনেক আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন এবং তাদের নেতৃত্বেই ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনকালে একটি রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়া- এটি বিশ্বের আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই।
বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিল্প ও সংস্কৃতি জগতে বিশাল আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সংস্কৃতির অধিকার আমাদের মুসলমানদের সেই অর্থে ছিল না। বাঙালি সংস্কৃতির গোড়াপত্তন বহু আগেই হয়েছিল, কিন্তু তার বিকাশ এবং আধুনিকায়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই সম্পন্ন হয়েছে। আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে দেশের স্বার্থসুরক্ষার জন্য বিভিন্ন সময় যে পথগুলো উন্মুক্ত হয়েছে তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমেই হয়েছে। এখনো প্রতিবাদী কোনো আন্দোলন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমেই থাকে। গণজাগরণ মঞ্চসহ সব আন্দোলনের জন্যই শাহবাগ মঞ্চ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটাও তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই সৃষ্টি।
‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিশন ও মিশনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একাডেমিক ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান এবং ফিজিক্যাল মাস্টারপ্ল্যান প্রস্তাব করা হয়েছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তা বাস্তবায়িত হলে ২০৩৫ সালের মধ্যে এ বিদ্যাপীঠ উচ্চতর গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হবে।’— ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল
Advertisement
সামনের দিনে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে প্রত্যাশার কথা জানিয়ে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে আমি বিশ্বাস করি না। পশ্চিমে আমাদের যাওয়ার দরকার আছে কিন্তু সেদিকে জিম্মি করার কোনো মানে নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এতদিন যে কাজ করে এসেছে সেগুলোকে আরও বেশি শানিত, বেশি অর্থবহ ও কার্যকর করতে হবে, যাতে উচ্চশিক্ষার দ্বার সব মানুষের জন্য উন্মুক্ত থাকে। সাংবিধানিক যে দায়িত্ব, একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনতে হবে। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়াতে হবে। তাদের গবেষণার জন্য যত বরাদ্দের প্রয়োজন দিতে হবে। এবার মাত্র ২০ কোটি টাকা গবেষণায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধ্য ছিল না।
‘সরকারের উচিত হবে, শিক্ষায় বরাদ্দ তো বাড়াবেই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণার জন্য বিশাল একটা অঙ্কের বরাদ্দ দিতে হবে। আমি চাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা মানসম্মত হোক, যাতে পশ্চিমও এ গবেষণা সহজভাবে ধারণ করতে পারে। আমি চাই, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসুক।’ বলেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
আরও পড়ুনঢাবির সিনেট অধিবেশনে ‘একনায়কতন্ত্র’ নিয়ে বিতর্কঢাবির পূর্বাচল ক্যাম্পাসে হবে বিশ্বমানের মেডিকেল ফ্যাকাল্টিদেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণে নানান উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল। গত ২৬ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট অধিবেশনে উপাচার্য বলেন, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩টি অনুষদ, ৮৪টি বিভাগ, ১৩টি ইনস্টিটিউট, ৬০টি গবেষণা সেন্টার ও ব্যুরো রয়েছে। এছাড়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭টি অঙ্গীভূত ও উপাদানকল্প কলেজের অধীনে শিক্ষা-কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। প্রতি বছর উন্নয়ন বাজেটের সীমাবদ্ধতা, জনবলের ঘাটতি ও দক্ষতার অভাব এবং গবেষণা যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতার কারণে এ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার মান রক্ষা করা বড় চ্যালেঞ্জ। অতীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বিভাগ খোলার ক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রয়োজনীয়তা অনেক ক্ষেত্রেই বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। বিভাগ অনুযায়ী শিক্ষার্থীসংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রে অনেক সময় যৌক্তিকতা প্রাধান্য পায়নি। নানা কারণে একাডেমিক অসামঞ্জস্যও বিদ্যমান।
উপাচার্য বলেন, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিশন নির্ধারণ করেছি ‘ক্রিয়েট এ ওয়ার্ল্ড-ক্লাস এডুকেশন ইকোসিস্টেম দ্যাট ইনাবেল ইনডিভিজুয়াল টু অ্যাক্ট এজ ডায়নামিক হিউম্যান ক্যাপিটাল অ্যান্ড এথিকাল লিডারস ফর এ সাসটেইনেবল ফিউচার’। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিশন এবং এ সম্পর্কিত মিশনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একাডেমিক ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান এবং ফিজিক্যাল মাস্টারপ্ল্যান প্রস্তাব করা হয়েছে। এ দুটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। একাডেমিক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ২০৩৫ সালের মধ্যে এ বিদ্যাপীঠ উচ্চতর গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হবে, যা কার্নেগির শ্রেণিবিভাজন অনুযায়ী আরটু বিশ্ববিদ্যালয়। এ ধারাবাহিকতায় ২০৪৫ সালের মধ্যে এটি রূপান্তরিত হবে গবেষণা-প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে, যা কার্নেগির বিভাজনে আর-ওয়ান বিশ্ববিদ্যালয়।
আরও পড়ুনছাত্র প্রতিনিধি ছাড়াই শুরু হলো ঢাবির সিনেট অধিবেশনসাইয়েদ আব্দুল্লাহর অ্যাকাউন্ট স্থগিত করেছে ফেসবুক‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অবস্থান আর থ্রি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমতুল্য, অর্থাৎ গবেষণা থেকেও পাঠদানকে এখানে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রস্তাবিত একাডেমিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নকালে অনেক বিভাগের শিক্ষার্থী-সংখ্যা যৌক্তিক পর্যায়ে আনা হবে। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী কিছু নতুন বিভাগও খোলা হবে। ভৌত অবকাঠামোগত পরিকল্পনা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হলে আধুনিক গবেষণাগারসহ একাডেমিক ফ্লোর স্পেস ২৭ লাখ ৫৩ হাজার ৭০০ বর্গফুট থেকে বাড়িয়ে ৫৯ লাখ ৯৪ হাজার ৩০০ বর্গফুট করা হবে। লাইব্রেরির সুবিধা দেড় হাজার থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার করা হবে এবং নারী শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধা ৩৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭০ শতাংশে উন্নীত করা হবে। মাস্টারপ্ল্যানে প্রদর্শিত ভবনগুলো বহুতলবিশিষ্ট হওয়ায় সেগুলোর ফুটপ্রিন্ট ২৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২২ শতাংশ করা হবে। ফলে সবুজ চত্বর ও উন্মুক্ত স্থান বাড়বে।’
ড. মাকসুদ কামাল আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান এবং ফিজিক্যাল মাস্টারপ্ল্যানের ফেজ-১ সংক্রান্ত অবকাঠামো উন্নয়নের একটি প্রকল্প এরই মধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে বিবেচনাধীন। সেখানে শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল, একাডেমিক ভবন ও আধুনিক লাইব্রেরি নির্মাণ এবং উন্নতমানের গবেষণাগার স্থাপনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পূর্বাচল ক্যাম্পাসের জমি পেলে সেখানে একটি বিশ্বমানের মেডিকেল ফ্যাকাল্টি গঠন করা হবে।
এমএইচএ/এমএএইচ/এমএমএআর/জেআইএম