চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপারের প্রাদুর্ভাবে দেশজুড়ে দেখা দিয়েছে সাপ আতঙ্ক। এতে নড়েচড়ে বসেছে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও। সাপে কাটা রোগীর সুচিকিৎসা নিশ্চিতে গত বছরের তুলনায় এবার দ্বিগুণ অ্যান্টিভেনম কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
Advertisement
সাপে কাটা রোগীর প্রধান প্রতিষেধক অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন। দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে যেটার সরবরাহ চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। সরকারই শুধু এটা কিনে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে সরবরাহ করে। বেসরকারিভাবে দেশের কোনো ফার্মাসিউটিক্যালসের বাইরে বিক্রির তথ্য নেই।
এছাড়া শুধু বাড়তি অ্যান্টিভেনম কেনা নয়, এতদিন সাপের দংশনে আক্রান্ত রোগীর সঠিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে ঢিলেমি থাকলেও দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার হাসপাতাল থেকে সঠিক পরিসংখ্যান দ্রুত সংগ্রহেও গুরুত্ব দিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
সবশেষ অর্থবছরে ২০ হাজার ভায়াল ইনজেকশন সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে সাড়ে ১৮ হাজার ভায়াল ইনজেকশন দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা হাসপাতালে সরবরাহ করা হয়েছে। বর্তমানে মজুত মাত্র দেড় হাজার ভায়াল ইনজেকশন। শিগগির আরও ৫ হাজার ভায়াল ইনজেকশন সংগ্রহে যুক্ত হবে।- স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এনসিডিসি শাখার ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. নোসায়ের চৌধুরী
Advertisement
এতদিন সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দাবি, সাপের দংশনের শিকার রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়েনি। তবে চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার সাপের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও সাপ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একসময় সাপের প্রকোপ বাড়লে সাপ মেরে ফেলাকে সমাধান মনে করা হতো। কিন্তু বর্তমানে এটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। তাছাড়া পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই সাপ মেরে ফেলা সমাধান নয়, বরং সাপের দংশন থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ অনুসরণ ও ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তোলা প্রয়োজন।
সাপের দংশনে আক্রান্ত, মৃত্যু ও সুস্থ রোগীর সরকারি পরিসংখ্যানস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (ই-হেলথ) ও হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ড. জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘চলতি বছর সারাদেশে মোট ১৩৬ জন সাপের দংশনে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে মারা গেছেন ২৯ জন। সরকারি হাসপাতাল থেকে ১৭ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। বাকি ১২ জনের মৃত্যুর খবর বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানা যায়। আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন ১০৭ জন।’
মৃত্যুবরণকারীরা রাসেলস ভাইপার কিংবা অন্য কোনো সাপের দংশনে মারা গেছেন কি না এ তথ্য তাদের কাছে নেই বলে তিনি জানান।
Advertisement
২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাসেলস ভাইপারসহ সব ধরনের সাপের দংশনের রোগীদের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বছরজুড়ে ধাপে ধাপে সারাদেশে মোট ২৫ হাজার ডোজ অ্যান্টিভেনম সংগ্রহ ও বিতরণ করার কথা ছিল। এর মধ্যে সরকারি এসেনসিয়াল ড্রাগ কোম্পানি (ইডিসিএল) থেকে ১৫ হাজার এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে পাওয়ার কথা ছিল ১০ হাজার ভায়াল অ্যান্টিভেনম।
আরও পড়ুন
ল্যাবরেটরি করলে দেশেই অ্যান্টিভেনম উৎপাদন করা সম্ভব সাপখেকো প্রাণীর অস্তিত্ব সংকটে বেড়েছে রাসেলস ভাইপার সাপে কাটা রোগীকে অভয় দিন, নড়াচড়া করতে দেবেন নাস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ (এনসিডিসি) শাখার ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. নোসায়ের চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘সবশেষ অর্থবছর (জুলাই ২০২৩ থেকে জুন ২০২৪) ২০ হাজার ভায়াল ইনজেকশন সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে সাড়ে ১৮ হাজার ভায়াল ইনজেকশন দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা হাসপাতালে সরবরাহ করা হয়েছে। বর্তমানে মজুত মাত্র দেড় হাজার ভায়াল ইনজেকশন। শিগগির আরও ৫ হাজার ভায়াল ইনজেকশন সংগ্রহে যুক্ত হবে।’
তিনি জানান, আগামী অর্থবছর (জুলাই ২০২৪ থেকে জুন ২০২৫) থেকে শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে ৩০-৪০ হাজার ভায়াল অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন কেনা হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাধ্যমে অতিরিক্ত অ্যান্টিভেনম পেলে তা হবে উপরি পাওয়া।
এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তার দাবি, সাপের দংশনের রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়েনি। কীভাবে নিশ্চিত হলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) শাখার অধীনে হেলথ ইমার্জেন্সি অ্যান্ড ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার শাখার মাধ্যমে বিভিন্ন রোগব্যাধির তথ্য-উপাত্র সংগ্রহ করা হয়। তাদের কাছ থেকে সাপের দংশনের রোগী বেড়েছে এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। আর আমরা পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারি রাসেলস ভাইপারের সংখ্যা বেড়েছে। সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি প্রাণিসম্পদ বিভাগের কাজ।’
রাসেলস ভাইপার মারাত্মক বিষধর সাপ কি না জানতে চাইলে ডা. নোসায়ের চৌধুরী বলেন, ‘অন্য বিষধর সাপের তুলনায় রাসেলস ভাইপার তুলনামূলক কম বিষধর। কারণ অন্য বিষধর সাপে নিউরো টক্সিকের পরিমাণ অনেক বেশি হলেও রাসেলস ভাইপারে তুলনামূলক কম। তবে অন্য সাপ দংশন করলে নমুনা ও উপসর্গ দ্রুত দেখা গেলেও এক্ষেত্রে অনেক পরে দেখা যায়। ততক্ষণে রোগীর শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।’
অন্য সাপ মানুষের উপস্থিতি টের পেলে দ্রুত সরে গেলেও এ সাপ সরে যায় না। জায়গায় বসে আওয়াজ করতে থাকে বলেও জানান তিনি।
প্রথম শনাক্তের ১১ বছর পর বিস্তৃতি ঘটেছে রাসেলস ভাইপারেরচট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত ভেনাম রিসার্চ সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল থেকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে একজন সাপে কাটা রোগী আসে। অজগর সাপের বাচ্চা মনে করে ধরতে গেলে সাপটি ওই রোগীকে দংশন করে। পরবর্তীসময়ে বিশেষজ্ঞরা সাপটি রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া হিসেবে শনাক্ত করেন।
২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত দেশের ২৭ জেলায় এ সাপের বিস্তৃতি ঘটেছে। বিশেষ করে পদ্মা নদী ও তার শাখা নদীর তীরবর্তী জেলাগুলোতে এর বিস্তার ঘটেছে সবচেয়ে বেশি।
২০১৮ সালের এক গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে ১১ জেলায় (নীলফামারী, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট ও চট্টগ্রাম) একসময় রাসেলস ভাইপারের বিস্তৃতি থাকলেও ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত নতুন ছয়টি জেলাসহ শুধু নয়টি জেলায় (দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, রাজবাড়ী, চুয়াডাঙ্গা ও পটুয়াখালী) রাসেলস ভাইপারের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল।
শুধু নিশ্চিত তথ্য যেমন সংগ্রহ করা সাপ, দংশনের শিকার রোগী ইত্যাদি থেকে ভেনম রিসার্চ সেন্টারের গবেষকদের করা ২০২৩ সালের গবেষণাপত্রের তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহী বিভাগের বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ ব্যতীত ছয়টি জেলা: ঢাকা বিভাগের রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মানিকগঞ্জ, ঢাকা ও মুন্সিগঞ্জ; খুলনা বিভাগের কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা জেলা, চট্টগ্রাম বিভাগের চাঁদপুর, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলা, বরিশাল বিভাগের পিরোজপুর ব্যতীত বাকি পাঁচটি জেলায় রাসেলস ভাইপারের উপস্থিতি নথিভুক্ত করা হয়।
২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত আরও চারটি জেলায় (যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ ও মেহেরপুর) এ সাপের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। প্রথম শনাক্তের ১১ বছর পর রাসেলস ভাইপারের বিস্তৃতি ঘটেছে।
রাসেলস ভাইপার বিস্তৃতির কারণজলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাপের আবাসস্থল ধ্বংস, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বন্যার পানি ও কচুরিপানার সঙ্গে নদীর পানির বিস্তার, গুঁইসাপ, বেজি, পেঁচা, চিল, বাজপাখির মতো শিকারি পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে এর বিস্তার ঘটছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সাপ বিশেষজ্ঞ বলেন, এ সাপের প্রকোপ ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে। কারণ জানতে চাইলে তারা বলেন, এ সাপের প্রজননক্ষমতা খুব বেশি। একসঙ্গে ৩০-৪০টি বাচ্চা হয়। অন্য সাপের বাচ্চা খুব বেশি বেঁচে না থাকলেও এগুলো বেশির ভাগই বেঁচে যায়। ফলে দিন দিন সংখ্যা বাড়তে থাকে। ভবিষ্যতে পাহাড়ি অঞ্চল ছাড়া দেশের সর্বত্র এ সাপের বিস্তৃতি ঘটতে পারে।
সাপ দেখলে যা করণীয়>>অযথা ভয় পাবেন না, সাপটিকে চলে যেতে দিন।
>>সাপ স্বেচ্ছায় মানুষকে দংশন করে না, সুযোগ দিলে সাপ সরে যাবে। কেবল আত্মরক্ষায় কিংবা উত্ত্যক্ত করলে সাপ মানুষকে দংশন করে।
>>অনাবশ্যক সাপ মারবেন না, কারণ সাপ কীটপতঙ্গ ও ছোট ছোট প্রাণীদের নিয়ন্ত্রণে রেখে মানুষের উপকার করে ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।
এমইউ/এএসএ/এএসএম