গরমের দিনে শীতের চাদর, ছুঁড়ে ফেলেন বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী। দাউ দাউ করে আন্দোলনের আগুন জ্বলছিলো নয়াপল্টনে বিএনপি অফিসের সামনে- রিজভী সাহেবের সেই চাদর থেকে। দাবি ছিলো-ভারতীয় পণ্য বর্জনের। বর্জনের আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল মাস ছয় আগে। রাজপথে সেই আন্দোলন দানা বাঁধতে পারেনি। একসময় অতি উৎসাহীগণ ফসবুকে টুকটাক পোস্ট দিয়ে আন্দোলনের অস্তিত্ব ঘোষণা করছিলেন। সেটাও ঝিমিয়ে যেতে যেতে এখন সেই আন্দোলন পুরোদস্তুর ইতিহাসের বিষয়।
Advertisement
বাঁক বদলের চেষ্টা চোখে পড়ে ২৫ জুন মঙ্গলবার। সেই আন্দোলনের দ্বিতীয় দফার ঘোষণা দিলেন- বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম। জানালেন, ভারতের সঙ্গে সম্প্রতি সম্পাদিত চুক্তির প্রতিবাদে তারা আন্দোলন করতে যাচ্ছেন।
চাদর পোড়ানোর আন্দোলনে কেউ গামছাও পোড়ায়নি। এবার অবশ্য একটু ভিন্ন মাত্রা চোখে পড়ে। বিএনপি যেদিন ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত সমঝোতা-চুক্তির প্রতিবাদের কথা বলছিলো, সেদিনই অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হেফাজতে ইসলাম ও একটি ক্ষুদ্র বাম দলও বলেছে, দেশটা ইজারা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা প্রতিবাদ করছেন।
ইতোমধ্যে বিএনপি’র বক্তব্য থেকে জানা গেছে, বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক জিয়ার সঙ্গে তাদের দলের সিনিয়র নেতাদের বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত হয়েছে, ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির বিরুদ্ধে তারা আন্দোলনে যাচ্ছেন। তবে এবারের আন্দোলন চাদর পোড়ানো ভারতীয় পণ্য বর্জনের মতো ভারত বিরোধিতা নয়। এটাও তারা জানিয়ে দিয়েছেন। তারা আন্দোলন করবেন, সরকারের বিরুদ্ধে।
Advertisement
প্রশ্ন আসতেই পারে,ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির বিরোধিতা করা কিভাবে ভারত বিরোধিতা নয়? অন্যদিকে তাদের ভারত বিরোধিতার লাগাতার ভাবনাটাও কি দূরে ফেলা হয়েছে? চাদর পোড়ানোর ঘটনাও কিন্তু ভারত বিরোধিতার নতুন কিছু ছিল না। এখনও যা করা হচ্ছে তাও তাদের জন্য নতুন কিছু নয়।
অথচ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত ১০ সমঝোতা-চুক্তির মধ্যে পুরনো চুক্তির নবায়ন যেমন আছে নতুনও আছে। নতুন যা হয়েছে রেল ট্রানজিট নিয়েই হৈচৈ বেশি হচ্ছে। কিন্তু রেল ট্রানজিট বিষয়ে মাত্র সমঝোতা চুক্তি হয়েছে। অর্থাৎ দুটি দেশই সম্মত হয়েছে যে, বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে ভারত তাদের এক অংশ থেকে অন্য অংশে পণ্য পরিবহন করার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। কিভাবে আসা-যাওয়া করবে, বাংলাদেশ এই সুবিধাদানের বিনিময়ে কী পাবে, ভারতও কিভাবে এই সুযোগ গ্রহণ করবে এসব বিস্তারিত থাকবে চুক্তিতে।
তারপরও কথা আসে,বাংলাদেশ থেকে ট্রানজিট সুবিধা কি নতুন? আগরতলা থেকে কলকাতা যাওয়ার সুযোগসহ বেশকিছু ক্ষেত্রেই সুবিধা বিদ্যমান। মংলা বন্দর ব্যবহার করে এই সুবিধা সম্প্রসারণ হবে এমন কথাও বহুকাল আগে থেকেই শোনা যাচ্ছে।যাই হোক এই সুবিধাপ্রদানের বিনিময়ে বাংলাদেশের পাওয়ার বিষয়টি অবশ্যই জোরালোভাবে আলোচনা হতে পারে। সেক্ষেত্রে বিরোধী দলের চাপ কিংবা দাবি দেশের জন্য ইতিবাচক হিসেবেই গণ্য হতে পারে। পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে ১০ ট্রাক অস্ত্র পরিবহনের মতো কোনো ঘটনা যাতে না ঘটতে পারে তেমন বিষয়গুলো বিরোধী দলের পক্ষ থেকে আলোচনা হতে পারে।
মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশ-ভারত ট্রেন চলাচল নতুন বিষয় নয়। পাঁচটি রুটে এখনই রেলযোগাযোগ রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি যাত্রীবাহী ও দুটি আছে পণ্যবাহী। নতুন চুক্তিতে নতুন দিক হচ্ছে, ভারতের ট্রেনগুলোই বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে তাদের দেশের অন্যপ্রান্তে যাবে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় ভারতের পণ্য ভারতীয় রেল মাধ্যমে আমাদের সীমান্তে আসে সেখানে আমাদের রেলে সেগুলো আবার ভারতীয় অন্য সীমান্ত এলাকায় পৌঁছায়।
Advertisement
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তাদের কোনো ট্রেন ঢুকছে না। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আমাদের দেশের ট্রেনে সেগুলো স্থানান্তর হয়ে থাকে। এবারের চুক্তি অনুযায়ী ভারতীয় ট্রেন বাংলাদেশে ঢোকার সুযোগ পাচ্ছে। বিদ্যমান ট্রানজিট সুবিধার বিনিময়ে বাংলাদেশ যা পাচ্ছে তা নিয়ে আগেও সমালোচনা হয়েছে। প্রতিটন পণ্যের জন্য ৩০০ টাকা অবশ্যই এই বাংলাদেশের স্বার্থের জন্য সামান্যই বলা চলে। তবে এই উদ্যোগের কারণে যে বাংলাদেশের দাবির সুযোগ প্রসারিত হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্তত মাশুলের হার বাড়ানোর সুযোগ তৈরির বিষয়টি স্বীকার করতে হবে।
বাংলাদেশের পক্ষে যেমন যুক্তি আছে আবার ভারতের মাশুল দেওয়ার বিষয়টিতেও আছে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে তাদের পণ্য পরিবহনের সুযোগ তৈরি হলে তাদের পণ্য পরিবহন ব্যয় কমবে। সেক্ষেত্রে তাদের ব্যয় যদি ১ হাজার টাকা কমে যায়, তারা অনায়াসে ৫০০ টাকা মাশুল দিতেই পারে। এতে করে তাদের সাশ্রয়ের সুযোগ যেমন সম্প্রসারিত হবে তেমনি বাংলাদেশের প্রাপ্তিরও পরিমাণ বাড়বে। দুইপক্ষের কারোই লোকসান গুণতে হবে না।
সমালোচকদের অনেকেই পণ্য পরিবহনের নামে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটতে পারে কি না তা নিয়ে ভাবছেন। এই ভাবনাও অমূলক নয়। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে যেভাবে সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ভারতীয় অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার হুমকি তৈরি করছে এবং সেদেশের সরকারও যে এ বিষয়ে প্রতিকারের ব্যবস্থা নিচ্ছে সেটা সবারই জানা।
ভারত যদি বাংলাদেশের রেললাইন ব্যবহার করতে চায়, তাহলে সড়ক ও রেললাইন সংস্কার করতে হবে। দীর্ঘ রেললাইন সংস্কার করতে যে অর্থ প্রয়োজন হবে, তা কি ভারত বাংলাদেশকে দেবে? কিংবা তাদের মাধ্যমেই কি রেলপথ সংস্কার করা হবে? সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশ থেকে ভারত যদি সুবিধা গ্রহণ করে বিনিময়ে বাংলাদেশকেও ন্যায্য সুবিধা দিতে হবে। দেশের স্বার্থ জড়িত আছে এমন দাবি বিএনপি করতেই পারে।
রেল ট্রানজিট ছাড়া বাকি যেসব বিষয়ে সমঝোতা ও চুক্তি হয়েছে বেশিরভাগই নবায়নের আওতায়। যা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর নয় বলে প্রমাণিত।তারা আলোচনায় এনেছেন তিস্তা চুক্তি বিষয়ে। অমীমাংসিত এই সমস্যাটি সমাধানে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আন্তরিকতা প্রমাণিত। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী এই সমস্যা সমাধানে প্রতিবন্ধক হিসেবে চিহ্নিত অনেক আগে থেকেই।
অভিন্ন নদীগুলোর সমস্যা সমাধানে ভারতের রাজ্যগুলোর মর্জির ওপর সাফল্য নির্ভর করে এটা আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি। ভারতে কেন্দ্র ও রাজ্যের এই রশি টানাটানির কারণে ছিটমহল সমস্যা সমাধানে লেগেছে অর্ধশতাব্দী। এই টানাটানি হ্রাসের ক্ষমতা তাদেরই আছে। বাংলাদেশ কি রাজ্য সরকারের সঙ্গে কোনো চুক্তি করতে পারে? পারে না। এই সমস্যাগুলো ভারতের কেন্দ্রীয় রজ্যসরকারই মীমাংসা করা দরকার।
বাংলাদেশ তার নিজস্ব স্বার্থ দেখবে এটা স্বাভাবিক। এই বিষয়ে দেশের সরকারি ও বিরোধী দলের ঐকমত্য থাকবে এটাও স্বাভাবিক। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে যদি একান্তই রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের চেষ্টা করা হয়, তখন দেশের স্বার্থ উদ্ধারের বিপরীতটাই হতে পারে। বিএনপি যখন প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে তিস্তা চুক্তি কিছুই হয়নি বলে দোষারোপ করে তখনই তাদের অতীত প্রসঙ্গটি চলে আসে।
তাদের ক্ষমতাকালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দিল্লী গিয়ে গঙ্গা পানি চুক্তির বিষয়টি ভুলে গিয়েছিলেন বলে সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পেয়েছিল। তিস্তার পানির হিস্যা বিষয়েও তারাও কিছু করতে পারেনি। তবে তারা পেরেছে একমুখো ভারত বিরোধিতা করে যেতে। এখনও তাই করছে। দেখার বিষয় হচ্ছে- এবারের ভারত বিরোধিতার রাজনীতিও কি চাদর পোড়ানোর মতো আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে পড়বে কিনা।
ভারতের প্রসঙ্গ এলেই সেই পুরনো কায়দায় তাদের বলতে শোনা যায়- দেশ বিক্রি করে দিচ্ছে। আর এই আওয়াজটা বিএনপি জন্মলগ্ন থেকেই করে আসছে। বছরের পর যদি দেশটা বিক্রি হতে থাকে এখন তো বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকার কথা নয়। কোথায় বিক্রি হলো তাও কি দেখাতে পারবেন?
ওই যে ভিন্নরকম বলা হয়েছিলো, সেটা আলোচনায় আসতে পারে। রাজনীতিটা অন্তত দেশের প্রয়োজনে হোক, রাজনীতিটা রাজনীতিতেই সীমিত থাকুক, এতেই কল্যাণ সবার।
লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।
এইচআর/এমএস