মতামত

সিলেটে বন্যা এখন বড় আতঙ্কের নাম

এতদিন মনে করা হতো বড় বড় নদী যেমন পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ইত্যাদি বিধৌত এলাকায় শুধু নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলগুলোতে ভয়াবহ বন্যা হয়। কিন্তু সেই ধারণা ভুল। কয়েক বছর যাবত পাহাড়ি এলাকার খরস্রোতা নদীগুলোতে হঠাৎ এবং অকাল বন্যা হবার সংখ্যা বেড়ে গেছে। এখন পাহাড়ি উঁচু এলাকাতে এবং সিলেট ও চট্টগ্রাম শহরে ঘন ঘন ভয়াবহ বন্যা হচ্ছে। গত ২০২২ সালে সিলেট বিভাগে চৈত্রমাসে হাওড়ে ঢলের পর বৈশাখে সিলেট নগরেও বন্যার পানির প্রবল স্রোতে শুরু হওয়ায় জনমনে নানা আশঙ্কার চিন্তা শুরু হয়েছিল। এবছর (২০২৪) সিলেট বিভাগের গ্রাম-শহর মিলে প্রায় অর্ধকোটি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

Advertisement

সাধারণত: সিলেট অঞ্চলে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ কম হয়ে থাকে। কিন্তু এবছর মে ২৬ থেকে জুনের ১৬ তারিখ পর্যন্ত মাত্র ২০ দিনের ব্যবধানে দুইবার পাহাড়িঢল ও প্রবল বন্যায় ব্যাপক ফসলহানির পর নগরের রাজপথে ও আবাসিক এলাকায় এত বন্যার পানি দেখে মানুষ বেশ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ঢলের পানিতে চোখের পলকেই ভেসে যাচ্ছে জমির ফসল, ডুবে যাচ্ছে রাস্তা-ঘাট, ঘরবাড়ি। জুনের ২০ তারিখ পর্যন্ত সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ১২৩টি ওয়ার্ড এবং বিভাগের বিভিন্ন জেলার মোট ১৫৬৮টি গ্রাম ডুবে গেছে। রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে বন্যাক্রান্তদের। সুনামগঞ্জের মানুষ আনেকটা দিশেহারা হয়ে আশ্রয়শিবিরে চলে যাচ্ছেন।

বিগত ২০২২ সালে আসামের চেরাপুঞ্জিতে ২০৪ মি:মি: বৃষ্টিপাত এবং সুনামগঞ্জের পাশের মেঘালয়ের পাহাড়ি এলাকায় খাসিয়া বসতিতে অবিরাম বর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। সেটা ১২২ বছরের বৃষ্টিপাতের রেকর্ড ভেঙ্গেছিল। এছাড়া জকিগঞ্জ দিয়ে উজানে আসামের অতিবৃষ্টির পানি বরাক নদী দিয়ে সুরমা-কুশিয়ারায় নেমে এলেও তারা তা ধারণ করতে পারেনি। এবছর চেরাপুঞ্জিতে ৬০০-১০০০ মি: মি: বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। আসামের বিভিন্ন জেলায় ১৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। সেখানকার অতিরিক্ত পানি ফুল ফেঁপে নিচে বাংলাদেশের দিকে দ্রুতগতিতে ধাবিত হওয়ায় সুরমা-কুশিয়ারা ছাড়াও সারি, মনু, ধলাই নদীগুলোর কেউই সেই পানিকে ধারণ করে সময়মত মেঘনায় ফেলতে পারেনি। পানির উচ্চতার চাপে স্রোতের তোড়ে সবকিছু ছাড়িয়ে পানির কলকল শব্দ ছুটছে শহর-বন্দর, মাঠ-ঘাট পেরিয়ে নিন্মাঞ্চলের দিকে।

এর ফলস্বরুপ সিলেট অঞ্চলে ঘটছে প্রবল বন্যা। থামছে না উজানের ঢলের পানির স্রোতে সেই সংগে বানভাসি মানুষের কষ্ট ও কান্নার আওয়াজ শুরু হয়েছে। ভাসছে সিলেট শহর, সিলেট বিভাগের সিংহভাগ এলাকা টানা বৃষ্টি ও ঢলের পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। চা-বাগানের পাশে পাহাড়ের পাদদেশে শুরু হয়েছে পুন:পুন কান্নার আওয়াজ।

Advertisement

অনবরত উজানের পানির স্রোত আসছেই। গত সাত দিনেও বন্যার কোনো উন্নতি হয়নি, বরং এলাকায় পানির উচ্চতা বেড়েছে। সিলেট নগরীতে লক্ষ লক্ষ মানুষ পানিবন্দী হয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন। গত ৬ মে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার কাজে অংশ নেয়ার জন্য সিলেটে গিয়েছিলাম। শাহজালাল উপশহরের অভিজাত এলাকায় আমার একজন প্রাক্তন ছাত্র ও কলিগের বাসা। সেখানে এক গেট-টুগেদারে কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তির সংগে সিলেটের বর্তমান আবাসিক পরিবেশ নিয়ে কথা হচ্ছিল। একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয় বলছিলেন উপশহর আবাসিক এলাকা বেশ সাজানো-গুছানো। কিন্তু ২০২২ সালের পর থেকে বর্তমানে আমরা সবসময় বন্যাতঙ্কে থাকি। একটু বৃষ্টি হলেই এখানকার রাস্তা পানিতে তলিয়ে যায়।

বিশেষ করে উপশহর তৈরি হয়েছে অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকার জমি ভরাট করে। এই এলাকার বৃষ্টির পানি সুরমা নদীতে ঠিকমতো গড়িয়ে যেতে না পারলে সবার আগে উপশহরবাসীরা বন্যাক্রান্ত হয়ে পড়ে। আমরা ভয়ে থাকি কখন সীমান্তের ওপাড় থেকে ঢল নামে। মেঘালয় ও আসামে ভারী বৃষ্টিপাত হলে তার দু’ একদিন পরে আমাদের প্রিয় শহরে পানি ঢুকে যায়। উজানে অতিবৃষ্টির খবর শুনলে উপশহরের বিভিন্ন ভবনের নিচতলাবাসীরা রাতে ঘুমানোর সময় চিন্তা করেন সকালে ডুবন্ত ঘর থেকে ঠিকমতো মালামাল বের করতে পারবেন তো? একমাস না পেরুতেই সে আশঙ্কা সত্যি হয়ে গেছে

সিলেটের এই অস্বাভাবিক রেকর্ডব্রেকিং বন্যার কারণগুলো বহুমুখী এবং সেগুলো নীতিনির্ধারকদের কাছে মোটেই অজানা নয়। প্রাকৃতিক কারণে উজানের পাহাড়ে অতিবৃষ্টি একটি নিয়মিত ঘটনা। কারণ, আসামের চেরাপুঞ্জিতে সর্বাধিক বৃষ্টিপাত ঘটে সেটা শিশুকালে আমরাও স্কুলের বইয়ের তথ্য থেকে জানতে পেরেছিলাম। চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হলে সেই পানি সুরমা-কুশিয়ারার গভীর স্রোতের মধ্য দিয়ে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র মেঘনা হয়ে বঙ্গপোসাগরে চলে যেত। তাই আগেকার দিনে মানুষ বন্যার কথা নিয়ে বেশী একটা ভাবতো না। আজকাল প্রাকৃতিক অতিবৃষ্টি ছাড়াও উন্নয়নের ডামাডোলে ভেসে গেছে চারদিক।

হাওড়ের বুক চিঁড়ে রাস্তা তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন সিলেটে ঘন ঘন বন্যার কারণ নেত্রকোনার ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়কের কারণে উজানের পানি স্বাভাবিকভাবে ভাটিতে গড়াতে না পারা। মেঘালয়ের পানি হাওড়ে এস জমা হয়ে দ্রুত নদী দিয়ে নামতে পারে না। ফলে সিলেট পর্যন্ত গড়িয়ে গ্রাম-শহর ভেসে যায়।

Advertisement

সিলেটের সুরমা নদী বৃষ্টি, বন্যা ও ঢলের পানির চাপ সহ্য করতে অপারগ। সেই অনুযায়ী পানি নিষ্কাষণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখেনি। অধিকিন্তু শহরের নিকটস্থ প্রাকৃতিক জলাধার, লেক, বিল-ঝিল, পুকুর ভরাট করে ফেলা হয়েছে। সুনামগঞ্জের হাওড়ে অনেকগুলো পকেট রোড তৈরী করা হয়েছে। সিলেট শহর সংলগ্ন প্রাকৃতিক রিজার্ভার নেই, প্লাবনভূমি নেই। উপশহর বানানো হয়েছে নিচু প্লাবনভূমি ভরাট করে।

পাশাপাশি সিলেটের ড্রেনেজ সিস্টেম অনেকটা সংকুচিত করে নতুনভাবে রাস্তা সম্প্রসারণ করা হয়েছে। অপরদিকে সিলেটের উজানে আসাম ও মেঘালয়ের বিভিন্ন জেলায় উন্নয়নকাজের জন্য পাহাড় কেটে রাস্তা, অফিস, বাঁধ ও বাড়িঘর নির্মাণ করতে গিয়ে ব্যাপকভাবে পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। গতবছর সিকিমের বাঁধভাঙ্গা বন্যার সময় দেখা গেছে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে সুড়ঙ্গ করে রাস্তা তৈরীতে ব্যাপকভাবে বালু, পাথর গড়িয়ে তিস্তা নদীতে পড়ে নাব্য নষ্ট করে তলদেশ ভরাট করে দিয়েছিল। একইভাবে উজানের বালু, কাদামাটি, উন্নয়ন কাজের ডেবরিজ এসে সিলেট এলাকার সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, সারি ইত্যাদি নদীর তলদেশ ভরাট করে তুলেছে।

সেদিকে আমাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। এসব নদী ঠিকমতো ড্রেজিং করা হয়নি। ফলে উজানে আতিবৃষ্টি বা একটু ভারী বৃষ্টিপাত হলে সেই পানি নদী ধারণ করতে পারছে না। শহরের অগভীর ও সংকুচিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও পাশের অগভীর নদী মিলে খুব সহজেই বন্যার পানি দুই কূল ছেপে জনবসতিতে ঢুকে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করে তুলছে প্রতিবছর, বিভিন্ন মাসে বার বার। এটাই গত কয়েক বছর যাবত সিলেটবাসীর চরম নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এতদিনে সুরমার দুই তীরে একটি উঁচু বাঁধও নির্মিত হয়নি, দখলদারদেরকে সরানো যায়নি। প্রতিবছর ঢল শুরু হলে বিপদের আশঙ্কায় অসহায় মানুষ বাঁশ, বালি, কাদামাটির ডালি নিয়ে অসহায়ের মতো বাঁধ রক্ষার্থে ছুটাছটি শুরু করে। কৃষাণীরা দল বেঁধে তাদেরকে সহায়তা করতে এসে কিছু না পেরে আর্তনাদ করতে থাকে। এদৃশ্য কি আমরা প্রতিবছর বোরো মৌসুমে টিভিতে করুণভাবে প্রত্যক্ষ করে যেতেই থাকব? এজন্য কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি স্থানীয়দের।

হিমালয়ের ভাটিতে অবস্থান করায় উজানের পানির তোড় সামাল দেয়া আমাদের নিয়তি। বন্যা, অকাল বন্যা, ‘ফ্লাশফ্লাড’ ইত্যাদি প্রতিরোধের জন্য আমাদেরকে আগাম সতর্কবার্তা নিয়ে কৃষিপরিকল্পনা ঢেলে সাজাতে হবে। বিশেষ করে দেশের উত্তর ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত নদীগুলোর ব্যাপারে ডেল্টা প্লানে অতিজরুরি ভিত্তিতে খরা মৌসুমে সেচ ও হঠাৎ পাহাড়ি ঢলের নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ ধারা ও সতর্কতা সংযুক্ত করতে হবে। কারণ ভাবতে হবে বন্যা মানেই আমাদের খাদ্যশস্য নষ্ট ও খাদ্য ঘাটতি। কৃষির উন্নয়নই আমাদের প্রকৃত উন্নয়ন কিন্তু প্রতিবছর বার বার বন্যার আক্রমণ আমাদের কৃষি ও কৃষকদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়।

প্রতিবছর কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে যাবার পর আমাদের কর্তৃপক্ষের তোড়জোর শুরু হয়। কিন্তু আমরা সময় থাকতে সেসব ব্যবস্থা নিতে ঢিলেমী করি কেন? সরকারী সম্পদের অপচয় রোধ করতে সময়ের কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সমাপ্ত করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সেটা করতে না পারায় দেশের অন্যান্য প্রকল্পের মতো দুর্নীতির বেড়াজালে বন্দী হয়ে থাকবে হাওড়ের সর্বশান্ত প্রান্তিক চাষীদের ফিবছরের বোবা কান্না। সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনার হাওড় ছাড়া সারা দেশের কৃষি ও কৃষকদেরকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য গভীরভাবে ভাবতে হবে।

পাশাপাশি রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা, ফরিদপুর, চাঁদপুর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর প্রভৃতি বন্যাপ্রবণ শহরগুলোকে ভয়াবহ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এসব শহরের চতুর্দিকে যথপোযুক্ত শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। সেগুলোর ভৌত কাজ শীতের শুরুতেই আরম্ভ করে বর্ষা মৌসুম আসার পূর্বে সমাপ্ত করার জন্য তৎপরতা চালাতে হবে। কারণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ কাজে আমাদের চিরায়ত ঢিলেমি এবং যারপরনাই উদাসীনতা প্রতিবছর বন্যার ক্ষয়ক্ষতিকে আরো বেশী উস্কে দেবার নামান্তর মাত্র।

পুনঃ পুনঃ বন্যা ও ভয়াবহ নদীভাঙ্গন থেকে কৃষি অর্থনীতিকে বাঁচাতে না পারলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে বেশিদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আসাম ও শিলং-এর অতিবৃষ্টি যখন বার বার সিলেটবাসীর কান্না হয়ে ফিরে আসে তখন এই বিভীষিকা রোধ করতে সুরমা-কুশিয়ারাকে একটি নতুন পরিকল্পনায় খনন ও দুই পাড় সংস্কারে যুক্ত করে দ্রুত বাস্তবায়নের কাজে হাত দেয়া উচিত।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। fakrul@ru.ac.bd

এইচআরর/এমএস