জাতীয়

গুনে শেষ করা যায় না ফয়সালের সম্পদ!

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রথম সচিব আবু মাহমুদ ফয়সালের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধানে তার স্ত্রী আফসানা জেসমিন, শ্বশুর আহম্মেদ আলী ও শাশুড়ি মমতাজ বেগমসহ আত্মীয়স্বজনের নামে প্রায় ২০ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে।

Advertisement

এরই মধ্যে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ফয়সাল ও তার আত্মীয়স্বজনের নামে থাকা প্লট ও ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালত। আদালতের আদেশে ফয়সালের ১১ জন আত্মীয়স্বজনের নামে থাকা ১৯টি ব্যাংক হিসাব ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৮৭টি হিসাব অবরুব্ধ করা হয়েছে। বাড়ি, ফ্ল্যাট ও ব্যাংক হিসাব- সবমিলিয়ে প্রায় ১৭ কোটি টাকা মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ জব্দের আদেশ দেওয়া হয়েছে।

দুদক সূত্র বলছে, সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে ফয়সালের শ্বশুর-শাশুড়ির ব্যাংক হিসাবে। ফয়সালের ১১ স্বজনের নামে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। ফয়সাল অপরাধলব্ধ আয় লুকানোর জন্য স্বজনদের নামে ৭০০টির মতো ব্যাংক হিসাব খুলেছিলেন।

আদালতে জমা দেওয়া দুদকের নথি বলছে, ফয়সালের শ্বশুর আহম্মেদ আলী অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা। তার শাশুড়ি মমতাজ বেগম গৃহিণী।

Advertisement

আরও পড়ুনএনবিআরের প্রথম সচিবের ফ্ল্যাট-সঞ্চয়পত্র জব্দের আদেশএনবিআরের পদ থেকে সরানো হলো মতিউরকে

দুদক সূত্র জানায়, ফয়সাল ঘুস ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ নিজের ও স্ত্রীর নামে রাখার পাশাপাশি স্বজনদের নামেও রেখেছেন। শ্বশুর ও শাশুড়ির নামের ব্যাংক হিসাবে যে অর্থ লেনদেন হয়েছে, তা রাজস্ব কর্মকর্তার অপরাধলব্ধ আয়। বদলি বাণিজ্যের মাধ্যমে শতকোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন ফয়সাল। তার ঘুস ও দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান করছে দুদক।

শ্বশুরের নামে ৬ কোটি টাকার ফ্ল্যাট, শাশুড়ির নামে ৫ কোটি টাকার জমি

রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিপরীতে অবস্থিত রূপায়ন স্বপ্ন নিলয় ভবন। প্রায় ৮৫ কাঠার ওপর নির্মিত চারটি ভবনের একটির ১১ তলায় থাকেন ফয়সাল ও তার পরিবার। গত বছরই রূপায়নের ফ্ল্যাটটি শ্বশুরের নামে কেনেন তিনি। দুই হাজার ৯৯০ স্কয়ার ফুটের ফ্ল্যাটটির বাজারমূল্য প্রায় ৬ কোটি টাকা। তবে কাগজে-কলমে ফ্ল্যাটটির মূল্য দেখানো হয়েছে ৯৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আহম্মেদ আলী কীভাবে এত সম্পদের মালিক হয়েছেন তা নিয়ে অনুসন্ধান করছে দুদক।

এই ভবনে শ্বশুরের নামে ফ্ল্যাট কিনেছেন আবু মাহমুদ ফয়সাল

ফয়সালের শাশুড়ি মমতাজ বেগম গৃহিণী হলেও ঢাকার মেরাদিয়ায় কিনেছেন ১০ কাঠা জমি, যার বাজারমূল্য প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা। যদিও নথিতে মমতাজ বেগম জমির মূল্য দেখিয়েছেন মাত্র ৫২ লাখ টাকা।

Advertisement

স্ত্রী জেসমিনের নামে রয়েছে ভাটারা থানার বড় কাঁঠালদিয়া মৌজায় ৫ কাঠা জমি, এর বাজার মূল্য তিনি দেখিয়েছেন ১৮ লাখ ১৭ হাজার টাকা। তবে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এই জমির বাজারমূল্য প্রায় ৭৫ লাখ টাকা। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ নতুন শহরে রয়েছে সাড়ে ৭ লাখ টাকার জমি।

ফয়সালের নামে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জের ৫ জায়গায় প্রায় সাড়ে ১৫ কাঠা জমি রয়েছে। এসব জমির মূল্য তিনি দেখিয়েছেন ৪০ লাখ ২৯ হাজার টাকা। সূত্র বলছে, খুলনার খান সবুর রোডের মুজগলিতে একাধিক বাড়ি ও বিপুল পরিমাণ সম্পদ কিনেছেন ফয়সাল।

আরও পড়ুনফেনীতে শাশুড়িকে ডুপ্লেক্স বাড়ি বানিয়ে দেন ‘ইফাতের বাবা’ মতিউরআমরা সর্বগ্রাসী হয়ে গেছি, চাই চাই আরও লাগবে: পরিকল্পনা সচিব

আদালতে জমা দেওয়া দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফয়সালের নামে ছয়টি ব্যাংক হিসাবে ৫ কোটি ২১ লাখ টাকা রয়েছে। ফয়সালের স্ত্রী আফসানা জেসমিনের ৫টি ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এছাড়া ফয়সালের শ্বশুর আহম্মেদ আলীর আটটি ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে ১১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। যার মধ্যে ছয়টি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে ২০২০ ও ২০২৩ সালের মধ্যে, বাকি দুটি খোলা হয়েছে ২০০৭ ও ২০১০ সালে। ফয়সালের শাশুড়ি মমতাজ বেগমের নামে ১০টি ব্যাংক হিসাবে ৭ কোটি টাকা ও শ্যালক আফতাব আলীর ছয়টি ব্যাংক হিসাবে ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা জমার তথ্য পেয়েছে দুদক।

দুদকের প্রতিবেদনে, ফয়সালের স্ত্রী আফসানা জেসমিন, ফয়সালের ভাই কাজী খালিদ হাসান, শ্বশুর আহম্মেদ আলী, শাশুড়ি মমতাজ বেগম, শ্যালক আফতাব আলী, খালাশাশুড়ি মাহমুদা হাসান, মামাশ্বশুর শেখ নাসির উদ্দিন, আত্মীয় খন্দকার হাফিজুর রহমান, রওশন আরা খাতুন ও ফারহানা আফরোজের ব্যাংক হিসাবে লেনদেনের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এসব টাকা জমা হয়েছে। পরে তার বড় অংশ তুলে নেওয়া হয়েছে। জমা ও উত্তোলনের পর ফয়সাল ও তার স্বজনদের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হিসাবে থাকা অর্থের পরিমাণ প্রায় ৭ কোটি টাকা। তাদের নামে ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রও রয়েছে।

এনবিআরের এই কর্মকর্তা ২০০৫ সালে বিসিএস (কর) ক্যাডারে সহকারী কর কমিশনার হিসেবে যোগ দেন। নারায়ণগঞ্জ ট্যাক্স জোনের জয়েন্ট কমিশনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে এনবিআরের আয়কর বিভাগের প্রথম সচিব (ট্যাক্সেস লিগ্যাল অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন ফয়সাল।

২০২২ সাল থেকে ফয়সালের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন তিনি।

সম্প্রতি নতুন করে আরও কয়েকটি নথিযুক্ত করে ফয়সালের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করে দুদকের তিন সদস্যের একটি টিম। যার টিমলিডার দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আরিফ হোসেন। টিমের অন্য দুই সদস্য হলেন সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজ ও উপসহকারী পরিচালক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন সম্রাট।

এসএম/ইএ/জেআইএম