সাম্প্রতিক সময়ে বারবার বন্যা আক্রান্ত হচ্ছে সিলেট। খুব কম সময়ে বানের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। বানের পানি ঢুকে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা দেয় সিলেট নগরীতেও। ঘন ঘন আকস্মিক বন্যার কারণ হিসেবে কেউ দায়ী করছেন ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ককে আবার কেউ দায়ী করছেন এ অঞ্চলের নদ-নদীর নাব্যতা সংকটকে। তবে ঘুরেফিরে বারবারই সুরমা নদী খননের প্রশ্ন উঠছে। এ নিয়ে জাগো নিউজের তিন পর্বের প্রতিবেদনের আজ রয়েছে শেষ পর্ব।
Advertisement
সিলেট অঞ্চলের সবচেয়ে দীর্ঘ নদী সুরমা। সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার আমলশীদ থেকে নদীটি জন্ম নিয়ে ২৪৯ কিলোমিটার অতিক্রম করে মেঘনাতে মিশেছে। মাঝপথে উন্নয়নের নামে প্রমত্তা এই নদীর ৩৫ কিলোমিটার আদি প্রবাহপথ ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল সেই ১৯৬২ সালেই। পরে কৃত্রিমভাবে খনন করে সুরমাকে নেওয়া হয়েছিল নতুন পথে।
উন্নয়নের নামে আদি সুরমাকে ‘মেরে ফেলা’ হলেও তা এখনও বেঁচে আছে কোনোমতে। শুধু বেঁচে থাকাই নয় সুরমার অনেক জল বুকে ধারণ করে খাজাংচি নদীতে নিয়ে যাচ্ছে এই পুরান সুরমা। কিন্তু দখল, দূষণ ও ভরাট হয়ে যাওয়ায় এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে পুরান সুরমা। নদীখেকোদের তাণ্ডবে প্রমত্তা সুরমা এখন আকারে একটি খালের চেয়েও ছোট। যার ফলে আগের মতো পানি পরিবহন করতে পারছে না এই নদিটি।
আরও পড়ুন-
Advertisement
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাজাংচি নদীর সঙ্গে সংযোগ করে পুরান সুরমাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে সিলেট নগরী এবং সদর ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলাকে বন্যার হাত থেকে অনেকাংশে রক্ষা করা সম্ভব। পুরান সুরমা সিলেট সদর উপজেলার ধনপুর এলাকা থেকে কান্দিগাঁও ইউনিয়ন থেকে দক্ষিণ দিকে ঘাষিগাঁও হয়ে বর্তমান খাজাঞ্চি বাজার পর্যন্ত গিয়ে পশ্চিম দিকে মোড় নিয়েছে। সেখানকার মোড় থেকে সুরমার অন্যতম আরেক শাখা খাজাংচি নদী যাত্রা শুরু করে যেটি সদর, বিশ্বনাথ ও ছাতকের উপর দিয়ে ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ছাতকের দুলার বাজার ইউনিয়নে ডাউকা নদীতে পতিত হয়েছে। সুরমার আদি প্রবাহপথ খাজাঞ্চিগাঁও থেকে আবার উত্তর দিকে কাবিলপুর, হাজারীগাঁও হাউসা পয়েন্টের কাছে পশ্চিমে মোড় নেয়। এটাই সুরমার মূল, প্রাকৃতিক বা আদি প্রবাহপথ। বর্তমানে স্থানীয়দের কাছে এটি পুরাতন সুরমা নামে পরিচিত।
সরেজমিনে সিলেট সদর উপজেলার টুকেরবাজার ধনপুর এলাকায় পুরান সুরমার উৎসমুখ থেকে বিশ্বনাথ উপজেলার খাজাঞ্চি পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে, প্রমত্তা সুরমার (পুরান সুরমা) দু’পাশ দখল হতে হতে ছোট একটি খালে পরিণত হয়েছে। ধনপুর থেকে খাজাঞ্চি পর্যন্ত একই অবস্থা। স্থানীয়দের কাছে এটি পুরান সুরমা নামে পরিচিত থাকলেও এটি যে একময়ের প্রমত্তা সুরমা ছিল তা দেখে বোঝার উপায় নেই।
কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো- মরে যাওয়ার পরও বেঁচে যাওয়া সেই পুরান সুরমাকে দফায় দফায় গলাটিপে হত্যার চেষ্টা চলছে। দখল-দূষণে প্রমত্তা সুরমাকে খালে পরিণত করেও থামছে না নদীখেকোরা। বছর তিনেক আগে সুরমার তীর ঘেঁষে পুরান সুরমার ‘বুকে’ সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৫০টি ঘর নির্মাণ করা হয়। এরপর গত বছর আরও ২০৩টি ঘর নির্মাণ করা হয় পুরান সুরমার ‘বুকে’। পুরান সুরমার উৎসমুখ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রয়েছে লাল টিনের ছোট ছোট শত শত ঘর। সরেজমিনে দেখা গেছে, সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়ন থেকে শুরু করে গোবিনপুর, মীরপুর হয়ে খাজাঞ্চি ইউনিয়ন পর্যন্ত দখল দূষণে ভরাট হয়ে গেছে পুরান সুরমা।
স্থানীয়রা জানান, শুকনো মৌসুমে পুরান সুরমার উৎসমুখ মুখ বন্ধ হয়ে যায়। হেঁটে পারাপার করেন স্থানীয়রা। তবে বর্ষা মৌসুমে এটি দিয়ে সুরমার অনেক পানি প্রবাহিত হয়। আরও পড়ুন-
Advertisement
ধনপুর গ্রামের প্রবীণ বশারত আলী ও মাহমুদ আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘পুরান সুরমাই’ মূল সুরমা। পাকিস্তান আমলে খাজাঞ্চি রেলওয়ে স্টেশন ও সিলেট-ছাতক রেলপথকে ভাঙন থেকে রক্ষা করতে ধনপুর থেকে হাউসা পর্যন্ত খনন করে নদীকে ওইদিকে নিয়ে যাওয়া হয়। যার কারণে পুরান সুরমা আলাদা হয়ে যায়।
তারা আরও বলেন, পুরান সুরমা আগের মতো নেই। যে যেভাবে পারছে দখল করে বসতি গড়ে তুলছে। যার কারণে এটি ভরাট হয়ে ছোট খালে পরিণত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরান সুরমাকে খনন করে দক্ষিণের খাজাংচি নদীর সঙ্গে সংযোগ করে দিলে সুরমার অনেক চাপ কমে যাবে। এতে করে সিলেট নগরী ও সদর উপজেলা বন্যার প্রকোপ থেকে অনেকাংশে রক্ষা পাবে।
এ ব্যাপারে সেভ দ্যা হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’র প্রধান সমন্বয়ক ও গবেষক আব্দুল হাই আল হাদী বলেন, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের হাতে সুরমা বন্দি হওয়ার খবর জানলেও পাকিস্তানিদের হাতেও যে সুরমা বন্দি হয়েছিল, পঙ্গুত্ব লাভ করেছিল সেটি জানা ছিল না। উন্নয়নের নামে রেলপথ রক্ষার অজুহাতে প্রমত্তা সুরমার প্রায় ৩৫ কিলোমিটার কীভাবে পঙ্গু করে কৃত্রিমভাবে প্রবাহিত করা হয়েছিল। এতে করে খাজাংচি নদীকে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক ধরে তেমুখী পয়েন্ট থেকে হাউসা পয়েন্ট পর্যন্ত সড়কের দক্ষিণ দিকে বয়ে চলা সুরমার যে প্রবাহ বর্তমানে রয়েছে, সেটি প্রকৃতপক্ষে সুরমার আদি ও প্রাকৃতিক প্রবাহ নয়। এটি কৃত্রিমভাবে খনন করা। ১৯৫৪ সালের অক্টোবর মাসে সিলেট-ছাতক রেল যোগাযোগ চালু হয়। এ রেল পথটি খাজাঞ্চি এলাকায় খাজাংচি নদীর ওপর নির্মিত সেতু দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েক বছর পর দেখা গেলো যে, এ অংশে সুরমার ভাঙন খুব বেশি। রেল কর্তৃপক্ষ সেই ভাঙন থেকে রেলপথ ও সেতুকে রক্ষার ব্যাপারে সম্ভাব্য বিকল্প খুজঁতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত সুরমা নদী তাদের চোখে পড়লো এবং সেটিকে কোরবান দেওয়ার জন্য উদ্যোগী হলো। অবশেষে ১৯৬২-৬৩ সালের তারা সেই কাজ শুরু করে। বলি হতে থাকে সুরমা। মাসুকের বাজার থেকে জাঙ্গাইল পর্যন্ত খনন করে নদীর বাঁকা অংশকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। আবার ধনপুর থেকে হাউসা পর্যন্ত অংশে খনন করে নদীকে আদিপথ থেকে এদিকে প্রবাহিত করা হয়। আদি প্রবাহপথের মুখগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, এভাবে একটি রেলপথকে বাঁচানোর নামে সুরমা নদীকে তার প্রাকৃতিক পথ থেকে সরানো হলো অত্যন্ত নির্দয়ভাবে। এতে এখানে মূল প্রবাহপথের প্রায় ৩০-৩৫ কিমি পথের ভূপ্রাকৃতিক পরিবর্তন ঘটেছে, একইসঙ্গে নদীনির্ভর জীবন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আরও পড়ুন-
‘কচুয়ারপাড়’ যেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপসুরমার বর্তমান প্রবাহ চলুক তবে আদি প্রবাহপথ খুলে দিতে হবে। প্রয়োজনে সেটিকে খাজাংচি নদীর সঙ্গে সংযোগ করে দিয়ে সুরমার চাপ কমাতে হবে। এতে করে সিলেট নগরীর জলাবদ্ধতা অর্ধেক কমে যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, সিলেটের ইকো সিস্টেমে একটি নদীর পানি শাখা নদী, খাল, হাওর, বিল হয়ে আরেকটি নদীতে যাচ্ছে। এটা প্রকৃতিরই সৃষ্টি। কিন্তু এসব খননের অভাবে ভরাট ও দখল হয়ে যাওয়ায় সুরমার পানির চাপ অন্যদিকে প্রবাহিত হচ্ছে না। এতে করে বারবার বন্যা আক্রান্ত হচ্ছে সিলেট।
তিনি বলেন, সিলেটে নদী খনন কোনো সময়ই ভালোভাবে হয়নি। কোনো প্রকল্পই ঠিকাদার ও প্রকৌশলীর দুর্নীতির কারণে আলোর মুখ দেখছে না। এজন্য নদী খনন প্রকল্প মনিটরিংয়ের জন্য স্থানীয় ব্যক্তি ও প্রকৃত নদী প্রেমীদের নিয়ে একটি টিম গঠনের দাবি জানান তিনি। সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, সাম্প্রতিক বন্যায় সিলেটের সুরমাসহ ২০টি নদী ও খাল খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে পুরান সুরমা খননও পরিকল্পনায় রয়েছে। ফিজিবিলিটি স্টাডির রিপোর্ট আসার পর অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। অনুমোদন পেলেই কাজ শুরু হয়ে যাবে।
এফএ/এএসএম