দেশজুড়ে

খাল ভরাটের দোষও সুরমার ঘাড়ে

সাম্প্রতিক সময়ে বারবার বন্যা আক্রান্ত হচ্ছে সিলেট। খুব কম সময়ে বানের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। বানের পানি ঢুকে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা দেয় সিলেট নগরীতেও। ঘন ঘন আকস্মিক বন্যার কারণ হিসেবে কেউ দায়ী করছেন ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ককে আবার কেউ দায়ী করছেন এ অঞ্চলের নদ-নদীর নাব্যতা সংকটকে। তবে ঘুরেফিরে বারবারই সুরমা নদী খননের প্রশ্ন উঠছে। এ নিয়ে জাগো নিউজের তিন পর্বের প্রতিবেদনের আজ রয়েছে দ্বিতীয় পর্ব।

Advertisement

ভারতের বরাক নদীর ৩৫ শতাংশ পানি সুরমার মূল প্রবাহ হলেও কানাইঘাটে এসে লোভা নদী যুক্ত হওয়ায় সেখানেই প্রথম দফায় চাপ বাড়ে সুরমার। এছাড়াও জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, গোলাপগঞ্জ উপজেলা হয়ে সিলেট সদর উপজেলায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে আরও বেশ কয়কেটি নদী ও পাহাড়ি ছড়ার পানি নামে সুরমায়। যার কারণে কানাইঘাট পয়েন্টের মতো সিলেট পয়েন্টেও প্রচণ্ড চাপ থোকে সুরমায়। বেশ কয়েকটি নদী ও ছড়ার পানি পরিবহন করে সুনামগঞ্জের দিকে ছুটে চলে সুরমা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুরমার সিলেট পয়েন্টে চাপ কমার জন্য প্রকৃতিগতভাবে বাসিয়া, খাজাংচি নদীর জন্ম। এর বাইরে সুরমার চাপ কমাতে কাজ করে গোলাপগঞ্জের মৌলভীখাল। কিন্তু এই তিন নদী ও খাল সুরমা থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সুরমার অতিরিক্ত পানি এই তিন নদী ও খাল দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে না। এতে করে অতিরিক্ত চাপে সুরমা ফুলে উঠে বারবার তলিয়ে যাচ্ছে সিলেট নগরী। প্লাবিত হচ্ছে সিলেটের বেশ কয়েকটি উপজেলা।

দীর্ঘদিন ধরে খনন না করায় উৎসমুখ থেকে শুরু করে ভরাট হয়ে গেছে বাসিয়া ও খাজাংচি নদী। অন্যদিকে হাওর-ফসল রক্ষার নামে স্লুইচগেইট নির্মাণ করে মৌলভীখালকেও বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়ে সুরমা থেকে। মূলত এসবের কারণেই দিনে দিনে হিংস্র হচ্ছে সুরমা। কিন্তু সুরমার এসব শাখা নদী ও সংযুক্ত খাল খনন ও উন্মুক্ত না করে দিয়ে কেবল সুরমা খননের দিকেই নজর সংশ্লিষ্টদের।

Advertisement

নদী গবেষকরা বলছেন, কেবল সুরমা খনন করলেই এর সমাধান নয়। সুরমার সঙ্গে সংযুক্ত সকল শাখা নদী, খাল ও প্লাবনভূমিকে উন্মুক্ত করে খনন করে অন্তত এক কিলোমিটার উন্মুক্ত করে দিতে হবে। একইসঙ্গে প্রতিবছর সুরমাকে খনন করতে হবে।

স্লুইচগেটে বিচ্ছিন্ন মৌলভী খাল

সিলেটের গোলাপগঞ্জ পৌরসভার কামারগাঁও এলাকার সুরমা নদী থেকে মৌলভীখালের যাত্রা শুরু। বর্তমান পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের রণকেলী বড়বাড়ি এলাকার মৌলভী আব্দুর রহিম চৌধুরী এই খাল খনন করেন। পরবর্তীতে তার নামেই খালটি নামকরণ করা হয়।

গভীর এই খালটি কামারগাঁও থেকে দাড়িপাতন হয়ে পশ্চিম আমুড়া ইউনিয়ন হয়ে ঘুগুারকুল এলাকা ছাড়িয়ে এড়াল বিলে পতিত হয়েছে। সেই বিলটি আবার কুশিয়ারার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

এই মৌলভীখাল ছিল সুরমা নদীর অন্যতম একটি পকেট। এটি দিয়ে সুরমার অনেক পানি প্লাবনভূমিতে প্রবাহিত হতো। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ফসল রক্ষার নামে এখানে স্লুইচগেইট নির্মাণ করা হয়। স্লুইসগেইট নির্মাণ করা হলেও সুরমায় পানির চাপ বাড়লে স্বয়ক্রিয়ভাবে খাল দিয়ে পানি বেরিয়ে যেতো। আবার এড়াল বিলের পানি বাড়লে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নদীতে এসে পড়তো।

Advertisement

কিন্তু অন্তত ১৫ বছর ধরে এটি একেবারেই বন্ধ রয়েছে। স্লুইচগেইটের ফাঁকফোকড় দিয়ে কিছু পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এতে এই এলাকায় সুরমার চাপ থেকেই যাচ্ছে। সেখানে থেকে দ্রুত গতিতে পানি এসে নামছে সিলেট সদর উপজেলার দিকে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, সেই মৌলভীখালও ভালো নেই। স্লুইচগেইট নির্মাণ করে সুরমা থেকে বিচ্ছিন্ন করার পরও শেষ হয়নি নির্যাতন। খালের মুখেই নির্মাণ করা হয়েছে একটি শশানঘাট। এটি খালের অর্ধেক অংশজুড়ে রয়েছে। এতে পানির প্রবাহ অর্ধেকের বেশি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

আরও অবাক হওয়ার তথ্য হলো উৎসমুখ থেকে অন্তত ৩০০ থেকে ৫০০ গজ মূল খালও বেদখলে। স্লুইচগেইট নির্মাণের সময় খনন করে উৎসমুখের অন্তত ৩০০ থেকে ৫০০ গজ পরিবর্তন করে অন্যদিকে নেওয়া হয়। খালের সেই অংশটি একজন ব্যক্তি দখলে নিয়ে মাছচাষ করছেন। স্থানীয় কামারগাঁও এলাকার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা হানিফ আলী বলেন, স্লুইচগেইট দিয়ে পানি আটকানোর পর থেকে এটি দখল-ভরাট শুরু হয়। যে যেভাবে পারছে দখলে নিচ্ছে। উৎসমুখটাও দখলে রয়েছে।

তিনি বলেন, খালটি খনন করার জন্য পাউবোর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়। পরে তারা এসে পানির মধ্যে খাল খনন করে গেছে। তাতে কোনো উপকার হয়নি।

অস্তিত্ব সংকটে বাসিয়া নদী

সিলেট সদর উপজেলার মাসুকগঞ্জ এলাকায় সুরমা নদী থেকে বাসিয়া নদীর উৎপত্তি। ৫৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীটি সিলেটের জালালাবাদ-দক্ষিণ সুরমা-বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর-জগন্নাথপুরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে রাণীগঞ্জের স্বাধীন বাজার স্থানে কুশিয়ারা নদীতে মিলিত হয়েছে। সুরমার ধারণ করা ছাড়াও এই পাঁচটি উপজেলার একমাত্র পানি নিষ্কাশনের মাধ্যম হচ্ছে এই নদী।

কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে বাসিয়া নদীর উৎসমুখ ভরাট হয়ে যাওয়ায় শুকনো মৌসুমে সুরমা নদী থেকে পানি প্রবেশ করতে পারে না। যার কারণে নদীটি একটি মরা খাল বা ড্রেনে পরিণত হয়ে যায়। আর বর্ষা মৌসুমে যেটুকু পানি প্রবাহিত হওয়ার কথা ছিল নদীর দুই তীর অবৈধভাবে দখল ও ভরাট করায় সেই পানিও যেতে পারে না।

এক সময় বাসিয়া নদী দিয়ে নৌকা, বড় বড় লঞ্চ আর স্টিমারে পণ্য পরিবহন করা হতো। ৫৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ও গড়ে ৫৪ মিটার প্রস্থ এই নদীটি এখন একটি ছোট খাল। বিশ্বনাথে বাসিয়া নদীর দুই তীরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন স্থাপনা উচ্ছেদ করতে জেলা প্রশাসকের কাছে ১৮৭ জনের নামে মামলা চলমান রয়েছে (মামলা নং০৪/২০১৭)। কিন্তু প্রায় ৭ বছর অতিবাহিত হলেও এখনও সেই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়নি। এই মামলার বিরুদ্ধে দখলকারীরা হাইকোর্টে দুটি রিট আবেদন করেছেন (রিট মামলা নং- ৯১৩৫/২০১৭ ও ৫৩৪০/২০১৭ চলমান)।

বাঁচাও বাসিয়া ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক ফজল খান জানান, বাসিয়া নদী রক্ষা করতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন তারা। পৌরসভার মেয়রকে অবৈধ স্থাপনার তালিকাসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনও কোনো কাজ হয়নি।

খাজাংচি নদীর সংকট

সিলেট সদর উপজেলার মাসুকগঞ্জ বাজারে বাসিয়ার উৎসমুখ থেকে খানিকটা পশ্চিমে ধনপুর পয়েন্টের দক্ষিণে কান্দিগাঁও থেকে দক্ষিণ দিকে ঘাষিগাঁও হয়ে বর্তমান খাজাঞ্চি বাজার পর্যন্ত গিয়ে পশ্চিম দিকে মোড় নেয়। সেখানকার মোড় থেকে সুরমার অন্যতম আরেক শাখা খাজাংচি নদী যাত্রা শুরু করে যেটি সদর, বিশ্বনাথ ও ছাতকের ওপর দিয়ে ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ছাতকের দুলার বাজার ইউপিতে ডাউকা নদীতে পতিত হয়েছে।

জানা গেছে, ১৯৫৪ সালের অক্টোবর মাসে সিলেট-ছাতক রেল যোগাযোগ চালু হয়। এ রেল পথটি খাজাঞ্চি এলাকায় খাজাংচি নদীর ওপর নির্মিত সেতু দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েক বছর পর দেখা গেলো যে, এ অংশে সুরমার ভাঙন খুব বেশি। রেল কর্তৃপক্ষ সেই ভাঙন থেকে রেলপথ ও সেতুকে রক্ষার ব্যাপারে সম্ভাব্য বিকল্প খুঁজতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত সুরমা নদী তাদের চোখে পড়লো এবং সেটিকে কোরবানি দেওয়ার জন্য উদ্যোগী হয়।

অবশেষে ১৯৬২-৬৩ সালে তারা সেই কাজ শুরু করে। বলি হতে থাকে সুরমা। মাসুকগঞ্জ বাজার থেকে জাঙ্গাইল পর্যন্ত খনন করে নদীর বাঁকা অংশকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। আবার ধনপুর থেকে হাসাউরা পর্যন্ত অংশে খনন করে নদীকে আদিপথ থেকে এদিকে প্রবাহিত করা হয়। আদি প্রবাহপথের মুখগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। বর্তমানে ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ খাজাংচি নদীর উৎসস্থল সুরমা থেকে বিচ্ছিন্ন। এতে আস্তে আস্তে মরে যাচ্ছে এ প্রমত্তা নদী।

সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’র প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হাই আল হাদী বলেন, সিলেট নগরীর পুকুর, জলাশয় ভরাট করে স্থাপনা গড়ে উঠেছে। নগরীর ভেতরের তেলিহাওর, কাজলহাওর ও দুবড়ি হাওর নামে তিনটি বড় হাওর ছিল। এগুলোর কোনোটিই নেই। সুরমার পানি প্রবাহের সবকটি পকেটই বিচ্ছিন্ন। তাছাড়া সুরমার নাব্য সংকটতো আছেই। তিনি বলেন, পাহাড়-টিলা কাটা অব্যাহত থাকায় সিলেট নগরীর সবকটি খাল-ছড়া প্রচুর পরিমাণে বালু নিয়ে আসে। এগুলো গিয়ে জমা হয় সুরমায়। এতে সুরমা তার নাব্যতা হারিয়ে ফেলছে। যার কারণে অতিবৃষ্টি ও উজানের ঢলের চাপ নিতে পারছে না সুরমা।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, সিলেটে নদী-খাল খনন মানেই দুর্নীতি। একটা প্রকল্পও আলোর মুখে দেখেনি। সিটি করপোরেশন এলাকায় সুরমা খননের সময় পাউবো জানিয়েছে নদীর নিচে প্লাস্টিক ও পলিথিনের স্তূপের কারণে খনন যন্ত্র কাজ করছে না। তাহলে ফিজিবিলিটি স্টাডি কী হয়েছে যোগ করেন তিনি।

সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, বাসিয়া, খাজাংচি, মৌলভীখাল, কুশিগাঙসহ ২০টি নদী-খাল খননের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। খুব শিগগিরই নতুন এ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।

এফএ/এএসএম