ফিচার

এক রাতেই মারা যায় গ্রামের ১৮০০ মানুষ

অন্য আর দশটা দিনের মতোই সব স্বাভাবিক ছিল এই গ্রামের সবকিছু। দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা-রাত হতেই গ্রামের সবাই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। কিন্তু সকালে গ্রামের অর্ধেকের বেশি মানুষের ঘুম ভাঙেনি। শুধু গ্রামের মানুষ নয় পশুপাখিও মরে পড়ে থাকে যেখানে সেখানে। এমনই ঘটনা ঘটেছিল আফ্রিকার লোয়ার নিয়োস গ্রামে।

Advertisement

১৯৮৬ সালের ২১ আগস্ট। প্রায় ১৮০০ মানুষ এবং ৩ হাজার গবাদি পশুর মৃতদেহ উদ্ধার হয় ওই গ্রাম থেকে। রাতারাতি অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল গ্রামের জনসংখ্যা। কেন এক রাতে গ্রামের এত মানুষের এক সঙ্গে মৃত্যু হয়েছিল তা খুঁজে পেতে হিমশিম খেতে হয় প্রশাসনকে।

সেই সময় গুজব ছড়িয়েছিল, কোনও গোপন সরকারি সংস্থা, অদৃশ্য অস্ত্র বা এলিয়েনদের অতর্কিত আক্রমণের কারণেই মৃত্যু হয়েছে আফ্রিকার ওই গ্রামের ১৮০০ মানুষের। তবে লোয়ার নিয়োস গ্রামের এতগুলো মানুষের একসঙ্গে মৃত্যুর নেপথ্য কারণ ছিল অন্য।

পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে নানান রহস্য। যা অনেকটাি এখনো ভেদ করতে পারেনি মানুষ। এমনই এমন অনেক ঘটনা ঘটে যার কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি, আবার দীর্ঘদিন গবেষণার পর ধারণা করেছেন মাত্র। তবে সঠিক কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বের করতে পারেননি।

Advertisement

তেমনি দীর্ঘ গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছিলেন, লোয়ার নিয়োস গ্রামের পাশে থাকা একটি হ্রদের কারণেই মৃত্যু হয়েছিল গ্রামের ১৮০০ মানুষের। মারা গিয়েছিল গ্রামের তিন হাজার গবাদি পশুও। লোয়ার নিয়োস গ্রামের মানুষ জানতেন না যে লেক নিয়োস হ্রদের তলায় রয়েছে একটি ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি।

আরও পড়ুনইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ২ হাজার যাত্রীর

নিয়োস হ্রদের অবস্থান ক্যামেরুন আগ্নেয়গিরির কাছে। গিনি উপসাগর থেকে ক্যামেরুন এবং নাইজেরিয়া পর্যন্ত দেড় হাজার কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে একটি আগ্নেয়গিরিমালা। এই আগ্নেয়গিরিমালার উৎপত্তি কীভাবে, তা এখনো বোঝা যায়নি। মনে করা হয়, ১৫০০ লাখ বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আফ্রিকার বিচ্ছেদের সময়, একটি ফাটল তৈরি হতে শুরু করেছিল। সেই কারণে এই আগ্নেয়গিরিমালার উৎপত্তি।

বর্তমানে সেই আগ্নেয়গিরিমালার একমাত্র সক্রিয় আগ্নেয়গিরি মাউন্ট ক্যামেরুন। আগ্নেয়গিরিমালার নিচে ৮০ কিলোমিটার গভীরে এখনো একটি বড় লাভার প্রকোষ্ঠ রয়েছে। লাভার প্রকোষ্ঠ থেকে মাঝেমধ্যেই প্রচুর পরিমাণ গ্যাস নির্গত হয়। দীর্ঘ সময় ধরে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মুখের ওপর যদি প্রাকৃতিক নিয়মে কোনো হ্রদ বা জলাভূমি সৃষ্টি হয় তা হলে সেই গ্যাস ওই হ্রদ বা জলাভূমি বরাবর প্রবাহিত হয়। আগ্নেয়গিরির মুখের ওপর তৈরি হওয়া ওই হ্রদগুলোকে ‘মার হ্রদ’ বলা হয়।

আগ্নেয়গিরিমালার আশপাশে ওই ধরনের মোট ৩০টি হ্রদ রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম নিয়োস। পাহাড়ে ঘেরা নিয়োস হ্রদটির গভীরতা ৬৫০ ফুটেরও বেশি। লাভা প্রকোষ্ঠ থেকে উৎপন্ন সালফার এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মতো গ্যাস ওই হ্রদগুলোর তলায় ঘনীভূত অবস্থায় থাকে। গ্যাসগুলোকে তলদেশেই আটকে রাখতে ওই ধরনের হ্রদগুলোর উপরিভাগে প্রাকৃতিক নিয়মেই একটি উষ্ণ পানির আচ্ছাদন তৈরি হয়।

Advertisement

বিজ্ঞানীদের দাবি, যে রাতে লোয়ার নিয়োস গ্রামে ওই বিপর্যয় ঘটে, সে রাতে কোনোভাবে নিয়োস হ্রদের ওপরের সেই নিরাপত্তা বলয় ভেঙে যায়। উষ্ণ জলের আচ্ছাদন ভেদ করে বেরিয়ে আসে বিষাক্ত গ্যাসের মেঘ। স্থানীয়দের দাবি, বিপর্যয়ের ঠিক আগে নিয়োস হ্রদের আশেপাশে একটি বিকট শব্দ শোনা গিয়েছিল। যার পরেই নাকি জলের নীচ থেকে উঠে আসে বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ঘন মেঘ। নিয়োস হ্রদের ওপরে ১৬০ ফুট পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল সেই বিষাক্ত মেঘের স্তর। সেই মেঘের ঘনত্ব সাধারণ বাতাসের থেকে বেশি হওয়ার কারণে তা ভূপৃষ্ট থেকে বেশি দূর পর্যন্ত উঠতে পারেনি।

বিষাক্ত গ্যাসের কারণে ঘুমের মধ্যেই মৃত্যু হয় অনেক গ্রামবাসী এবং গবাদি পশুর। বিপর্যয় থেকে বেঁচে যাওয়া কয়েকজন জানিয়েছিলেন, তারা রাতের অন্ধকারে সালফারের গন্ধ পেয়েছিলেন।

আরও পড়ুনআধুনিক সভ্যতায় আলুর অবদানবাংলায় বিস্কুট ছিল নিষিদ্ধ খাবার

সূত্র: ব্রিটানিকা, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউড অব হেলথ

কেএসকে/জেআইএম