দেশজুড়ে

যে কারণে বারবার হিংস্র হচ্ছে সুরমা

সাম্প্রতিক সময়ে বারবার বন্যা আক্রান্ত হচ্ছে সিলেট। খুব কম সময়ে বানের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। বানের পানি ঢুকে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা দেয় সিলেট নগরীতেও। ঘন ঘন আকস্মিক বন্যার কারণ হিসেবে কেউ দায়ী করছেন ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ককে আবার কেউ দায়ী করছেন এ অঞ্চলের নদ-নদীর নাব্যতা সংকটকে। তবে ঘুরেফিরে বারবারই সুরমা নদী খননের প্রশ্ন উঠছে। এ নিয়ে জাগো নিউজের তিন পর্বের প্রতিবেদনের আজ রয়েছে প্রথম পর্ব।

Advertisement

সুরমা। দেশের দীর্ঘতম এই নদটি সিলেটের ইতিহাস ঐতিহ্যের একটি অংশ। সুরমার তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে দেশের অন্যতম পর্যটন নগরী সিলেট। প্রকৃতিকন্যা সিলেটের পরই হাওর অধ্যুষিত জেলা সুনামগঞ্জ শহরও গড়ে উঠেছে এই নদীর তীর ঘেঁষে। সঙ্গত কারণেই এই নদীটি সিলেট অঞ্চলের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

সিলেটে বন্যার ভয়াবহতার দীর্ঘ ইতিহাস থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে সৃষ্ট বন্যার কারণ হিসেবে বার বার উঠে আসছে এই সুরমার নাম। বন্যা ছাড়াও জলাবদ্ধতার কারণে সিলেট নগরী ডুবলে তাতেও সুরমাকেই দায়ী করা হচ্ছে। সুদীর্ঘ কাল ধরে বয়ে চলা প্রমত্তা সুরমা মানুষের দুর্ভোগের কারণ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় হয়তোবা সেও নিজেকে অপরাধী মনে করছে। কিন্তু আদৌ কী সুরমা সিলেটে বন্যা বা জলাবদ্ধতার জন্য একমাত্র দায়ী?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘নদী শাসনের নামে সুরমাকে নির্যাতন, জুলুম ও হত্যার কারণেই দিনে দিনে সুরমা হিংস্র হয়ে উঠেছে। প্লাবনভূমি ও পকেটগুলো থেকে সুরমাকে বিচ্ছিন্ন করে দখল, দূষণ ও বাঁধের মহোৎসব চলতে থাকলে এটি আরও হিংস্র হয়ে উঠবে। আরও ভয়াবহতার সাক্ষী হতে হবে সিলেটবাসীকে।’

Advertisement

এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের বড় প্রভাবও রয়েছে এই বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে। গত ডিসেম্বরে রয়্যাল মেটিওরোলজিক্যাল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, ‘গত চার দশকে ভারতের মেঘালয়-আসাম এবং বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে বর্ষাকালীন বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমতে থাকলেও একদিনে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের ঘটনা চার গুণ বেড়েছে। এসব কারণে উজান থেকে নেমে আসা অতিবৃষ্টির পানি ধরে রাখতে ও পরিবহনে সুরমার নাব্যতা যথেষ্ট নয়। যার কারণে বারবার বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে।’

আরও পড়ুন বৃষ্টিতে বেড়েছে নদ-নদীর পানি, বন্যা পরিস্থিতির অবনতির শঙ্কা

২৪৯ কিলোমিটার দীর্ঘ সুরমা নদীর উৎপত্তি সিলেটের সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জ উপজেলার আমলশীদ নামক স্থানে। ভারত থেকে আসা বরাক নদী আমলশীদে এসে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি সুরমা ও অন্যটি কুশিয়ারা নাম ধারণ করেছে।

আমলশীদ থেকে জকিগঞ্জের বারঠাকুরি, মানিকপুর, কাজলশাহ ইউনিয়ন হয়ে কানাইঘাট, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, সিলেট সদর, দক্ষিণসুরমা, বিশ্বনাথ, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা ছুঁয়ে সিলেট জেলা অতিক্রম করেছে সুরমা। সেখান থেকে ছাতক, দোয়ারাবাজার, সুনামগঞ্জ সদর, জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা ও মধ্যনগর হয়ে মেঘনায় পতিত হয়েছে। জাতীয় হাওর ও নদীরক্ষা কমিশনের তথ্যমতে, ২৪৯ কিলোমিটার পথচলায় লোভা, পাবিজুরি, কুশিগাঙ, সারিগোয়াইন, নয়াগাঙ, খাসিমারা, চালতি, পিয়াইন, যাদুকাটা ও রক্তি নদী এসে সুরমায় মিলিত হয়েছে। তাছাড়া সুরমা থেকে বাসিয়া ও খাজাংচিসহ বেশ কয়েকটি নদীর উৎপত্তি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বরাক নদীর ৬৫ শতাংশ পানি কুশিয়ারা ও ৩৫ শতাংশ সুরমা দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর বাইরে আরও অন্তত ৫০টি নদীর পানি বহন করে সুরমা। এতে করে মূল জলধারা ছাড়াও বাইরের অনেক চাপ সামলাতে হয় সুরমাকে।

তারা বলছেন, বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢলের চাপের কারণে ফুলে ওঠে সুরমা। কিন্তু সেই চাপ কমাতে না পেরে হিংস্র রূপ ধারণ করে মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সুরমার এমন হিংস্রতার কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সুরমাকে খনন না করা, নদীর পকেট ও প্লাবন ভূমিকে বিচ্ছিন্ন করা, নদী শাসনের নামে যত্রতত্র বাঁধ দেওয়া ও বিভিন্ন স্থানে অপরিকল্পিতভাবে ব্রিজ তৈরি করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করার কারণে বারবার সুরমা ফুলে উঠে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে।

Advertisement

আরও পড়ুন সিলেটে দেড় হাজার গ্রাম প্লাবিত, পানিবন্দি ৮ লাখ মানুষ

তাছাড়াও সুরমার সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া পাহাড়ি নদী-খাল-ছড়াগুলো খনন না করা এবং সুরমা থেকে সৃষ্ট বাসিয়া, পুরান সুরমা ও খাজাংচিসহ অন্যান্য নদ-নদী এবং খাল খনন না করার কারণে এগুলো ভরাট হয়ে পড়েছে।

এমনকি কয়েকটি শাখা নদীর উৎসমুখ ভরাট হয়ে যাওয়ায় সুরমার পানি প্রবাহে বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। যার কারণে সুরমা অতিরিক্ত পানির চাপে ফুলে উঠছে। এতে করে নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে কোথাও আবার উপচে এসে সিলেট নগরীসহ বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করছে। এর বাইরে মানবসৃষ্ট অনেক কারণও যোগ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

সুরমার এমন হিংস্রতার পেছনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) গাফিলতির অভিযোগও উঠছে। তবে পাউবো বলছে, সুরমা খনন হয়েছে। আরও একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। তাছাড়াও সুরমাসহ সংশ্লিষ্ট আরও ২০টি নদী-খাল খননের জন্য ফিজিবিলিটি স্টাডি চলছে। মাস খানেকের মধ্যে প্রতিবেদন আসবে। সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হাই আল হাদি বলেন, বাসিয়া ও খাজাংচিসহ সুরমার অনেকগুলো পকেট ছিল। যা নদী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। অনেক হাওর সুরমার প্লাবনভূমি ছিল, সেগুলোও ভরাট করে নগর গড়ে উঠেছে। কিন্তু নদীর গতিপথ স্বাভাবিক রাখতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যার কারণে সুরমা বিরূপ আচরণ করছে।

তিনি বলেন, প্রতিবছর বানের সময় পার্বত্য নদীগুলো দিয়ে প্রচুর পরিমাণে বালু আসে। সেই বালুগুলো যুগের পর যুগ নদীর তলদেশে জমতে জমতে নদীর নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে। আমাদের করণীয় ছিল সেই নদীগুলোকে মাঝে মাঝে খনন করা। অন্তত দশ বছর পরে হলেও নদী খনন করা হলে নদীর নাব্যতা বাড়তো। আমরা সেই কাজটা করিনি। উল্টো প্রতিটি নদীর উপর অসংখ্য ব্রিজ স্থাপনা তৈরি করেছি। সেগুলো পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে।

আরও পড়ুন সিলেটে পানি কমলেও কমেনি দুর্ভোগ

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম বলেন, সিলেটে পুকুর, ডোবা ও খাল কমে গেছে। এগুলো ছিল সুরমার একেকটি পকেট। তাছাড়া সুরমার অনেক প্লাবনভূমি নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অনেকে প্লাবনভূমি ভরাট করে বসতি-স্থাপনা গড়েছেন। এসবের কারণে সুরমা তার অতিরিক্ত পানি অপসারণ করার সুযোগ পাচ্ছে না। এজন্যই সুরমা ফুলে গিয়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে। তিনি বলেন, সুরমার প্লাবনভূমি ও পকেটগুলোকে উন্মুক্ত করে দিতে হবে। একইসঙ্গে সুরমাকে প্রতিবছর খনন করতে হবে। উৎসমুখ থেকে শুরু করে ছাতক পর্যন্ত সুরমাকে খনন করা খুবই জরুরি। তা না হলে প্রতিবছরই বন্যার ভয়াবহতা মোকাবিলা করতে হবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশ অস্বাভাবিক আচরণ করছে। কম সময়ে খুব বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। সাইক্লোনের প্রভাব ছিল। তাছাড়া সিলেটে বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা ঢল ধরে রাখতে ও পরিবহনে সুরমার সেই নাব্যতা নেই। ক্রমাগত অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প সংযুক্ত হাওরগুলোকে বিচ্ছিন্ন পকেট হাওর করে ফেলছে, ফলে বন্যা দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

তিনি বলেন, শুধু নদী-হাওর নয়, নগরী ও শহর এলাকায় খাল দখল ও ভরাট হয়ে যাচ্ছে। কানেক্টিভিটি লস হয়েছে। যার ফলে অতিবৃষ্টিতে চরম জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। এছাড়াও পাহাড়-টিলা কাটা ও অবাধে বৃক্ষনিধনের ফলে ভূমিক্ষয় দেখা দিচ্ছে, যা নদী-হাওরসহ সব ধরনের জলাভূমির তলদেশ ভরাট করে বন্যা পরিস্থিতি দুর্বিষহ করে তুলছে।

তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, সিলেটে বারবার বন্যার জন্য নদী ভরাট হয়ে যাওয়াই দায়ী নয়। জলবায়ুর পরিবর্তনের বড় একটি প্রভাব রয়েছে। যার কারণে খুব অল্প সময়েই সিলেট তলিয়ে যায়।

এ প্রসঙ্গে সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেছেন, অতীতে সিলেট ও উজানে বৃষ্টিপাত হলেও বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে অন্তত ১৫-২০ দিন সময় লেগেছে। যার কারণে নদীগুলো পানি টানতে পেরেছে। কিন্তু এখন অল্প সময়ে বেশি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। যার কারণে একসঙ্গে বেশি ঢল নামায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না। তিনি আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে মাত্র ৪-৫ দিনে ১৬০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। একসঙ্গে সিলেট অঞ্চলেও রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। এটা অতীতের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। তবে এই বিশাল জলরাশি যদি একমাস জুড়ে সিলেটে আসতো তাহলে বন্যা মোকাবিলা করতে হতো না। মূলত উজানের অস্বাভাবিক ঢল ও সিলেটের বৃষ্টিপাত এই অঞ্চলকে ডুবিয়েছে।

তিনি বলেন, সুরমার একটি খনন প্রকল্প এরইমধ্যে শেষ হয়েছে। একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। তাছাড়া সুরমাসহ আরও ২০টি নদী খননের উদ্যোগ হাতে নেওয়া হয়েছে।

এফএ/জিকেএস