জাতীয়

তাপপ্রবাহে মৃত্যু নিয়ে যা জানালেন হাজিরা

‘হজের সময় মক্কার মসজিদুল হারামে তাপমাত্রা ৫১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠেছিল। এমন উষ্ণ আবহাওয়া ও প্রচণ্ড গরমে মসজিদুল হারামের সামনে সৌদির এক পুলিশ সদস্যকে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে দেখেছি। তবে তিনি মারা গেছেন কি না জানি না। গরমে যেখানে সৌদির মানুষের এ অবস্থা, সেখানে বাংলাদেশ থেকে যারা হজে গেছেন, তাদের অবস্থা কী হয়েছে তা কল্পনা করলেই বোঝা যায়।’

Advertisement

রোববার (২৪ জুন) বেলা সাড়ে ১১টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল-২ এর বহির্গমনে হজ শেষে ফেরা ফকির সুলতান উদ্দিন এসব কথা বলেন। সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিজি ৩৩৬ ফ্লাইট জেদ্দা থেকে ঢাকা ফিরেছেন তিনি। তার গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়ায়।

 

তীব্র তাপপ্রবাহে চলতি বছর কমপক্ষে এক হাজার ৩০১ জন হজযাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ৪৪ জন রয়েছেন। হজের আনুষ্ঠানিকতার সময় এত মানুষ মারা যাওয়ার বিষয়ে ফকির সুলতান উদ্দিন বলেন, আসলে হজের আনুষ্ঠানিকতা অনেক কঠিন একটা বিষয়। আমার মনে হয় বৃদ্ধ বয়সের চেয়ে যৌবনে হজ করা সবচেয়ে উত্তম। আমাদের মতো বৃদ্ধ অবস্থায় হজে গেলে খুবই কষ্ট হয়, যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।

কী ধরনের কষ্ট বেশি হয়েছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, মক্কা থেকে মিনার দূরত্ব প্রায় আট কিলোমিটার। আরাফাত থেকে মুজদালিফার দূরত্ব নয় কিলোমিটারের বেশি। আবার মুজদালিফা থেকে মিনার দূরত্ব প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার। এসব স্থানবিশেষে হেঁটে যেতে হয়েছে। এতে হাজিদের অত্যন্ত কষ্ট হয়েছে। আবার শয়তানকে লক্ষ্য করে পাথর মারা অনেক কঠিন একটা কাজ। সেখানে লাখ লাখ মানুষের ভিড় থাকে। তিনটা শয়তানকে তিনদিন পাথর মারতে হয়। এসব আনুষ্ঠানিকতা করতে দিনে গড়ে ২০ কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছে। তবে সৌদি কর্তৃপক্ষ হাজিদের মাঝে যথেষ্ট পরিমাণে পানি সরবরাহ করেছে। অন্যথায় পরিস্থিতি আরও কঠিত হতো।

Advertisement

আরও পড়ুনতীব্র তাপপ্রবাহে চলতি বছর ১৩০১ হজযাত্রীর মৃত্যু

সস্ত্রীক হজ করার সুযোগ পেয়ে খুবই আনন্দিত ভোলার চরফ্যাশনের আব্দুল্লাপুর ইউনিয়নের মোখলেছুর রহমান। তিনি বলেন, ২০১৭ সালে একা ওমরা হজ করেছিলাম। তারপর ইচ্ছা ছিল স্ত্রীকে নিয়ে হজে যাওয়ার। ২০২৩ সালে হজের জন্য নিবন্ধন করে এবার হজ করতে পেরেছি। হজে গিয়ে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য দোয়া করেছি যেন আল্লাহ সবাইকে নিরাপদে রাখেন। আল্লাহ যেন সবার ভালো চাওয়াগুলো পূরণ করেন।

মক্কা থেকে মদিনায় তাপমাত্রা বেশি ছিল জানিয়ে মোখলেছুর রহমান বলেন, হজের সময় মদিনা শরিফে প্রচণ্ড গরম পড়েছে। তাপমাত্রা ৪৮ থেকে ৫০ ডিগ্রিতে ছিল। তাঁবু থেকে বের হলে মনে হতো গরমে নাক-মুখ জ্বলে যাচ্ছে। এজন্য হজ কার্যক্রম করতে গিয়ে কিছুটা ব্যাঘাত পেতে হয়েছে। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে গাড়ি পাওয়া যায়নি। এতে অনেক ওয়াজিব, ফরজ যথাসময়ে পালন করতে পারিনি।

মসজিদুল হারাম এবং হজরত মুহাম্মদ (স.) রওজা মোবারক দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেছে বলে জানান জামালপুরের যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক ব্যাংকার মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, হজে কষ্টের চেয়ে তৃপ্তিটাই অনেক বেশি। আল্লাহর মেহমান হয়ে আল্লাহর ঘর জিয়ারত করেছি। এটাই মনে বড় শান্তি লাগছে। হাজিদের মনে ক্লান্তির ছাপ নেই।

আরও পড়ুনআগামী বছরও বাংলাদেশ থেকে ১২৭১৯৮ জন হজে যেতে পারবেন

তিনি বলেন, এবার হজে অত্যন্ত গরম ছিল। আমি প্রেসারের রোগী। গরম অনেক বেশি থাকলেও মনের দিক দিয়ে খুবই শক্ত ছিলাম। গরমকে গরম মনে করিনি। গরমের সাইটটা কখনো চিন্তা করিনি, সবসময় ভালো কাজটা মাথায় রেখেছি। এখন আমার ইচ্ছা আল্লাহ যদি আমাকে সুযোগ দেয় আবার হজে যাবো।

Advertisement

প্রথম হজ এবং প্রথম আকাশপথে ভ্রমণ মনে দারুণ দাগ কেটেছে বলে জানান মোহাম্মদ হাজি নাজিম উদ্দিন। তিনি বলেন, আমাদের হজ করতে হবে, দীর্ঘদিন ধরে মনে এই ইচ্ছা-বাসনা ছিল। সেই ইচ্ছা থেকেই সব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে সব নিয়ম-কানুন মেনে হজ করেছি। তবে বারবার মনে হচ্ছিল, আমি যদি মক্কা বা মদিনা শরিফে থেকে যেতে পারতাম খুব ভালো লাগতো। এখন ফিরে এসে এমনটাই মনে হচ্ছে।

আরও পড়ুনযে কারণে এবারের হজে এত বেশি মৃত্যু

এ সময় পাশে থাকা মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের স্ত্রী শিরীন আক্তার বলেন, জেদ্দা থেকে ফেরার সময় মক্কা-মদিনার জন্য খুবই কান্না করেছি। বারবার মনে হচ্ছে কী যেন রেখে যাচ্ছি। মনে পড়লেই কান্না আসে। আল্লাহ যেন আমাকে আরও একবার সুযোগ দেন, যেন আমি আবার হজ করতে যেতে পারি।

তিনি বলেন, হজে যাওয়ার আগে আল্লাহর কাছে নামাজ পড়ে দোয়া করতাম, যেন হজের সম্পূর্ণ নিয়ম-কানুন মানতে পারি। আলহামদুলিল্লাহ আমি সব কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন করেছি। শুরুতে একটু অসুস্থ হলেও পরে সব কার্যক্রম সফলভাবে করেছি।

পুরান ঢাকার টিকাটুলির কে এম দাস লেনের বাসিন্দা মোহাম্মদ সারোয়ার হোসেন বেপারী। তিনিও সস্ত্রীক হজ করে আজ সোমবার দেশে ফিরেছেন। হজের আনুষ্ঠাতিকতা পালন করতে গিয়ে কোনো ধরনের সমস্যা হয়েছে কি না জানাতে চাইলে মোহাম্মদ সারোয়ার হোসেন বেপারী বলেন, হজের সময় খুবই গরম ছিল। কাবাঘর যখন তাওয়াফ করছি, তখন দেখলাম ইয়াং বয়সের এক হাজি মারা গেছেন। আমার এক রুমমেটও মারা গেছেন।

আরও পড়ুন‘সবচেয়ে বয়স্ক’ হজযাত্রীকে ফুল দিয়ে বরণ করলো সৌদি আরব

তিনি বলেন, বেশিরভাগই মারা গেছেন প্রচণ্ড গরম এবং হিট স্ট্রোকে। পাথর মারতে গিয়ে অনেকে অসুস্থ হয়েছেন। মিনা থেকে মুজদালিফা বা আরাফাতের ময়দান সব জায়গায় হেঁটে চলতে হয়েছে। দেখা গেছে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা হেঁটে যেতে লাগে ৪০ মিনিট, বাসে যেতে লাগে চার ঘণ্টা। ফলে বেশিরভাগ মানুষ হেঁটে হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন।

ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এবার বাংলাদেশ থেকে ৮৫ হাজারের বেশি মানুষ হজে যান। ২০ জুন থেকে হজের ফিরতি ফ্লাইট শুরু হয়। রোববার (২৩ জুন) রাত পর্যন্ত সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন ১১ হাজার ৬৪০ জন বাংলাদেশি। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, সৌদিয়া এয়ারলাইন্স, ফ্লাইনাস এয়ারলাইন্সের ৩০টি ফিরতি ফ্লাইটে তারা দেশে ফেরেন। হজ ফ্লাইট শেষ হবে ২২ জুলাই।

এমএমএ/ইএ/জেআইএম