সম্প্রতি চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার সাপ নিয়ে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। সঠিক তথ্য-উপাত্ত না থাকলেও গত কয়েক মাসে দেশের বিভিন্ন জেলায় সাপের কামড়ে বেশ কয়েকজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। তবে তাদের মৃত্যু রাসেলস ভাইপার সাপের দংশনেই হয়েছে- এমন নিশ্চিত তথ্য-উপাত্ত নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে।
Advertisement
গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাসেলস ভাইপার নিয়ে জনমনে উদ্বেগের কারণে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম (সাপের দংশনের রোগীদের সুস্থ করে তোলার জন্য ব্যবহৃত) ইনজেকশন সরবরাহ ও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার নির্দেশনা দিয়েছেন।
দেশে রাসেলস ভাইপারসহ বিভিন্ন সাপের প্রকোপ, অ্যান্টিভেনম ইনজেকশনের প্রয়োজনীয়তা, প্রাপ্তি ও প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক এবং মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ। বিশেষ এ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জাগো নিউজের প্ল্যানিং এডিটর মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল।
প্রশ্ন: রাসেলস ভাইপার নিয়ে জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। আপনি দীর্ঘদিন সর্প দংশন ও প্রতিকার নিয়ে জনসচেতনতা তৈরি এবং গবেষণামূলক কাজ করছেন। সম্প্রতি সারাদেশে সাপের কাটা নিয়ে যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে, এ বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
Advertisement
উত্তর: রাসেলস ভাইপার নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিবেদন, তথ্য-উপাত্ত আমার চোখেও পড়েছে। এ সাপ সম্পর্কে কিছু কিছু তথ্য সঠিক, আবার কিছু বিভ্রান্তিমূলক তথ্যও ছড়িয়ে পড়ছে।
রাসেলস ভাইপার সাপটি নতুন কোনো সাপ নয়। যারা কৃষিকাজ, বাগানবাড়ি কিংবা মাছ ধরাসহ বিভিন্ন পেশায় জড়িত তাদের কাছে এ সাপটি চন্দ্রবোড়া/উলুবোড়া নামে পরিচিত। বিগত বছরগুলোতেও এ সাপের দংশনে দুর্ভাগ্যবশত বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত কিংবা মারা গেছেন। তবে এটা ঠিক অন্য বছরের তুলনায় এ বছর রাসেলস ভাইপারে দংশনের কথা বেশি শোনা যাচ্ছে।
প্রশ্ন: কোন সাপের দংশনে রোগীর মৃত্যু হচ্ছে তা নির্ণয়ের ব্যবস্থা কি আমাদের রয়েছে? তাছাড়া দেশে কোন কোন অঞ্চলে সাপের প্রকোপ বেশি রয়েছে?
উত্তর: আমাদের দেশে সাপ সংক্রান্ত সেই অর্থে বড় কোনো জরিপ নেই অর্থাৎ দেশে মোট কয় ধরনের সাপ রয়েছে, কোন সাপ কোথায় আছে, কোন মানুষকে কোন সাপ দংশন করেছে সেটি নিশ্চিত করে বলা যায় না।
Advertisement
তবে সর্বশেষ ২০২২ সালে পরিচালিত জাতীয় জরিপ অনুসারে দেশে প্রতি বছর সাপের কামড়ে আনুমানিক ৪ লাখ মানুষ আক্রান্ত হন ও দুর্ভাগ্যবশত প্রায় সাড়ে ৭ হাজার মানুষ মৃত্যবরণ করেন।
দেশের সর্বত্রই কমবেশি সাপ থাকলেও জাতীয় জরিপ অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি সাপে কাটার ঘটনা খুলনা ও বরিশাল বিভাগে। এরপর রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় সাপের দংশন বেশি হয়।
প্রশ্ন: তাহলে চিকিৎসা কীভাবে দেওয়া হচ্ছে? রাসেলস ভাইপার দংশন করেছে কি না তা কীভাবে নিশ্চিত হওয়া যাবে?
আরও পড়ুন
রাসেলস ভাইপারের দংশনে মৃত্যুর চেয়ে সুস্থতার হার বেশি নদীবেষ্টিত নোয়াখালীতে রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক উপকূলে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে রাসেলস ভাইপারউত্তর: শুধু রাসেলস ভাইপারই নয়, যে কোনো ধরনের বিষাক্ত সাপের দংশনে কেউ আক্রান্ত হয়েছেন কি না তা চিকিৎসক উপসর্গ দেখে সিদ্ধান্ত নেন। তবে রাসেলস ভাইপার দংশনে বিষক্রিয়া উপসর্গের সঙ্গে চিকিৎসকরা ২০ ডব্লিউ বি. সি. টি (২০ মিনিট হোল ব্লাড ক্লটিং টেস্ট) নামক এক ধরনের রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে বিষক্রিয়া হয়েছে কি না সিদ্ধান্ত নেন।
বিষাক্ত রাসেলস ভাইপার দংশন করলে রক্ত জমাট বাঁধায় ব্যাঘাত ঘটে এবং ২০ ডব্লিউ বি. সি. টি পজিটিভ আসে অর্থাৎ রাসেলস ভাইপার দংশন করেছে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যায়। এ পরীক্ষায় উন্নত যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয় না। উপজেলা হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সরা এটি সহজেই শনাক্ত করতে পারেন।
প্রশ্ন: আমাদের দেশে অ্যান্টিভেনম ইনজেকশনের সহজলভ্যতা ও দাম কেমন? এছাড়া রাসেলস ভাইপার দংশনের জন্য কি পৃথক কোনো ইনজেকশন ব্যবহার করতে হয়?
উত্তর: আমাদের দেশে যে অ্যান্টিভেনমটি ব্যবহৃত হয় এটি চার প্রজাতির সাপের বিষ থেকে তৈরি হয়। সাপগুলো হলো কোবরা, ক্রেইট, এস এ ডব্লিউ স্কেইলড ভাইপার এবং রাসেলস ভাইপার।
বাংলাদেশে যে কোনো বিষাক্ত সাপের দংশনে (কোবরা, ক্রেইট এবং রাসেলস ভাইপার) ভারতের মতো একই ইনজেকশন ব্যবহৃত হয়। রাসেলস ভাইপার দংশনের চিকিৎসার জন্য পৃথক ইনজেকশন এখন নেই।
দেশে যে অ্যান্টিভেনম সরকারিভাবে কেনা হচ্ছে, তার এক ডোজের (১০ ভায়াল) ইনজেকশনের দাম প্রায় ১৪ হাজার টাকা। কয়েক বছর আগেও এ ইনজেকশনের দাম ছিল ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। ফলে একজন সাপে কাটা রোগীর ইনজেকশনের জন্য সরকারের ১৪ হাজার টাকা ব্যয় হয়, যা সরকারিভাবে সরবরাহ করা হচ্ছে।
উপজেলা, জেলা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চাহিদা অনুসারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি (এনসিডিসি) ও ই.ডি.সি.এল (এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেড) এর মাধ্যমে অ্যান্টিভেনম কেনা হয়।
প্রশ্ন: সাপে কাটা থেকে বাঁচতে সতর্কতামূলক কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে?
উত্তর: সাপের দংশন থেকে বাঁচতে সরকারিভাবে মার্চ ও এপ্রিল থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করতে হবে। বিশেষ করে বর্ষাকালে সাপ আশ্রয়ের খোঁজে বাসা-বাড়িতে ঢুকে পড়ে। তবে আশার কথা হলো সব সাপই কিন্তু বিষধর নয়। দেশে সর্প দংশনের মাত্র ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বিষধর সাপের দংশন।
সাপের কামড় থেকে বাঁচতে অন্যতম উপায় হচ্ছে সাবধানে হাঁটা (আলো, লাঠি ও বুট জুতা ব্যবহার), চৌকি-মশারি (খাটের ওপরে মশারি ব্যবহার করে শোয়া), মেঝেতে না শোয়া, বসতবাড়ি, প্রাণী ও খাবার সামগ্রী উন্মুক্ত না রাখা। কারণ এসব ওদের আকর্ষণ করে। ফলে সাপ ঢুকতে পারে।
এছাড়া বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখা, শস্য পাহারা ও মাছ ধরায় সাবধানতা, স্তূপাকৃত ও জমাকৃত সামগ্রী সাবধানে নাড়াচাড়া করা ও গর্তে হাত দেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
প্রশ্ন: সাপ কামড়ালে জরুরি প্রয়োজনীয় প্রাথমিক চিকিৎসা ও নিয়মাবলি কী কী?
উত্তর: সাপে কাটা রোগীকে অভয় দিয়ে আশ্বস্ত করতে হবে। পায়ে দংশন করলে বসে যেতে হবে, হাঁটা যাবে না। হাতে দংশন করলে হাত নাড়াচাড়া করা যাবে না। যত দ্রুত সম্ভব দংশিত অঙ্গ থেকে আংটি, চুড়ি, তাবিজ ও তাগা খুলে ফেলতে হবে।
দংশিত অঙ্গ হাড় ভেঙে গেলে যেভাবে স্প্লিন্টের সাহায্যে নড়াচড়া প্রতিরোধ করা হয় সেভাবে কাপড় ও কাঠ বা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে পেঁচিয়ে নিতে হবে, যাতে গিঁরা নড়াচড়া না করে। গিঁরা নড়াচড়ায় মাংসপেশির সংকোচনের ফলে বিষ দ্রুত রক্তের মাধ্যমে শরীরে ছড়িয়ে গিয়ে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
তাছাড়া দংশিত স্থানে রক্তক্ষরণ হতে থাকলে চাপ দিয়ে ধরে রাখতে হবে। যথাসম্ভব দ্রুত মোটরযানে রোগীকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
রোগীকে যাত্রাপথে একপাশে কাত করে রাখতে হবে। যদি শ্বাস-প্রশ্বাস না থাকে তাহলে মুখে বায়ু ঢোকার নল ব্যবহার করতে হবে, প্রয়োজন হলে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করতে হবে।
সাপ মারবেন না। সাপ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে ও মানুষের উপকার করে। তবে কেউ সাপ মেরে থাকলে শনাক্তকরণের জন্য সাপটি হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেন।
প্রশ্ন: বিষধর সাপে কাটার লক্ষণগুলো কী কী?
উত্তর: দংশিত স্থান দ্রুত ফুলে যাওয়া, ফোসকা পড়া, চামড়ার রং পরিবর্তন, কালচে হওয়া, ব্যথা, পচন ধরা, ক্রমাগত রক্তপাত, ঘুম ঘুম ভাব, চোখের উপরের পাতা ভারী হওয়া বা বুজে আসা, চক্ষু গোলক নড়াচড়া করতে না পারা, ঝাপসা দেখা বা একটি জিনিসকে দুটি দেখা, জিহ্বা জড়িয়ে আসা, কথা বলতে অসুবিধা হওয়া, ঢোক গিলতে অসুবিধা হওয়া, খাওয়ার সময় নাক দিয়ে পানি আসা, হাঁটতে অসুবিধা হওয়া, হাত ও পা অবশ হওয়া, ঘাড় দুর্বল হওয়া, কালো রঙের প্রস্রাব হওয়া ও প্রস্রাব কমে যাওয়া।
প্রশ্ন: কাউকে সাপে কাটলে পরে কী কী করা উচিত নয়?
উত্তর: দংশিত অঙ্গে কোনো রকম গিঁট না দেওয়া, দংশিত স্থানে কাঁটাছেঁড়া না করা, সুঁই না ফুটানো বা কোনো প্রলেপ না দেওয়া, ওঝা বা বৈদ্য দিয়ে চিকিৎসা ও ঝাড়ফুঁক করে সময়ক্ষেপণ না করা, হাসপাতালে নেওয়ার পথে রোগীর কথা বলতে অসুবিধা হলে, নাকে কথা বললে কিংবা মুখ থেকে লালা ঝরলে রোগীকে কিছু খেতে না দেওয়া, দংশিত স্থানে রাসায়নিক পদার্থ, অ্যালকোহল জাতীয় কিছু না দেওয়া, তেল, ঘি, মরিচ ও গাছ-গাছালির রস ইত্যাদি খাইয়ে বমি করানোর চেষ্টা না করা, ব্যথা উপশমের জন্য অ্যাসপিরিন না দেওয়া ইত্যাদি।
এমএমএআর/এএসএ/এএসএম