জাতীয়

মন ভোলানো সৌন্দর্যের চর কুকরি মুকরি-তারুয়া সমুদ্রসৈকত

দ্বীপজেলা ভোলা। সৌন্দর্য যার পরতে পরতে। নদী-সমুদ্র বিধৌত এ জেলা প্রতি ঋতুতে রূপ বদলায়। বর্ষায় নদীগুলো ফিরে পায় যৌবন। বন হেসে ওঠে সবুজে সবুজে। শীতে পরিযায়ী পাখিরা দল বেঁধে কিছুদিনের জন্য অতিথি হয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই পর্যটনে অপার সম্ভাবনা জাগাচ্ছে ভোলার। স্থানীয়রাও পর্যটনে এগিয়ে যেতে উদ্যোগী।

Advertisement

জেলার চরফ্যাশন উপজেলার দ্বীপকন্যা চর কুকরি মুকরি ও তারুয়া সমুদ্রসৈকত এখন পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্রে। একই সঙ্গে নদী, সমুদ্র ও বনের সান্নিধ্য পেতে সেখানে যেতে চান অনেকে। পর্যটকদের জন্য চাঁদনি রাতে সেখানে অবস্থানেরও সুযোগ তৈরি করেছেন স্থানীয়রা। নিরাপত্তার বিষয়ে সজাগ তারা। চালু হচ্ছে কমিউনিটি ট্যুরিজম। তাঁবু পেতে ক্যাম্পিংয়ের পাশাপাশি চাইলে বাড়িতে আপনার পছন্দের খাবার তৈরি করে নেওয়ার রয়েছে সুযোগ।

রাজধানী ঢাকা, বরিশাল ও লক্ষ্মীপুর জেলা থেকে নদীপথে সহজেই যাওয়া যায় ভোলা। কার্নিভাল ক্রুজসহ বেশ ভালো বাহনও আছে। যে কারণে যাতায়াতে কষ্ট তুলনামূলক কম।

ভোলা জেলা সদর থেকে সড়কপথে ১৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কোলে দ্বীপকন্যা কুকরি মুকরি। একইভাবে নদীপথে আরও ১৫ কিলোমিটার ভেতরে তারুয়া সমুদ্রসৈকত। দুই পাশে বিস্তীর্ণ বনভূমির মধ্য দিয়ে চলে গেছে নদী, মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। ইঞ্জিনচালিত নৌকা, স্পিডবোট, ছোট লঞ্চে নিয়মিত যাতায়াত করা যায়। রয়েছে পথে পথে নেমে বনে ঘোরার সুযোগ। আছে অবস্থান করার মতো জায়গা, সুদীর্ঘ ওয়াচ টাওয়ার। ৭ তলা ভবনের আদলে তৈরি ওয়াচ টাওয়ার থেকে পুরো বন, নদী ও সাগরের দেখা মেলে। তবে দুর্বল হার্টের যে কেউ এত ওপরে উঠে ভয় পেয়ে যেতে পারেন।

Advertisement

চর কুকরি মুকরির স্থানীয় বাসিন্দা মো. আমির মোল্লা জাগো নিউজকে বলেন, ‘চর কুকরি মুকরিতে সারা বছরই মানুষজন আসে। নদী-সমুদ্র, হরিণ-বানর, বন-বাদাড় দেখতে আসেন। অনেকে পিকনিক করেন। তাঁবু টাঙিয়ে রাতে থাকেন। এখন যা দেখছেন, শীতকালে আরও বেশি সুন্দর দেখায়। তখন বিভিন্ন প্রজাতির পাখি দেখতে পাওয়া যায়। আর ভ্রমণকারীদের এ পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়েছে বলে শুনিনি। স্থানীয় জেলে কুদ্দুস মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘একসময় এখানে কেউ আসতো না। এখন দূর-দূরান্ত থেকে লোক আসে, রাতে থাকে। এখানকার মানুষ আগে শুধুই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো। এখন তারা পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। কেউ নৌকা, স্পিডবোট চালায়। কেউ আবার খাবার বিক্রি করে। এখানে গত কয়েক বছরে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। ইকো পার্ক তৈরি হয়েছে। সেখানে টয়লেট, ওয়াচ টাওয়ার, সুন্দর ঘাট, বনে হাঁটার পাকা সড়কও তৈরি করা হয়েছে। তারুয়া সমুদ্রসৈকতে গেলে মনে হবে আরেকটি কক্সবাজার এখানেই। বিশাল এলাকাজুড়ে এ সৈকতে মানুষ এসে মজা পাবে। এটা নিয়ে সরকারের আরও অনেক কাজ করার সুযোগও আছে।’

আরও পড়ুন

আশ্রয়ণের ঘর দিয়েছে আত্মবিশ্বাস, বদলে গেছে জীবন কাগজের ঘর থেকে সেমিপাকা, দুঃখ ঘুচেছে হোসনে আরার ঈদের ছুটিতে ভোলার পর্যটন স্পটগুলোতে মানুষের ঢল

ঢাকা থেকে চরফ্যাশনে ঘুরতে এসেছেন ব্যাংকার নাজমুল করিম। তিনি বলেন, ‘পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা জেলা ভোলা। উত্তর-দক্ষিণে দীর্ঘ একটি সুপ্রশস্ত সোজা সড়ক ঘিরে ভোলা জেলা। এক পথেই সোজা এই চর কুকরি মুকরি এবং তারুয়া সমুদ্রসৈকত। যাতায়াতের এই সহজ বিষয়টিও পর্যটনের জন্য ইতিবাচক। এর বাইরে এখানকার মানুষের অসাধারণ আতিথেয়তা প্রশংসনীয়। রাস্তায় চালকদের মধ্যে বেশি ভাড়া নেওয়ার প্রবণতা নেই। পণ্যের দামেও প্রতারণা নেই। কথা বলে বুঝলাম এলাকার লোকজনও চায়, এখানে পর্যটনের বিকাশ হোক।’

চরফ্যাশন এলাকার অটোরিকশাচালক রিপন বলেন, এখানে রাত-বিরাতে নির্ভয়ে মানুষ চলাচল করে। অতীতে কিছু সমস্যা হতো। এখন একেবারেই শান্ত ও শৃঙ্খল। চুরি, ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের ঘটনা তেমন নেই। ভোলার চরফ্যাশনের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ সালেক মূহিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘উপকূলীয় এ অঞ্চলে একদিকে বঙ্গোপসাগর-মেঘনা নদী, আরেক দিকে বুড়া গৌরাঙ্গ ও তেঁতুলিয়া নদী। উপকূলজুড়ে রয়েছে বিশাল বনভূমি। পাশাপাশি এখানে তারুয়া সমুদ্রসৈকত আছে, যেটিকে মিনি কক্সবাজারও বলা যায়। এই উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা পর্যটকদের জন্য একটা বিশেষ আকর্ষণ।’

Advertisement

‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি এবং বিদ্যুৎ আসায় সামগ্রিকভাবে ভোলা জেলায় পর্যটকদের আগমন আগের চেয়ে বেড়েছে। বিশেষ করে চরফ্যাশন উপজেলায় মানুষ আসছে বেশি। এখানে মানুষের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘এই এলাকার মানুষের পেশা মূলত মৎস্য আহরণ। ইকোপার্কের কারণে এখানকার মানুষের ব্যতিক্রমধর্মী উপার্জনের সুযোগ হয়েছে। পর্যটন বিকাশে এই ইকোপার্ক বা এ অঞ্চলের সম্ভাবনা অনেক। পর্যটনের যে সম্ভাবনা এখানে রয়েছে, সেটি যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে এখানের মানুষের জীবিকার একটি উৎস তৈরি হবে এবং এলাকার অর্থনীতি গতিশীল হবে। পর্যটনশিল্প বিকাশে আমাদের আরও কাজ করার সুযোগ রয়েছে। উপকূলীয় এ অঞ্চলে ইকো ট্যুরিজমের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পর্যটনশিল্প বিকাশে সরকার একটা মাস্টার প্ল্যানও করেছে।’ ভোলার জেলা প্রশাসক আরিফুজ্জামান বলেন, ‘ভোলা জেলার এই চর কুকরি মুকির আগামীতে পর্যটনের হটস্পট হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের পর্যটনশিল্প বিকাশে পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে যে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, তাতে ভোলা জেলার পর্যটন বিকাশের সহায়ক কর্মকাণ্ড অন্তর্ভুক্ত আছে।’

‘আমরা চাই, ভোলায় প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা পর্যটনের উৎসগুলো আরও পরিকল্পনার মাধ্যমে উন্নয়ন করে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে। এতে দেশি-বিদেশি পর্যটক আসবে এখানে। জেলার অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি যেমন শক্তিশালী হবে, সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা।’

ভোলা জেলার আরও দর্শনীয় স্থানের মধ্যে- চরফ্যাশনে মেঘনা নদীর পাড়ে গড়া ওঠা বেতুয়া প্রশান্তি পার্ক, চর ফ্যাশন কেন্দ্রীয় খাসমহল মসজিদ, জ্যাকব টাওয়ার, শেখ রাসেল বিনোদন পার্ক, ফ্যাশন স্কয়ার ভ্রমণপিপাসুদের তৃষ্ণা মেটাবে। এর বাইরেও ভোলা সদরে স্বাধীনতা জাদুঘর, দৃষ্টিনন্দন নিজাম হাসিনা মসজিদ নজর কাড়বে। দৌলতখান উপজেলার বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্মৃতি জাদুঘর এবং বোরহানউদ্দিন উপজেলায় তালুকদার বাড়ি পর্যটকদের ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ জোগাবে।

এসইউজে/এএসএ/জিকেএস