মতামত

বিভ্রান্তি নয় সঠিক তথ্য জানুন

আমাদের দেশে মোট ২৮ প্রজাতির বিষাক্ত সাপ ছিল, কিন্তু বর্তমানে প্রধানত ৫ প্রজাতির বিষাক্ত সাপ পাওয়া যায়- কোবরা (গোখরা), ক্রেইট (কালকেউটে), রাসেল ভাইপার (চন্দ্রবোড়া), গ্রীন পিট ভাইপার এবং সামুদ্রিক সাপ। এগুলোর মধ্যে কোবরা ও কালকেউটে বেশি, পার্বত্য চট্টগ্রামে গ্রীন পিট ভাইপার, সমুদ্রে সামুদ্রিক সাপ এবং কয়েক বছর ধরে রাজশাহী ও এর আশেপাশে রাসেল ভাইপার পাওয়া যাচ্ছে।

Advertisement

সাম্প্রতিক সময়ে রাজশাহী ছাড়াও আমাদের দেশের অনেকগুলো জেলায় রাসেল ভাইপার সাপ পাওয়া গেছে। কয়েক বছর পূর্বেও আমাদের দেশে রাসেল ভাইপার তেমন একটা ছিল না। কিন্তু কি কারনে আবারও রাসেল ভাইপার প্রত্যাবর্তন করেছে এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে তার কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এখনো পাওয়া যায় নাই। তবে এই রাসেল ভাইপার নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। এই ভুল তথ্যগুলোর জন্য মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন, সেজন্যই আজকের লেখার অবতারণা।

প্রশ্নঃ সাপ কেন কামড়ায়?উত্তরঃ আপনারা জেনে থাকবেন, অনেকেই গরমের সময় গাছের নিচে শুয়ে বিশ্রাম নেন। এই সময় অনেকের শরীরের উপর দিয়ে সাপ চলে যায়, কিন্তু সাপ কিছুই করে না। কারন সাপ চোখে দেখে না। এরা শব্দতরঙ্গ ব্যবহার করে শিকার করে। সাপ সাধারণত মাছ, পোকা-মাকড়, ইঁদুর, মুরগির বাচ্চা, ডিম, টিকটিকি, কীটপতঙ্গ ইত্যাদি খেয়ে বেঁচে থাকে। সাপের বিষ এসব প্রাণিকে হত্যার জন্য ব্যবহার করা হয়। সাপকে উত্ত্যক্ত করলে বা সাপ যখন নিজকে থ্রেটেন্ড মনে করে তখন আত্নরক্ষার্থে দংশন করে। সাপ নিজে থেকে কাউকে কামড় দেয় না।

প্রশ্নঃ রাসেল ভাইপার কি মানুষকে তাড়া করে? উত্তরঃ কোনো সাপই কাউকে তাড়া করতে পারে না। তাই রাসেল ভাইপার মানুষ দেখা মাত্রই ছুটে এসে কামড় দেয়, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্য।

Advertisement

প্রশ্নঃ রাসেল ভাইপার পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিষাক্ত সাপ? উত্তরঃ না। এরচেয়েও অনেক বেশি বিষাক্ত ও রাগী সাপ আছে যেমনঃ ইনল্যান্ড তাইপান, ব্লাক মাম্বা ইত্যাদি।

প্রশ্নঃ রাসেল ভাইপার দংশন করলে মৃত্যু কি অনিবার্য?উত্তরঃ এটিও একটি ভুল তথ্য। আমাদের দেশের প্রচলিত যেসব বিষাক্ত সাপ রয়েছে যেমন- কোবরা, ক্রেইট, তাদের বিষের ধরন এবং রাসেল ভাইপারের বিষের ধরন একই রকম; তবে রাসেল ভাইপারের বিষে একটি উপাদান আছে যা রক্ত জমাট বাঁধতে দেয় না। সেজন্য শরীরে যে কোনো জায়গায় রক্তক্ষরণ হতে পারে এবং রক্তক্ষরণ শুরু হলে রক্ত জমাট বাঁধবে না, তাই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হবে। কিন্তু রাসেল ভাইপারসহ আমাদের দেশের অন্যান্য বিষাক্ত সাপের বিষের আধুনিক চিকিৎসা রয়েছে। এবং রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি রাসেল ভাইপার দংশনের রোগীর চিকিৎসা হয়েছে এবং অধিকাংশ রোগীই সুস্থ হয়েছেন।

হাতে সাপ কামড়ালে এভাবে হাত বেঁধে দিতে হবে যেন নড়াচড়া করা না হয়। এতে করে বিষ শরীরে ছড়াতে দেরি হবে। পায়ে কামড় দিলে হাঁটা যাবে না।

প্রশ্নঃ সর্প দংশনের কতক্ষণ পর বিষক্রিয়া দেখা দেয়?উত্তরঃ সর্প দংশনের কতক্ষণ পর বিষক্রিয়া দেখা দিবে তা নির্ভর করে কতটুকু বিষ শরীরে প্রয়োগ করেছে, সাপটি দংশনের কতক্ষণ পূর্বে খাবার খেয়েছে, দংশিত স্থানটি (হাত বা পা) কেমন নড়াচড়া করা হচ্ছে ইত্যাদির উপর। দংশিত স্থান বেশি নড়াচড়া করলে বিষ দ্রুত সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। তবে বিষাক্ত সাপ কামড়ানোর ২৪ ঘন্টার মধ্যে শরীরে বিষক্রিয়ার লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এই সময়ের মধ্যে বিষক্রিয়ার লক্ষণ দেখা না দিলে ধরে নেয়া হয় যে রোগীর আর বিষক্রিয়া হবার আশঙ্কা নেই।

Advertisement

প্রশ্নঃ সর্প দংশনের রোগীর মৃত্যুর প্রধান কারন কি? উত্তরঃ অসচেতনতা। গত বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে একটি মাদ্রাসার বোর্ডিং এ রাতে ফ্লোরে ঘুমন্ত দুইজনকে সাপ কামড় দেয়। এরপর উনারা প্রথমে একজন ওঝার কাছে যান, উনি জানান কোন সমস্যা নেই। এরপর উনারা ২য় ওঝা এরপর ৩য় ওঝার আছে যান। এভাবে ৭ ঘন্টা সময় নষ্ট করে যখন উনাদের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, তখন উনারা হাসপাতালে রওনা হোন। পথের মধ্যে একজন মারা যান এবং অন্যজন হাসপাতালে পৌঁছার পর মারা যান। বিষাক্ত সাপ কামড়ানোর পর রোগীর শরীরে বিষক্রিয়া শুরু হবার পর যতদ্রুত সম্ভব বিষ নিষ্ক্রিয় করার ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে। যত দেরী হবে, রোগী সুস্থ হবার সম্ভবনা তত কমে যাবে।

প্রশ্নঃ ওঝার ঝাড়ফুঁকে কিছু রোগী ভালো হয় কেন? উত্তরঃ আমাদের দেশের বেশির ভাগ সাপ হলো অবিষাক্ত। তাই যেসব মানুষকে অবিষাক্ত সাপ কামড় দেয় অথবা বিষাক্ত সাপ কামড় দিয়েছে কিন্ত শরীরে সাপের বিষক্রিয়া হয় নাই, তাদের কোনো চিকিৎসা দরকার হয় না। অর্থ্যাৎ তারা এমনি ভালো হয়ে যান। এসব রোগী এমনি সুস্থ হয় কিন্তু নাম হয় কবিরাজের ঝাড়ফুঁকের।

সাপের কামড়ে যারা মারা যান তারা সাধারণত কর্মক্ষম এবং পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি হয়ে থাকেন। একটু সচেতন হলে এসব মৃত্যু আমরা ঠেকাতে পারি।

সাপ কামড়ানোর ঘটনাগুলো যেমন হয়১. মাছ ধরতে গিয়ে সাপে কামড় দেয়।২. বর্ষার সময় চারিদিকে যখন পানি থাকে তখন সাপ শুকনো জায়গার জন্য বাসার ভেতরে আশ্রয় নেয়। সাধারণত খড়ি রাখার জায়গায়, বিছানা, রান্না ঘর, আলনা, খড়ের গাদা ইত্যাদিতে আশ্রয় নেয়। এসব জায়গায় অন্ধকারে/শব্দহীনভাবে গেলে সাপ কামড়ানোর ঝুঁকি অনেক থাকে।৩. রাতের বেলা অন্ধকারে রাস্তায় চলার সময় সাপ কামড়ায়। কারণ সাপ সাধারণত রাতের বেশি চলাচল করে।৪. মুরগি বা হাঁসের ঘরে সাপ ডিম বা মুরগির বাচ্চা খেতে আসে। তখন সেখানে কোনো মানুষ গেলে সাপ কামড় দেয়।৫. গরমের সময় বারান্দায় বা উঠানে ঘুমানোর সময় সাপ মানুষকে কামড়ায়।

শক্ত করে গিঁট দেয়া বা ব্লেড দিয়ে কেটে দেয়া যাবে না

সাপ কামড়ালে করণীয়১. আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। কারণ আমাদের দেশে বিষাক্ত সাপের সংখ্যা কম। আর বিষাক্ত সাপ কামড়ালেও শরীরে বিষক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ৫০ ভাগ।

২. যে জায়গায় সাপ কামড় দিয়েছে সে জায়গাটা নাড়ানো যাবে না। শক্ত করে গিঁট দেয়া যাবে না, এতে করে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে, তবে পাতলা গামছা বা শাড়ির ছেঁড়া অংশ দিয়ে লুস করে বেঁধে যেতে পারে। কামড়ানো স্থান নড়াচড়া করলে বিষ দ্রুত শরীরে ছড়িয়ে পড়বে। তবে রাসেল ভাইপার কামড়ালে কোন ভাবেই বাঁধা যাবে না। এতে রোগীর মারাত্নক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

৩. রোগীকে ওঝার কাছে নেওয়া যাবে না, ঝাড়ফুঁক করা যাবে না, কবিরাজি চিকিৎসা করানো যাবে না। সাপ কাটার জায়গা ব্লেড দিয়ে কেটে ফেলা যাবে না।

৪. রোগীকে যতো দ্রুত সম্ভব হাসাপাতালে নিতে হবে। হাসপাতালে নেওয়ার সময় মোবাইলে বা যে কোনো মাধ্যমে খোঁজ নিতে হবে ওই হাসপাতালে সাপের বিষ নিষ্ক্রিয় করার ওষুধ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে কিনা। যে হাসপাতালে এই ওষুধ আছে সেই হাসপাতালে যেতে হবে তাহলে সময় নষ্ট হবে না, রোগী দ্রুত চিকিৎসা পাবে।

৫. রোগীকে সাপ কামড়ানোর সময় থেকে ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কারণ সাধারনত সাপ কামড়ানোর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শরীরে বিষক্রিয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে বিষক্রিয়ার কোনো লক্ষণ না হলে আর ভয়ের কোনো কারণ নেই।

সর্পদংশনের পর রোগীর শরীরে বিষক্রিয়া হলে, বিষ নিষ্ক্রিয় করার ওষুধ না দিলে মৃত্যু অবধারিত। আশার ব্যাপার হচ্ছে আমাদের সরকার দেশের সকল উপজেলা স্বাস্থ্য হাসপাতালে বিষনিষ্ক্রিয় করার ঔষধ সরবরাহ করেছে এবং উপজেলা পর্যায়ে সর্প দংশনের চিকিৎসার জন্য প্রয়জনীয় উদ্যগগ্রহন করেছে।

এ ব্যাপারে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করছেন স্বাস্থ্য বিভাগের অসংক্রামক ব্যাধি বিভাগের লাইন ডাইরেক্টর অধ্যাপক ডাঃ মোঃ রবেদ আমিন স্যার এবং প্রাক্তন ডাইরেক্টর জেনারেল অব হেলথ অধ্যাপক ডাঃ মোঃ আবুল ফয়েজ স্যার। আমাদের দেশের যে কোনো হাসপাতালে সর্প দংশনের রোগী ভর্তি হলে সারাদেশের সর্প দংশন বিশেষজ্ঞরা একটি হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে চিকিৎসার প্রয়োজনীয় মতামত ও সাজেশন প্রদান করেন। এতে করে প্রান্তিক পর্যায়েও সর্প দংশন রোগীর চিকিৎসা সুনিশ্চিত হচ্ছে।

রাসেল ভাইপার নিয়ে আমাদের আলাদা করে দুশ্চিতার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ এটি অন্য বিষাক্ত সাপগুলোর মতই এবং চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীর সুস্থতা সম্ভব। তাই সাপে কামড় দিলে রোগী ও স্বজনদের প্রথম কাজ দ্রুত নিকটস্থ হাতপাতালে যাওয়া। এই একটি সচেতনতাই সাপে কামড়ানো অনেক রোগীকে বাঁচাতে পারে। তাই আমাদের সকলের এ বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, প্রাইম মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠাতা- ডাক্তারখানা (জিপি সেন্টার)।

এইচআর/এমএস