পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীরের দুনীতির বিস্তারিত বিবরণ এখনও দেশবাসী পুরোটা হজম করতে পারেনি। এর মধ্যেই তার সহকর্মী, ঢাকা মেট্রপলিটান পুলিশর সাবেক কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়ার খবর পত্রিকায় এসেছে। আসছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক সদস্যের নানা র্কীতির খবর। সত্য মিথ্যা যাচাই হবে আদালতে বা হয়তো হবেও না। তবে সামাজিক মাধ্যমের কোনো কোনো পেইজ থেকে বলা হচ্ছে আরও অনেকের নাম। ঈদের ছুটিতে এ নিয়েই কথা হচ্ছিল একজন মন্ত্রীর সাথে। বললেন তিনি বিব্রত এবং এসব খবর পড়ে পড়ে অনেক সৎ কর্মকর্তাও চিন্তিত। তারা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আগের চাইতে বেশি বেশি দ্বিধাগ্রস্ত থাকছেন বলেও জানালেন মন্ত্রী।
Advertisement
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, অপার সম্ভাবনার বাংলাদেশের প্রায় সবটুকু কেড়ে নিচ্ছে এই দুর্নীতি। গুটিকয়েক ব্যাংক আর শেয়ার বাজার জালিয়াত, সরকারি কর্মকর্তাদের একটা অংশ এত বেশি দুর্নীতি করছে যে, অর্থনীতিটাই এখন সেই দর্শনের পথ ধরে এগুচ্ছে। এতে করে সৎ মানুষ, সৎ কর্মকর্তা, সৎ রাজনীতিক, সৎ সাংবাদিক, সৎ শিক্ষক এবং সৎ বুদ্ধিজীবীদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এমন একটা অবস্থা চলছে যে, বলতে হয় এ সমাজে সৎ মানুষ অসহনীয়।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে দুর্নীতি গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। অনাদীকাল থেকে আমাদের মানুষ জানে সরকারি কর্মীরা টু-পাইস খায়। টাকা না ছাড়লে ওরা কাজ করে না। কিন্তু ইদানীংকার গল্পগুলো একেবারে নতুন হয়ে উপস্থিত হচ্ছে মানুষের কাছে। মানুষ দেখছে নজির ভাই থেকে মিয়া ভাই তার থেকে রহমান ভাই - কারও কাহিনীই ছোট গল্প নয়, বড় উপন্যাস। এরা এক জীবনে এত বানায় কেমন করে এই প্রশ্নের চাইতে মানুষের জিজ্ঞাসা - এরা এত অশ্লীল কেন?, এতচা রুচিহীন কেন? অর্থ সম্পদ বানানোরও একটা সীমা থাকে! সব কি ভোগ করতে পারে এরা?
আসলে সরকারি, বেসরকারি, রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা – সমাজের সব খানে একটা নতুন কর্ম সংস্কৃতি চালু হয়েছে আর তাহলো যেভাবেই হোক, নিজের আখেরটুকু গোছাতে হবে। তার জন্য চরম নির্লজ্জ হতেও আপত্তি নেই। দুর্নীতি, স্তাবকতা ও চাটুকারিতা এখন মিলেমিশে একাকার বাংলাদেশে। কোনও সৎ, ঋজু মেরুদন্ড সম্পন্ন মানুষ দেখলে মনে হয় তিনি অন্য গ্রহ থেকে এসেছেন।
Advertisement
এ রকম একটি ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছে যে, আজকাল দুর্নীতির আশ্রয় না নিলে জীবনে কিছু করা যাবে না। এই ভাবনার পিছনে যে যুক্তিটা রয়েছে, সেটা এই রকম — যদি এক জন দুর্নীতির আশ্রয় নেন, তা হলে বাকিদের সৎ থাকাটা বোকামি, কারণ দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিটিই সব সুফল ঘরে নিয়ে নিবেন, বাকিরা কিছুই পাবেন না। তাই, যদি এক জন দুর্নীতির আশ্রয় নেন, তা হলে বাকিদেরও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এই ভাবনা থেকে একটি সর্বব্যাপী দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে বাংলাদেশে।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে কয়েক দফায় সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন আর আনুষঙ্গিক সুবিধাদি এত বাড়িয়েছেন যে এখন বড় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও এই বেতন কাঠামোর সাথে পেরে উঠছে না। আশা ছিল এত বেতন ও সুবিধা পাওয়ায় সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ঘুষ খাবেন না, দুর্নীতি করবেন না। কিন্তু তা হয়নি। এরা আরও বেপরোয়া হয়েছে, দুর্নীতি লাগামহীন হয়েছে এবং এই সরকারি লোকজন দুর্নীতিকেই কর্মসংস্কৃতি বানিয়ে ছেড়েছেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই বলতে হচ্ছে যে, অভাব থেকে নয় স্বভাব থেকেই দুর্নীতি করেন এরা।
দুর্নীতি, স্বজনপোষণ ও নির্লজ্জতা যে একটি ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। সমস্যাটি পুরোটাই স্বভাবজাত। সরকারি কর্মকর্তাদের কারও প্রাচুর্যের অভাব নেই, কিন্তু তাও দুর্নীতি তাদের চরিত্রগত হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের ‘সুযোগ’ কথাটা ব্যাপক আলোচিত। এই সুযোগ মানে জনসেবা নয়, বরং নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়া। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে একজন একটি অফিসে জায়গা করে নেন। এরপর শুধু ক্ষমতার ব্যবহার। ক্ষমতায় থাকাকালীন যতটা সম্ভব নিজের জন্য ও নিজের প্রিয়পাত্রদের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করার জন্য যা যা করার, সব কিছু করতেই তারা ব্যস্ত থাকেন। এখানে সঠিক-বেঠিক নিয়ে ভাবার কোনও ইচ্ছা তাদের নেই।
মূলত রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে প্রশাসন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিজে ডুবে আছে দুর্নীতিতে এবং সে ষড়যন্ত্র, জনবিরোধী কার্যক্রম এবং রাজনৈতিক অপকৌশল নিয়ে এত ব্যস্ত যে সরকারি কর্মীদের দিকে নজর দেওয়ার সময় নেই, বরং এদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে পুরোপুরি যার সুযোগ নিচ্ছে সরকারি কর্মকর্তারা।
Advertisement
আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুর্বল, আমাদের বিচার বিভাগ সেভাবে দুর্নীতি বিরোধী কোনো আশা জাগায় না। ফলে সরকারি অফিসের কর্ম সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্নীতি। যে সমাজ যত বেশি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে, তার দুর্নীতি-প্রবণতা আরও বেশি করে বাড়তে থাকে। এমনটাই ঘটছে আমাদের এখানে। এ পর্যন্ত যেসব বড় দুর্নীতিবাজের কথা মানুষ জেনেছে তাদের সাথে রাজনৈতিক দল ও সরকারের সম্পর্ক খানিকটা এনেবলার বা সক্রিয় প্রশ্রয়দাতার উপর নির্ভরতা’র মতো। রাজনীতি এবং দুর্নীতির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক এতখানি সম্পৃক্ত বলেই মানুষ আস্থা পায় না যে বিচার কখনও হবে, কারণ প্রশ্রয় চলতে থাকে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, ঢাকা জার্নাল।
এইচআর/এমএস