অর্থনীতি

অশুল্ক বাধা দূর করতে পদক্ষেপ চান ব্যবসায়ীরা

ভারত হচ্ছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানি উৎস, শীর্ষে চীন। বাংলাদেশের মোট আমদানির প্রায় ১৪ শতাংশ আসে ভারত থেকে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৩ শতাংশের বেশি আসে ভারত থেকে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ছিল ১ হাজার ১৬২ কোটি ডলার এবং এই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ভারতের অনুকূলে।

Advertisement

ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ আমদানির ক্ষেত্রে রক্ষণশীল নীতি অবলম্বন করায় ভারত থেকে আমদানি কমেছে। ভারতে রপ্তানির ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ কমেছে। এ সময়ে আয় হয়েছে ১৫৪ দশমিক ২০ কোটি ডলার, যা একই সময়ে আগের বছর ছিল ১৩২ দশমিক ২২ কোটি ডলার।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছর ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানি কমে দাঁড়িয়েছে ৯৪৯ দশমিক ২৪ কোটি ডলার, যা আগের বছরে ছিল ১ হাজার ৩৯৪ কোটি ডলার।

Advertisement

চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাস ও গত অর্থবছর দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দুই দেশের মধ্যকার ব্যবসা বাড়ানোর অনেক সুযোগ রয়েছে। ভারত বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতীম নিকট প্রতিবেশী। নৈকট্যের কারণে দুই দেশের বাণিজ্য বৃদ্ধির সুযোগ অনেক। এ সুযোগ কাজে লাগাতে প্রয়োজন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়ন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমন্ত্রণে দুদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে আগামীকাল শুক্রবার (২১ জুন) নয়াদিল্লি যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সফরে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ে একান্ত বৈঠক হবে। তারপর প্রতিনিধি পর্যায়ে আলোচনা হবে। সফরকালে উভয় দেশের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জোরদার করতে বেশ কিছু চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা রয়েছে। একটি বাণিজ্য চুক্তি বিষয়ে আলোচনা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এ সফর কেন্দ্র করে দুই দেশের বাণিজ্যিক নেতৃবৃন্দ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে নতুন আসার সঞ্চার হয়েছে। তারা ধারণা করছেন, দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের মধ্য দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে যে বাধা ও জটিলতা রয়েছে তা সহজতর হবে বলে আশা ব্যক্ত করেন তারা।

এ বিষয়ে দেশের ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা তাদের প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করেন এ প্রতিবেদকের কাছে।

Advertisement

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা ভারত থেকে টেক্সটাইল শিল্পের কাঁচামাল, কেমিক্যাল, সুতাসহ নানান পণ্য আমদানি করি। এক্ষেত্রে আমাদের দাবি, ভারত যেন এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার অব্যাহত রাখে। সরকারকে এক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে তা অর্জন করতে হবে।’ এতে উভয় দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক আরও বাড়বে এবং সম্প্রসারিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন শামীম।

পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য আগের তুলনায় বেড়েছে অনেক, যা উৎসাহব্যঞ্জক। কিন্তু আরও বাড়ার সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি করতে হবে। যেমন অবকাঠামো এবং যে ধরনের নিয়ম-নীতি রয়েছে তার আপগ্রেডেশন প্রয়োজন।’

‘ভারতে রপ্তানির ক্ষেত্রে অসংখ্য বাধা রয়েছে, যা বাণিজ্যের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বাধা দিচ্ছে। এটা আলোচনার টেবিলে থাকা উচিত। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আশানুরূপ সাফল্য মেলেনি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা এবং এ সম্পর্কে ওই দেশের ব্যবসায়ীদের ধারণা দিতে হবে যেখানে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের জন্য সুযোগ ও সম্ভাবনা দুটোই রয়েছে’ বলে জানান মাসরুর রিয়াজ।

দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক বাণিজ্য ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কৌশলগত বোঝাপড়া বাড়ানো প্রয়োজন। মিটিংয়ে বাংলাদেশকে ভারতের কাছে সহায়তা চাইতে হবে, যাতে বাংলাদেশ আঞ্চলিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ করে নেপাল ও ভুটানে প্রবেশ করতে পারে। তিনি বলেন, নেপাল থেকে কীভাবে বিদ্যুৎ আমদানি করতে পারে সে বিষয়গুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ তৈরি করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময়ে রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন ধরনের বিষয় আলোচনার টেবিলে থাকবে জানিয়ে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, ‘ভারত আমাদের নিকট প্রতিবেশী। তাদের সঙ্গে নানা ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। আমরা যে ধরনের পণ্য ভারতে রপ্তানি করি, সেখানে বিভিন্ন ধরনের অশুল্ক বাধা এবং জটিলতা রয়েছে। রপ্তানি প্রক্রিয়াটা আরও সহজতর করা প্রয়োজন।’

আশরাফ আহমেদ বলেন, দুই দেশের ব্যবসায়িক পরিধি বাড়ানো এবং সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য উভয় দেশের যে আইন ও নিয়ম-কানুন রয়েছে তার প্রায়োগিক বিষয়টা গুরুত্ব দিতে হবে।

বিদেশি বিনিয়োগের অনেক সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশে। ভারত আমাদের প্রতিবেশী দেশ হলেও সম্পূর্ণ সুযোগ আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। ভারত থেকে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যবসার সুযোগ রয়েছে তা তুলে ধরতে হবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে তাও তুলে ধরতে হবে বলে জানান আশরাফ।

আমরা ভারতে যাচ্ছি। ভারত বাংলাদেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বাজার। আমরা ব্যবসা ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করছি। আমরা যদি প্রস্তুত হই, তাহলে ভারত আমাদের জন্য অনেক বড় বাজার। এখানে ব্যবসা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে বলে জানান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহসান খান চৌধুরী। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হিসেবে ভারতে যাচ্ছেন।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি অনেক। এ সফরের মাধ্যমে হঠাৎ করে বাণিজ্য ঘাটতির উন্নতি হবে এমনটা প্রত্যাশা করা ঠিক নয়। আবার এটা সম্ভবও নয়। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত ভারতে পণ্য রপ্তানিতে যেন কোনো ধরনের বাধার সম্মুখীন না হই এবং কোনো ধরনের এন্টি ডাম্পিং ডিউটির মধ্যে না পড়ি। অন্যদিকে আমরা যে পণ্য আমদানি করি সেগুলোর ওপর যেন কোনো ধরনের রেস্ট্রিকশন না দেওয়া হয়। কারণ অতীতে দেখা গেছে, বিভিন্ন ধরনের রেস্ট্রিকশন দেওয়ার ফলে আমাদের ব্যবসায়ীরা সমস্যায় পড়েছেন এবং দেশীয় বাজারে হঠাৎ করে এক ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে।’

যেহেতু প্রতিবেশী দেশ এবং বাণিজ্যিক চুক্তির মাধ্যমে লেনদেন হয়। তাই হঠাৎ করে রেস্ট্রিকশন না দেওয়া এবং রেস্ট্রিকশনের আওতামুক্ত রাখার বিষয়টি দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন এ অর্থনীতিবিদ।

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ভারতের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি খুব ভালো হবে এমন প্রত্যাশা করা ঠিক নয়। কারণ তাদের নিজস্ব তৈরি পোশাক শিল্প আছে এবং তারা দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা দিয়ে থাকে। তাই যে পণ্যের চাহিদা রয়েছে, সেদিকে নজর দিতে হবে। ভারতের বাজারে প্রবেশ করতে ভিন্ন ভিন্ন পণ্য তৈরি করতে হবে।’

‘যদিও বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে কিন্তু এটা সব সময় খারাপ নয়। কারণ বাংলাদেশ যে ধরনের অন্য এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করে তার অধিকাংশই আমাদের শিল্পের উৎপাদনের কাজে ব্যয় হয়। সুতরাং ব্যবসা কত সহজে করা যায় এবং দুই দেশ লাভবান হয় সেই বিষয় চিন্তা করা উত্তম কাজ’, বলছিলেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক।

আমদানি রপ্তানির চিত্র

সাম্প্রতিক সময়ে ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। আগে যেখানে মূলত পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ থেকে শুরু করে খাদ্যপণ্য আমদানি করত, সেখানে এখন যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামালও আমদানি হয়।

বাংলাদেশের আমদানি করা ভারতীয় পণ্যের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে তুলা। গত অর্থবছর ১৯২ কোটি ডলারের তুলা আমদানি করে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমদানি হয়েছে ১০০ কোটি ডলারের খাদ্যশস্য। তৃতীয় আমদানি পণ্য হচ্ছে পারমাণবিক চুল্লি, বয়লার, যন্ত্রপাতি, যন্ত্রপাতির অংশ, যার মূল্য ছিল ৫৯ কোটি ডলার। এছাড়া রয়েছে রেলের বগি, ইঞ্জিনসহ অন্য আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ, যার মূল্য ছিল ৫৭ দশমিক ২৩ কোটি ডলার। চিনি ও চিনিজাত পণ্য আমদানি হয়েছে ৪৭ কোটি ডলারের। অন্য আমদানি পণ্য হলো চাল, মসুর ডাল, গম, ভুট্টা, ছোলা ডাল এবং বিভিন্ন ধরনের শিল্পের কাঁচামাল।

চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ভারতে পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১৫৪ দশমিক ২০ কোটি ডলার। যার মধ্যে ৬৮ দশমিক ৯ কোটি ডলার এসেছে তৈরি পোশাক থেকে এবং ১০ দশমিক ৭১ কোটি এসেছে কৃষিজাত পণ্য থেকে। জুতা ও তার উপকরণ রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৬ কোটি ডলার। অন্যদিকে চামড়া ও চামড়া পণ্য থেকে আয় হয়েছে ৮ কোটি ডলার। ভেজিটেবল টেক্সটাইল ফাইবার এবং ওভেন ফেব্রিক্স থেকে আয় হয়েছে ১৭ কোটি ডলার।

আইএইচও/এমএমএআর/এমএস