দেশজুড়ে

হারিয়ে যাচ্ছে দিনাজপুরের বিল-দেশি মাছ

• বিলকে পুকুর বানিয়ে মাছ চাষ, বিলের জমি দখল করে ধান চাষ• বিলগুলো উন্মুক্ত না থাকায় প্রাকৃতিকভাবে পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে• হারিয়ে যাচ্ছে দেশি জাতের মাছ

Advertisement

দখলদারত্বে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে দিনাজপুরের বিলগুলো। এক সময়ের উন্মুক্ত বিলগুলো পুকুর আকারে খনন করে ইজারা দেওয়া হয়েছে। এসব পুকুরে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ হলেও হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় জাতের মাছ। কোথাও কোথাও বিলের জমি দখল করে ধান চাষ করা হচ্ছে।

জেলা মৎস্য অধিদপ্তর ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, দিনাজপুর জেলায় ছোট বড় মিলিয়ে ২১টি নদী, দুই হাজার ৮৪৬টি সরকারি পুকুর ও ৫২ হাজার ৭১৭টি ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুর রয়েছে। জেলায় মৎস্যচাষির সংখ্যা ৪৪ হাজার।

এক সময় পাউবোর দিনাজপুর অফিসের ওয়েবসাইটে জেলার বিলগুলোর তালিকা পাওয়া গেলেও পরে তা সরিয়ে ফেলা হয়। পরে তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৮ সালের ১৯ জুলাই জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উপলক্ষে মতবিনিময় সভায় তৎকালীন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. এসএম রেজাউল করিম সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে দিনাজপুর জেলায় ৭৭টি সরকারি বিল রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন। ওই সময় জেলায় মাছের ঘাটতি ছিল ৯ হাজার মেট্রিক টন।

Advertisement

দিনাজপুরের কোনো সরকারি কার্যালয়ে বিলের নাম বা পরিসংখ্যান না পাওয়ার পর বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে আপলোড করা ‘ক্লাসিফিকেশন অব ওয়েটল্যান্ডস অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় বাংলাদেশের বিলগুলোর তালিকা পাওয়া যায়। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে করা সেই তালিকার ১২৫৩ থেকে ১২৯৪ পর্যন্ত সিরিয়ালে দিনাজপুরের ৪২টি বিলের নাম ও জমির পরিমাণ পাওয়া যায়। বিলগুলোর তথ্য সূত্র হিসেবে পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার (ওয়ারপো) জাতীয় পানিসম্পদ উপাত্তভান্ডারের (এনডব্লিউআরডি) কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

বিলগুলোর তালিকা ধরে খবর নিয়ে দেখা যায়, বিলগুলো আর উন্মুক্ত নেই। ছোট বিলগুলো পুকুর আকারে খনন করে ইজারা দেওয়া হয়েছে। বড় বিলগুলোর জমি দখল হয়ে গেছে। তালিকায় নাম নেই এমন বিলগুলোর জমিও ইজারা দেওয়া হয়েছে।

সদর উপজেলার একমাত্র বিল আমইর বিল খনন করে পাড় বেঁধে পুকুরের আকার দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ বিলটি ইজারা নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করছেন।

দিনাজপুরের সদর উপজেলার আমইর বিলকে পুকুর বানিয়ে মাছ চাষ করছেন স্থানীয় চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ। ছবি: জাগো নিউজ

Advertisement

নবাবগঞ্জ উপজেলায় আশুরার বিলের জায়গা দখল করে ধান চাষ করা হচ্ছে। এই বিলে প্রভাবশালীরা জমি দখল করে ২০ থেকে ২৫টি পুকুর খনন করেছেন। উপজেলা প্রশাসন একাধিকবার অভিযান চালিয়ে পুকুর খনন বন্ধ করে দেয়। বিলের জমি নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে ২০২২ সালে এক কৃষক অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের তালিকায় না থাকা বিরল উপজেলার দারইল বিলের অস্তিত্বও সংকটে পড়েছে। এ বিলের জমি ইজারা নিয়ে মাটি ভরাট করে অনেকে জমির আকার পরিবর্তন করে তিন ফসলী জমি বানিয়েছেন। এতে বিলের আয়তন কমে যাচ্ছে।

সদর উপজেলার দয়া রাম রায় বলেন, ‘বিলগুলো দেখভাল করতে সমিতি রয়েছে। কিন্তু প্রভাবশালীদের সঙ্গে তারা পেরে উঠছে না। বিলগুলো উন্মুক্ত না থাকায় প্রাকৃতিকভাবে পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। সে কারণে দেশি মাছও হারিয়ে যাচ্ছে। আগে বিলে-ঝিলে শাপলা, পদ্ম ফুল ফুটলেও এখন আর চোখে পড়ে না। জেলেদের জাল থাকলেও বিলে জল ও মাছ না থাকায় তারা তাদের পেশা পরিবর্তন করছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দেশি মাছের নাম বইয়ের পাতায় দেখতে পেলেও বাস্তবে দেশি মাছ চোখে দেখতে পাবে না।’

বিরল উপজেলার দারইল গ্রামের আমজাদ হোসেন ও জীবিত রায় জানান, ১৫-২০ বছর আগেও তারা দারইল বিলে মাছ ধরতেন। সেই বিলের জমিতে এখন ধান চাষ হয়। কেউ জোর করে, আবার কেউ ইজারা নিয়ে চাষবাস করেন। বিলে স্রোত না থাকায় দেশি মাছ আর পাওয়া যায় না। অল্প সময়ের মধ্যে এই বিলটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।

বিরল উপজেলার কড়াই বিল ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করছে বীর মুক্তিযোদ্ধা সমবায় সমিতি লি.। এ বিলে বাইরের পানি প্রবেশ করার সুযোগ নেই, বের হওয়ারও সুযোগ নেই। তাই প্রাকৃতিকভাবে দেশি মাছ উৎপাদনেরও সুযোগ নেই।

শহরের মাছ ব্যবসায়ী আব্দুল খলিল বলেন, ‘বাজারে যে কৈ, মাগুর, পাবদা, শিংসহ দেশি প্রজাতির মাছ দেখছেন তা প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া নয়। এসব মাছ এখন চাষ হচ্ছে। এগুলো চাষের মাছ। বর্ষা মৌসুমে দারিকা, পুঁটি চপড়া, শাটি, শৌল, চেং এজাতীয় মাছ পাওয়া গেলেও তা অতি সামান্য। দেশে তো বিল-ঝিল, জলাশয় হারিয়ে যাচ্ছে, কীভাবে দেশি মাছ উৎপাদন হবে?’

দিনাজপুরের বিরল উপজেলার কড়াই বিল ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করছে বীর মুক্তিযোদ্ধা সমবায় সমিতি লি.। ছবি: জাগো নিউজ

নবাবগঞ্জ উপজেলার মতিয়ার রহমান বলেন, “বিলগুলো দিন দিন প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাচ্ছে। তারা বিলগুলোর জমি দখল করে চাষবাস করছেন। ফলে প্রাকৃতিকভাবে মাছ, কুঁচিয়া, শামুক উৎপাদন হচ্ছে না। এগুলো দখলমুক্ত করে ‘জাল যার জল তার’ আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে। তবেই হয়তো দেশি মাছ প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদন হতে পারে।’

ফুলবাড়ী উপজেলার আফজাল হোসেন বলেন, ‘নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ছোট যমুনার তীর দখল করে স্থাপনা করা হচ্ছে। বিলগুলোতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই প্রকৃতি তার নিজস্ব স্বকীয়তা হারাচ্ছে।’

যোগাযোগ করা হলে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আশরাফুজ্জামান বলেন, দিনাজপুরে এখন ৬৭ হাজার ৩৯৬ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়, যা ২০১৮ সালেও ছিল ৫৬ হাজার ২৮ মেট্রিক টন। মাছের উৎপাদন বাড়লেও প্রাকৃতিকভাবে দেশি মাছ উৎপাদনের সুযোগ নেই বললেই চলে। আমরা দেশি মাছের পোনা উৎপাদন করছি। পুকুরে এখন দেশি মাছ চাষ হচ্ছে। বিলগুলোতে আমরা মাছের নার্সারি করেছি। শুষ্ক মৌসুমে রুইজাতীয় মাছের রেণু সংরক্ষণ করে বর্ষা মৌসুমে তা অবমুক্ত করছি। এতে বিলগুলোতে রুইজাতীয় মাছের উৎপাদন বেড়েছে। পুকুরে যে দেশি প্রজাতির মাছ বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে, সেই মাছগুলোর পুষ্টিগুণ প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদন হওয়া মাছের চেয়ে অনেক বেশি। মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি মাছ খায়।

এক প্রশ্নের উত্তরে আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘আমরা শুধু মাছ চাষের বিষয়টি দেখি। বিলের জমিগুলো দেখভাল করে ভূমি মন্ত্রণালয়। আমরা শুধু সরকারি বিল বা পুকুরের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তাদের অবগত করতে পারি।

এএমএইচএম/এমএমএআর/এমএস