'একটি ক্লীব কোমলবিশ্রামের চেয়েবলিষ্ঠ মৃত্যুঅনেক মহৎ ...'শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের শিলালিপি কবিতার এ পঙক্তি আমাদের নিয়ত শক্তি দেয়। একাত্তরের ঘাতক নেতা চৌধুরী মইনুদ্দিনের হাতে নিহত হন এ মেধাবী সাংবাদিক, দেশপ্রেমিক। মায়ের হত্যাকারীদের চাক্ষুষ করবার সাক্ষ্য আদালতে দিয়ে যেন পুত্র সুমন জাহিদ ও ২০১৮ সালের ১৪ জুন নির্মম হত্যার শিকার হলেন।
Advertisement
সাক্ষী সুরক্ষা আইন নিয়ে অনেক নিউজ করেছি। কিন্তু সাক্ষী সুরক্ষা আইন হলো না এদেশে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী দিতে রাজি ছিলেন না অনেকে। দেন নি অনেক রথী মহারথী। স্বয়ং আইনমন্ত্রীর স্ত্রী প্রগতিশীল আন্দোলনের ধারক বাহকদের একজন হয়ে ও সাক্ষ্য দেন নি। এ কথা স্বয়ং প্রসিকিউটার (প্রশাসন) জেয়াদ আল মামুন আমাকে বলেন, যখন তিনি বারবার অনুরোধ করে ও রাজী করাতে পারেন নি তাঁর সাবেক নেত্রীকে। এই সেতা নেত্রীরা পদ পদবীর অলংকার হিসেবে মাইক ফাটানো মন গলানো কথা বলে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। সুমন জাহিদ রা না পেয়েছেন সাক্ষী হিসেবে সুরক্ষা, না পেয়েছেন শহীদের সন্তান হিসেবে ন্যূনতম বাঁচবার অধিকার।
সুমন ভাইয়ের গলা কাটা লাশ আমাদের অপরাধী করে দেয় না? আমি কখনও মেনে নিতে পারবো না। ২০১৮ সালের ১৪ জুন শহীদ সেলিনা পারভীনের একমাত্র পুত্র সুমন জাহিদের গলাকাটা লাশ পাওয়া যায় রেললাইনের পাশে। শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের ছেলে সুমন জাহিদের খণ্ডিত লাশ পাওয়া গেছে ঢাকার খিলগাঁও বাগিচা এলাকায় রেল লাইনের পাশে। তিনি ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ধারণা করলেও তার মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটিসহ সকলে। কোন তদন্ত হয় নি , কোন তথ্য আমরা কেউ জানতে ও পারি নি। ঘাতক দালাল রাজাকারের হাত বরাবরই লম্বা এদেশে।
ব্যাংক কর্মকর্তা সুমন জাহিদ (৫৭) যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন মায়ের ঘাতক জামাত নেতা চৌধুরী মঈনুদ্দিন ও আশরাফউদ্দিনকে দেখেছেন তাঁর মা’কে চোখ বেঁধে নিয়ে যেতে। আদালতের বিচারে যুক্তরাজ্যে পলাতক ঘাতক জামাত নেতা চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক আশরাফুজ্জামান এদেশ কে মেধাশূন্য করবার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে বুদ্ধিজীবীদের চোখ-হাত পিছমোড়া করে বেঁধে বর্বরোচিত নিপীড়ন অত্যাচার করে পরিকল্পিত ভাবে হত্যার দায়ে ঘাতকদের মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়। বাস্তবায়িত হয় নি এ রায়। সুমন জাহিদের মতো অনেক সাক্ষীর মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন উঠলে ও তদন্ত হয় নি। ভয়ঙ্কর ঘাতকের নিপুণ প্রতিশোধে জীবন ভর রক্তাক্ত হচ্ছি আমরা. যাঁদের পূর্বসূরিরা দেশমাতৃকার কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করেছেন। এ দায় কি রাষ্ট্রের নয়?
Advertisement
সুমন ভাই রেললাইনে মাথা রেখে আত্মহত্যা করেছেন দাবিটি সত্য নয়। এটা হয় না। শহীদের সন্তানেরা আত্মহত্যা করতে পারে না। পরিস্থিতি পরিবেশ যখন বাধ্য করে, আত্মঘাতী হতে বারবার চেষ্টা করি আমরা অনেকে, পূর্বপুরুষের অসমাপ্ত কাজের পিছুটান ফিরিয়ে আনে। এত বড় শক্তি এ দায়, সেটাই যেন অপরাধ আমাদের। সমাজ গুণবে কেন? সে নিয়ে কোন দায় নেই কারো?
লোভী প্রবঞ্চক চালিত সমাজ এ দেশের জন্যে প্রাণ উৎসর্গ করা নিবেদিতপ্রাণ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কতটা ই বা সম্মান করে! তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সন্তান,শহীদের সন্তানদের যতো বঞ্চনা পরিবার,সমাজ করুক-তাঁদের পিতামাতার রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশের মাটি আঁকড়ে অসমাপ্ত কাজ করতে বদ্ধপরিকর আমরা, নিজের জীবন উজাড় করে। যা ধারণ করবার ক্ষমতা লোভী, হঠকারী প্রবঞ্চক শাসিত এ সমাজের অনেক মানুষের নেই।
লাল সবুজের পতাকা বুকে ধারণ করি আমরা আমৃত্যু। ভীত শত্রুরা জানে এই অসীম সততা তাদের পতন। সমাজপতিরা তাদের ক্রীড়নক। কতটা কষ্ট পেয়েছেন নিরীহ শহীদ সন্তান সুমন ভাই। সাংবাদিক সেলিনা পারভীন তাঁর জননী। এমন দেশপ্রেমিক নিবেদিত সন্তান জন্মদাত্রী মাকে চোখের সামনে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ধরে নেয়া, বর্বরোচিত ভাবে হত্যা করা, মায়ের ক্ষতবিক্ষত লাশ শনাক্ত করা- একজন সন্তানের জন্যে কতটা দুরূহ-এ কথা গুলো মনে হতেই নীরব চোখের জলে ভেসে যাই আমি।
কিন্তু আমি প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জানতে পারি আমার মা আর বেঁচে নেই। আমি জানতে পারি মা আর কখনোই আমার গায়ে তেল মেখে দেবেন না। আমার জন্য আর তিনি কোনদিন চকলেট নিয়ে আসবে না। আত্মীয়রা আমাকে বললো, আমার মা আল্লার কাছে চলে গেছে। ‘দুঃখ হয়, মা নেই, আমি মার স্নেহ বঞ্চিত। কিন্তু সেই সাথে গর্বিত বোধ করি এই জন্য যে, আমার মা বাংলাদেশের একজন শহীদ। এই দেশের মাটি ও মানচিত্র দেখলেই মার কথা মনে পড়ে। এই মানচিত্রের জন্য মা জীবন দিয়েছেন।’ কিন্তু… ‘ওই ঘৃণিত রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির শয়তানগুলো আজ সমাজে বড় বড় আসনে অধিষ্ঠিত আর মুক্তিযোদ্ধারা অবহেলিত। যখন দেখি শহীদের প্রাপ্ত সম্মান তাঁদের দেওয়া হচ্ছে না, তখন প্রচণ্ড দুঃখবোধ হয়। স্বাধীনতার মূল্যবোধ আজ পদদলিত। পশুরা আজ অন্য সুরে কথা বলে, খুনিরা মন্ত্রী হয়। এই জন্যই কি আমার মা ও শত শহীদরা তাদের আত্মা বিসর্জন দিয়েছিলেন? হত্যাকারীদের বিচার হলো না। আমরাতো হত্যার বদলে হত্যা হোক তা চাই না। যারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক, এই আমাদের দাবি।’ আমি এই হত্যাকান্ডের উপযুক্ত বিচার প্রার্থনা করি। এখন আমাদের সকলের একটাই চাওয়া, তা হলো এই জীবনদ্দশায় যুদ্ধাপরাধীর বিচার দেখে যাওয়া। তবেই সকল শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে। এভাবেই লিখে গেছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীন এর পুত্র সুমন জাহিদ । পড়ি, আর দৃপ্ত শপথে বার বার জাগি। এ ঋণ শহীদ সেলিনা পারভীনের শিলালিপির ঋণ– মাতৃঋণ কখনো শোধ করা যায় না। সেই ঋণের দায় মাথায় নিয়ে কাজ করে যাই নীরব অশ্রুজলে রক্তলেখায়।
Advertisement
কালজয়ী সুরকার শিল্পী শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন আপা লিখেছেন,সুমন ভাই কখনও তার বাবার নাম বলতেন না। দেখা ও করেননি কখনও। অত্যাচারী স্বামীকে শহীদ সেলিনা পারভীন ছেড়েছিলেন সুমন ভাই ছোট থাকতেই। প্রকাশনী আর লেখালেখি করে যা সামান্য আয় হত তা দিয়েই ছেলেকে নিয়ে জীবনযাপন করতেন। তাই তাঁর কাছে মা ছিল সব। রায়ের বাজার বধ্যভূমি থেকে মাকে শনাক্ত করেছিলেন তিনি। তখন তাঁর বয়স ছিল আট বছর। মাকে নৃশংসভাবে হত্যা করলো রাজাকার আলবদর বাহিনী। এরপর অনাথ সুমনের এতিমখানা, মাদ্রাসা আর মামার বাড়ি তে কোন ভাবে খেয়ে না খেয়ে কাটায়। কোন ভাবে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন। এর পর আরো কঠিন সংগ্রামী জীবন। জীবিকার তাগিদে অটো চালিয়ে পড়াশুনা শেষ করেন। আর রাজাকার আলবদর বাহিনীর লোকেরা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক এ দেশে। হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেসাতি করা লোকেরা ও কোটি কোটি টাকার মালিক। সরকারের বেশ অনুদান পান তো তাঁরা। অনাহারে থাকেন শহীদের সন্তানেরা। ছোট খাটো চাকরি করে জীবন চালাতেন।
না, দেশের জন্য এমন সব হারানো সহজ সরল নিরীহ মানুষদের পাশে কেউ থাকে না তো। হঠকারীদের পাশে থাকে সবাই। তেলা মাথায় তেল দেয় এই সমাজে সবাই।বেসাতি যে সমাজে ভয়ঙ্কর সর্বনাশ ডেকে এনেছে, সে সমাজ যোগ্যতার মূল্য দেয় না। সুমন ভাইকে কেউ সম্মানজনক উপার্জনের ব্যবস্থা করে দেয় নি। কী লজ্জাকর এ বাস্তবতা। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, শহীদদের নিয়ে, রাজাকার নিয়ে তাঁর কথা শেষ হত না। যুদ্ধাপরাধী বিচার দাবিতে সোচ্চার ছিলেন অনেকের চেয়ে বেশি, তাই সবাই নাকি বিরক্ত হতো। হায় রে কৃতঘ্ন সমাজ!
শহীদ মিনার, বধ্যভূমি অথবা স্মৃতিসৌধে সুমন ভাই লাল সবুজ জামা পরা,হাতে বাংলাদেশের পতাকা। মোটরবাইক চালাতেন তিনি। আমাদের নিয়মিত কাজ বা বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার অধিকার কারো নেই। দেশমাতৃকার কল্যাণে কাজ করে যাওয়া শহীদ সেলিনা পারভীনের হত্যার একমাত্র সাক্ষী তাঁর একমাত্র পুত্রের এমন মৃত্যুকে ‘পা পিছলে দুর্ঘটনায় মৃত্যু’বা অবসাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা’ বলা যায় না। তদন্ত করা হয়েছে? রাষ্ট্র এমন হত্যার তদন্তের দায় তো এড়াতে পারে না।
সেলিনা পারভীনের জন্ম ১৯৩১ সালের ৩১ মার্চ নোয়াখালী জেলার রামগঞ্জ উপজেলার ছোট কল্যাণনগর গ্রামে। পিতা মৌলবি আবিদুর রহমান এবং মাতা মোসাম্মৎ সাজেদা খাতুন। প্রকৃত নাম মনোয়ারা বেগম। ১৯৫৪ সালে তিনি এফিডেভিট করে সেলিনা পারভীন নাম গ্রহণ করেন। দেশের প্রথম সারির লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা লিখতেন শিলালিপি সাহিত্য পত্রিকায়। গল্প লিখেছেন বকর আহমেদ, সুনন্দা কবির, আহমদ রফিক, মুর্তজা বশীর, কুদরতুল্লাহ শাহ আর প্রবন্ধ লিখেছিলেন মুনীর চৌধুরী, জগলুল আহমদ চৌধুরী ও জেবুন্নিসা ইসলাম। ১৯৬৯ সাল থেকে এটির প্রকাশনা শুরু হয়েছিল। লেখা জোগাড়, সম্পাদনার কাজ একাই করতেন সেলিনা পারভীন। ১৯৬৯-এর রাজনৈতিক আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশ। নিজেও শরিক হন গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলন কর্মকাণ্ডে। ছেলেকে সঙ্গে নিয়েই বেরিয়ে পড়তেন ‘৬৯-এর ২১ ফেব্রুয়ারি পল্টনের জনসভায় বা শহিদ মিনার থেকে বের হওয়া নারীদের মিছিলে যোগ দিতে। শরিক হতেন বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদসভাতেও। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার প্রমুখদের সাথে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে সমাজতন্ত্রের প্রতিও আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। এরই মধ্যে শুরু হয় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেলিনা পারভীন ঢাকায় ছিলেন। তাঁর বাসায় মাঝে মাঝে রাতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা আসতেন। খাওয়া-দাওয়া করে চলে যাওয়ার আগে তারা সেলিনা পারভীনের কাছ থেকে সংগৃহীত ঔষধ, কাপড় আর অর্থ নিয়ে যেতেন। শিলালিপির বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়েই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বলিষ্ঠ অবস্থান নেয়ার কারণে পাকিস্তানি বাহিনীর চক্ষুশূল হয়ে ওঠে শিলালিপি পত্রিকা আর সম্পাদক। বারবার নিষিদ্ধ করেও শেষ হয় নি তাদের ক্রোধ,বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশা করে রাও ফরমান আলী খান। তার নির্দেশিত পথে এদেশের কুলাঙ্গার ঘাতকেরা তালিকা করে হত্যা করে বুদ্ধিজীবীদের।
কথাসাহিত্যিক ও সাহিত্যসমালোচক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, “কত অপূর্ণতার বাধা উপেক্ষা করেও সেলিনা পারভীন তাঁর অভিষ্টে পৌঁছাবার লক্ষ্যে স্থির ছিলেন। অনেক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও দেশের প্রতি তাঁর ত্যাগ আমাদেরকে গর্বিত করে।” সেলিনা পারভীন ফেনীর সরলা বালিকা বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি প্রাইভেট ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেন। কৃতকার্য হতে পারেননি।
১৯৪৫ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার মোহনগঞ্জে থাকার সময় কলকাতা নিবাসী শিক্ষয়িত্রী উমার সাহচর্য লাভ করেন। তিনি তাঁকে সাহিত্য সাধনায় অনুপ্রাণিত করেন। কবিতা দিয়ে তাঁর সাহিত্যের পথে যাত্রা শুরু হয়। বিভিন্ন সময়ে নিবন্ধ ও প্রতিবেদন প্রকাশ করতেন। তাঁর লেখা সে সময়ের পত্রিকা পূর্বদেশ, আজাদ, দৈনিক পাকিস্তান, সংবাদ, ইত্তেফাক ও বেগম পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। ১৯৫৭ সালে তিনি মিটফোর্ড হাসপাতালে নার্সিং প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৫৯ সালে রোকেয়া হলে কিছুকাল মেট্রনের চাকরি করার পরে ১৯৬০-৬১ সালে আজিমপুর বেবিহোমে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬৫ সালে সলিমুল্লাহ এতিমখানায় চাকরি করেন কিছুকাল। ১৯৬৬ সালে তিনি সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকায় সম্পাদকের সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৭ সালে যোগ দেন সাপ্তাহিক ললনা পত্রিকায়। এ সময় থেকেই নিবন্ধ রচনা ও সাংবাদিকতায় দক্ষতা অর্জন করেন।
মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে সেলিনা পারভীনসহ অন্তত ৩০ জনকে মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত বন্দি করে রাখা হয়েছিল। বন্দিদের মধ্যে আরও ছিলেন মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী।১৪ ডিসেম্বর গভীর রাতে সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় রায়েরবাজারের বটতলায়। লম্বা দড়ি দিয়ে ৩০ থেকে ৪০ জনকে সোজা লাইনে দাঁড় করিয়ে হাত বাঁধা হয়। তাঁর মুখে ও বুকে বেয়নেট চার্জ করা হয়, পরে গুলি করা হয়। পায়ে মোজা দেখে তাঁকে শনাক্ত করেন তাঁর স্বজনরা। ১৮ ডিসেম্বর সেলিনা পারভীনের মরদেহ আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
শিলালিপি পত্রিকার প্রচ্ছদ ও বিভিন্ন রচনা পাকিস্তানি সেনাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকারদের সন্ত্রস্ত করে। শিলালিপি পত্রিকার প্রচ্ছদ ও অন্যান্য কাজে গ্রামীণ বাংলার অলংকার ব্যবহার করা হতো।বাঙালিয়ানা বাদ দিয়ে পাকিস্তানি ভাবধারায় পত্রিকাটি প্রকাশের নির্দেশ জারি করেছিল পাকি সেনা রাও ফরমান আলী। সেলিনা পারভীন তা মানবেন কেন? সেটা অপরাধ পাকি ঘাতকদের কাছে।
শিলালিপির শেষ সংখ্যায় প্রস্তাবিত প্রচ্ছদ ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। বর্বরোচিত মৃত্যুর মাঝে কি শেষ হয় মাতৃভাষা রক্ষার সংগ্রাম? হতে পারে না। প্রজন্মান্তরে জেগে থাকবেই সত্যনিষ্ঠতা, দেশপ্রেম। সেই সংগ্রাম যেন আমরা এগিয়ে নিতে পারি একাত্ম হয়ে।
এই লেখাটি সাতসকালে লিখেছি অশ্রুজলে সিক্ত রক্তাক্ত হৃদয়ে। আমাদের অব্যক্ত কথাগুলো কালো কালিতে প্রকাশিত হয় সামাজিক মাধ্যম বা পুস্তকে, কিন্তু ন্যায়বিচার যে দূর হতে দূরে সরে যায়।
সাক্ষী সুরক্ষা আইন যদি বাস্তবায়িত হতো, অনেক মেধাবী সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যার স্পর্ধা দেখাতো না ঘাতকেরা।
এ মাটির প্রতিটি ধুলিকণা পবিত্র রক্তে স্নাত-একথা যেন আমরা ভুলে না যাই।
১৪ জুন ২০২৪ সকাল ৮টা, ঢাকা
লেখক: অনুসন্ধানী সাংবাদিক।arcsumik@gmail.com
এইচআর/এমএস