মতামত

চুরি করা গরুতে কোরবানি হয় না

তখন আমি ক্লাশ সেভেনে পড়ি। একবার কোরবানির ঈদের আগে স্কুলের ধর্ম শিক্ষক ক্লাশে বললেন, কোরবানি দিলে তো সওয়াব হয়। আমরা সবাই বললাম, জ্বী স্যার। এরপর স্যার বললেন, গরু চুরি করলে তো গুনাহ হয়। আমরা আরো জোরে বললাম, জ্বী স্যার। এরপর স্যার বললেন, কেউ যদি একটি গরু চুরি করে কোরবানি দেয় তাহলে কী হবে। চুরি করার গুনাহ আর কোরবানি করার সওয়াব কাটাকাটি হয়ে যাবে। মাঝখানে মাংসটা লাভ থাকবে।

Advertisement

স্যারের যুক্তি শুনে আমরা পাজলড হয়ে গেলাম। স্যারের যুক্তিও ফেলনা নয়। অঙ্কের হিসাবে মাংসটা তো বোনাস। আবার চুরির বিষয়টাও মানতে মনে সায় দিচ্ছিল না। গোটা ক্লাশ চুপ। হঠাৎ স্যার হুঙ্কার দিলেন, আরে গাধার দল। চুরি করা গরু দিয়ে কোরবানি হয় না। তাই সওয়াব পাওয়ার আশা নেই। চুরি করার সাথে সাথেই সব শেষ। একজন চোর কখনো সওয়াব পাবে না। আসল কথা হলো, নিয়ত। তোর নিয়তই যদি ঠিক না থাকে, তাহলে আর কোনোকিছুতেই কোনো লাভ নেই।

ধর্ম স্যার ছেলেবেলাতেই পাপ-পূণ্যের হিসাবটা পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন। কিন্তু কেন জানি মনে হয়, সব স্কুলের ধর্ম স্যার বোধহয় এই শিক্ষাটা দিতে পারেননি। চারদিকে দেখি ধর্ম নিয়ে অনেক হিসাব-নিকাশ। সওয়াব-গুনাহে কাটাকাটি করে মাংস পাওয়ার লোভ। আল্লাহর সাথেও আমরা চালাকি করি।

মুসলমানদের পাঁচ ফরজের একটি হজ। সামর্থ্যবান সব মুসলমানকে হজ করতেই হবে। শুধু আর্থিক সামর্থ্য নয়, হজের সাথে শারীরিক সামর্থ্যেরও একটা বিষয় আছে। হজ একটা কষ্টকর ইবাদত। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যারা হজ করতে যান, তাদের অধিকাংশই বয়স্ক। সবার নিয়ত থাকে, সারাজীবন ঘুষ, দুর্নীতি, চুরি সব করে টাকা কামাবেন; আয়েশ করে জীবনযাপন করবেন। আর শেষ বয়সে হজ করে এসে সাধু সাজবেন। মুসলমানরা বিশ্বাস করেন পবিত্র কাবা ঘরে স্থাপিত হজরে আসওয়াদে একবার চুমু খেতে পারলেই সারাজীবনের সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। হজ থেকে এসে আর কোনো পাপ কাজ করবেন না। যারা দীর্ঘায়ু পান, তারা হজ করে এসে অন্তত ৪০ দিন কোনো পাপ কাজ করেন না। তারপর আবার শুরু করেন। তার নিয়ত থাকে, আবার একবার হজ করে নেবেন। এসব চতুর মুসলমানের কাছে হজ হলো পাপ ধোয়ার ওয়াশিং মেশিন।

Advertisement

আমার এক বন্ধু নিয়মিত অ্যালকোহল সেবন করেন। তো একবার পার্টিতে দেখি তিনি শুধু জুস খাচ্ছেন। কেন, জানতে চাইতেই বললেন, ওমরাহ করে এসেছি ৩৮ দিন হলো। আর দুইদিন বাকি আছে। তারপর আবার পার্টি করবো। এই ধূর্ত মুসলমানেরা কি জানেন না, আল্লাহ অন্তর্যামী। তিনি সব দেখেন, সব জানেন, সব বোঝেন। ছেলেবেলায় রোজা রেখে আমাদের কেউ কেউ গোসলের সময় পুকুরে নেমে ডুব দিয়ে পানি খেয়ে নিতো। ধারণা ছিল, আল্লাহ দেখতে পায়নি। সেই ছেলেমানুষি ভাবনাটা আমাদের বড় মানুষদের মধ্যেও দেখি। সারাজীবন চুরি করে, শেষ বয়সে হজ করে পুতপবিত্র হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা বুঝি আল্লাহ দেখেন না? এই চালাকিটা বুঝি আল্লাহ ধরতে পারেন না। অনেকে হজ করার জন্য টাকা আলাদা করে রাখেন।

শুধু সৎ পথে উপার্জিত অর্থই হজ করার জন্য রাখেন। পাশাপাশি অসৎ পয়সায় আয়েশী জীবনযাপন করেন । এক ফোটা চনা যেমন এক মন দুধ নষ্ট করার যথেষ্ট। তেমনি অসৎ পথে উপার্জিত অর্থ আপনার সকল অর্থকেই অবৈধ করে ফেলবে। সে অর্থে আপনার কোরবানি, হজ কিছুই হবে না, হওয়ার কথা নয়।

অনেকেই আছেন সারাজীবন যেনতেন ভাবে অর্থ উপার্জন করেন। তারপর গ্রামে গিয়ে মসজিদ বানান, মাদ্রাসা বানান। সেই মসজিদ-মাদ্রাসা থেকে সারাজীবন তারা সওয়াব পাবেন, এই ধারণায়। কিন্তু আপনার উৎসটা যদি ঠিক না থাকে, তাহলে আপনি যত যাই করেন, তা কবুল হবে না। আমরা ব্যাংকের টাকা নিয়ে মেরে দেই। দুর্বল প্রতিবেশীর জায়গা দখল করি। গরীবের হক মেরে খাই। কিন্তু নামাজ পড়তে পড়তে কপালে দাগ ফেলে দেই। অনেকসময় ঘুষ নেয়াটাতে আমরা ন্যায্য বলেই মেনে নেই। ঘুষের টাকা হাত দিয়ে না নিয়ে ড্রয়ার খুলে দিয়ে বলি, অজু করে এসেছি, এখন আর হাত দিয়ে ধরবো না। ড্রয়ারে রেখে দিন। হে আল্লাহ, তুমি এই আমাদের ইবাদতকবুল করবে তো?

বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। তাহলে এই দেশে এত ধর্ষণ, এত দুর্নীতি, এত অনিয়ম হয় কেন? একজন ভালো মুসলমান তো কখনো কোনো খারাপ কাজ করতে পারেন না। আপনি নামাজ পড়বেন, রোজা রাখবেন; আবার চুরি করবেন, দুর্নীতি করবেন, ঘুষ খাবেন। দুইটা কিন্তু একসাথে চলতে পারে না।

Advertisement

বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। তাহলে এই দেশে এত ধর্ষণ, এত দুর্নীতি, এত অনিয়ম হয় কেন? একজন ভালো মুসলমান তো কখনো কোনো খারাপ কাজ করতে পারেন না। আপনি নামাজ পড়বেন, রোজা রাখবেন; আবার চুরি করবেন, দুর্নীতি করবেন, ঘুষ খাবেন। দুইটা কিন্তু একসাথে চলতে পারে না।

কোরবানি হলো ত্যাগ। আল্লাহর জন্য ত্যাগ। আমাদের দেশে অনেক লোকের কোরবানি দেয়ার সামর্থ্য নেই। তবু ঈদ এলে বছরে অন্তত একবার মাংস খাওয়ার সুযোগ পান তারা। ইসলাম ধর্মে ঈদের ধারণাটাই হলো আনন্দটা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া। কিন্তু ঈদ এলেই ফ্রিজের বিক্রি বেড়ে যায়। আমরা গরু কিনেই মাংসের হিসাব করতে থাকি। অথচ কুরবানীর মাংসে আমাদের চেয়ে গরীবের দাবি বেশি। যারা চাইলেই সারাবছর মাংস খেতে পারি, তাদের চেয়ে যারা মাংস খাওয়ার জন্য ঈদের অপেক্ষায় থাকে; কোরবানিতে তাদের দাবি বেশি। ইদানীং কোরবানিতে ত্যাগের চেয়ে দেখনদারি বেশি। এবার কোটি টাকার গরু, ১৫ লাখ টাকার ছাগল নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। হিসোব করে দেখা গেছে কোটি টাকার গরুতে প্রতি কেজি মাংসের দাম পড়েছে ৮ হাজার টাকা। কোটি টাকা দিয়ে গরু কেনাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। যার সামর্থ্য আছে, তিনি কিনতেই পারেন। কিন্তু যিনি কিনেছেন, তিনি সেই কোটি টাকার হিসাব আয়কর কর্মকর্তার কাছে না হোক, আল্লাহর কাছে দিতে পারবেন তো।

এই দেখনদারিটা আমাদের সর্বত্র। ঈদের দুদিন আগে এক বাসায় গিয়ে শুনলাম, গ্যারেজে কার গরু আগে রাখবে, কার গরু পেছনে; এটা নিয়ে মারামারি লাগার অবস্থা। যাদের অন্তরে এত বিদ্বেষ, এত অসহিষ্ণুতা; তারা কীভাবে নিজেদের ভালো মুসলমান বলে দাবি করতে পারেন।

টাকার গরমে আমরা ধর্মের মূল চেতনাটাই ভুলে যাই। ইসলাম ধর্মের মূল চেতনাটাই হলো আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা। আল্লাহর জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা। আল্লাহর সৃষ্টির জন্য করা। মানুষকে ভালোবাসা। আপনি অন্যায় করবেন না, দুর্নীতি করবেন না, মানুষের হক মারবেন না, কাউকে ঠকাবেন না। হালাল রুজি খাবেন। মানুষকে ভালোবাসবেন, মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। আল্লাহ অবশ্যই আপনাকে ভালোবাসবেন, আপনার পাশে দাঁড়াবেন। হিসাব-নিকাশ করা প্রার্থনা, কোটি টাকা দামের গরু বা অবৈধ অর্থে বানানো মসজিদ-মাদ্রাসা আপনাকে আল্লাহর কাছে পৌঁছাতে পারবে না। আপনার এসব ওপর চালাকি নিশ্চয়ই অন্তর্যামীর অজানা থাকে না।

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/জেআইএম