দেশজুড়ে

সেন্টমার্টিন চলাচলকারী নৌযানের দিকে গুলি ও বিরাজমান পরিস্থিতি

প্রায় এক দশক আগে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার সেন্টমার্টিন দ্বীপ সংলগ্ন স্থানে বঙ্গোপসাগরের মাঝে দুটি স্থানে বালুচর জেগে ওঠে। এই দুটো বালুচরের কারণে ভাটার সময়ে সেন্টমার্টিনে চলাচল করা যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌযানগুলো সাগরের ভেতর মিয়ানমারের একটি অংশ ব্যবহার করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সঙ্গে বাংলাদেশের বিজিবির সমন্বয়ের কারণে এই চলাচলে ইতিপূর্বে কখনোই কোনো বাধার সৃষ্টি হয়নি।

Advertisement

তবে সম্প্রতি আরাকান আর্মি মিয়ানমারের এই অঞ্চল দখল করে নেয়ার কারণে সৃষ্ট সমন্বয়হীনতার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের সেন্টমার্টিনগামী ট্রলার ও নৌযানগুলোকে লক্ষ্য করে আরাকান আর্মি গুলি ছুড়ছে। ফলে কর্তৃপক্ষ বাণিজ্যিক ট্রলার ও স্পিডবোট চলাচল সাময়িক স্থগিত করায় সেন্টমার্টিনে বসবাসকারীদের মধ্যে খাদ্য সংকট তৈরি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।

জানা যায়, টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় নাফ নদী এবং বঙ্গোপসাগরের মোহনায় গোলারচর নামক এলাকায় আনুমানিক দুই কিলোমিটার জুড়ে বড় একটি বালুর চর এবং গোলারচর থেকে আনুমানিক পাঁচ থেকে সাত কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের মধ্যবর্তী স্থানে নাইক্ষ্যংদিয়া নামক স্থানে এক কিলোমিটারের মধ্যে আরো একটি বালুর চর ভাটার সময় জেগে ওঠে। ফলে টেকনাফের দমদমিয়া জেটিঘাট থেকে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে যাত্রা করা যাত্রী ও পণ্যবাহী জাহাজ, মাছ ধরার ট্রলার, সার্ভিস বোট এবং স্পিডবোটসহ সব ধরনের নৌযানগুলোকে গমনাগমনের সময় জেগে ওঠা বালুর চরের কারণে আন্তর্জাতিক নৌ সীমান্ত রেখার (আইএমবিএল) মিয়ানমার অংশের নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকা ব্যবহার করতে হয়। এই চর দুটি খনন করা হলে মিয়ানমারের জলসীমা আর ব্যবহারের প্রয়োজন হবে না।

গত ১ জুন বিকেল সাড়ে ৩টায় টেকনাফ পৌরসভার নৌকা ঘাট থেকে একটি ট্রলার সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে মুদি মালামাল ও ১০ জন যাত্রী নিয়ে ছেড়ে যায়। আনুমানিক বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে নাইক্ষ্যদিয়া খাল এলাকা অতিক্রমের সময় আরাকান আর্মি ট্রলারকে লক্ষ্য করে ছয়-সাতটি গুলি চালায়। অবশ্য এতে কেউ হতাহত হয়নি। ট্রলারটি বিকেল ৫টা ৫৫ মিনিটে সেন্টমার্টিন দ্বীপে নিরাপদে পৌঁছে।

Advertisement

গত ৫ জুন সেন্টমার্টিনের জিনজিরায় স্থগিতকৃত একটি কেন্দ্রে টেকনাফ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদের ফলাফল নির্ধারণের জন্য ভোট গ্রহণ করা হয়। অনুষ্ঠান শেষে বিকেল ৫টা ৪৫ মিনিটের দিকে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট শাফকাত আলীর নেতৃত্বে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ মোট ২৭ জন সেন্টমার্টিন থেকে টেকনাফের উদ্দেশে মেটাল শার্ক ও কাঠের বোটে টেকনাফে ফিরছিলেন। পথে নাফ নদী এবং বঙ্গোপসাগরের মোহনায় নাইক্ষ্যংদিয়া চর এলাকা অতিক্রম করার সময় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের মেগিচং এলাকা থেকে তাদের নৌযান লক্ষ্য করে আরাকান আর্মি গুলিবর্ষণ করে। এতে মেটাল শার্কে দুটি ও কাঠের বোটে চারটি গুলি লাগে। পরে ওই বোট এবং মেটাল শার্ক নিরাপদে টেকনাফ কোস্টগার্ডের বোটপুলে ফিরে আসে।

এরপর গত ৮ জুন আনুমানিক ১২টার দিকে নাইক্ষ্যংদিয়া খাল সীমান্তে নাফ নদীর মোহনায় দুটি কাঠের ট্রলার, টেকনাফ পৌরসভার কাউকখালী ঘাট থেকে সিমেন্ট, রড ও ছয়জন যাত্রী নিয়ে নৌকায় করে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে রওনা হয়। পথে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের মেগিচং ক্যাম্পের ওয়াচ টাওয়ার থেকে আরাকান আর্মি ১৫ থেকে ২০টি গুলি চালায়। পরে ট্রলার দুটি ১২টা ২৫ মিনিটের দিকে শাহপরীর দ্বীপ জেটিঘাটে ফিরে আসে। এতে একটি ট্রলারে সাতটি গুলি আঘাত হানে। এ ঘটনায়ও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

১১ জুন সকাল ১০টা ৩০ মিনিটের দিকে টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের গোলারচরের বিপরীতে মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া খাল সীমান্তে নাফ নদীর মোহনা হয়ে একটি স্পিডবোটযোগে সেন্টমার্টিনের পাঁচজন স্থানীয় বাঙালি শাহপরীর দ্বীপ জেটি থেকে সেন্টমার্টিনে যাচ্ছিলেন। পথে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের মেগিচং বিজিপি ক্যাম্পের ওয়াচ টাওয়ার এলাকা থেকে আরাকান আর্মি স্পিডবোটকে লক্ষ্য করে চার থেকে পাঁচটি গুলি করে। এতে স্পিডবোটে অবস্থানরত বাঙালিরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন, যদিও কেউ হতাহত হননি। পরে ১১টার দিকে স্পিডবোটটি সেন্টমার্টিনে পৌঁছায়।

গুলিবর্ষণের কারণে কয়েকদিন যাবত টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে নৌযান চলাচল বন্ধ থাকায় খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপে আট হাজার ৪৯২ জন বাসিন্দা বসবাস করে। জেলা ও উপজেলা পর্যায় থেকে খাদ্য/পণ্য সরবরাহ করা না গেলে এই দ্বীপের বাসিন্দারা খাদ্য সংকটে পড়ে। কারণ, সেন্টমার্টিনের সাধারণ জনগণ মূলত টেকনাফ থেকে খাদ্যপণ্য নিয়ে জীবন-যাপন করে। বিরাজমান পরিস্থিতিতে ১৩ জুন থেকে কক্সবাজার বিআইডব্লিউটিএ ঘাট থেকে বঙ্গোপসাগর হয়ে বড় বড় ট্রলারে সেন্টমার্টিনে পণ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখা হচ্ছে।

Advertisement

নৌযান চলাচল স্থগিত এবং খাদ্য সংকটের পাশাপাশি মিয়ানমার নৌবাহিনীর টহল বৃদ্ধি পাওয়ায় দ্বীপটির স্থানীয়দের মধ্যে আতংক বিরাজ করছে। এ অবস্থায় দ্বীপের স্থানীয়দের আতংকিত না হওয়ার জন্য পদক্ষেপ নিতে পারে প্রশাসন।

এর পাশাপাশি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত গুলিবর্ষণের ঘটনা রোধে আরাকান আর্মির সঙ্গে প্রয়োজনীয় সমন্বয়সাধন করতে পারে। এছাড়াও সমস্যাটির স্থায়ী সমাধানের জন্য টেকনাফের সাবরাং টুরিজ্যম ইকো পার্ক সংলগ্ন সাগর উপকূলে একটি জেটি ঘাট নির্মাণ করা যেতে পারে।

সাবরাং ইকো পার্ক বিচ থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের দূরত্ব আনুমানিক ২৪ কিলোমিটার। অপরদিকে বর্তমান জেটিঘাট (দমদমিয়া কেয়ারি জেটিঘাট) থেকে সেন্টমার্টিনের দূরত্ব আনুমানিক ৩৪ কিলোমিটার। সাবরাং টুরিজ্যম ইকো পার্ক সংলগ্ন সাগর উপকূলে জেটি ঘাট নির্মাণ করা হলে সেন্টমার্টিনের সঙ্গে টেকনাফের যোগাযোগ সহজ ও কম সময়ে সম্পন্ন হবে এবং স্থানীয় জেলে, পর্যটক ও সেন্টমার্টিনের স্থানীয় বাসিন্দাদের টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে গমনাগমন কম সময় সাপেক্ষ, সহজ ও নিরাপদ হবে।

এমএমএআর/জেআইএম