সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার ছয়দিন আগেই জেনে যান সাইদুল করিম মিন্টু। কিন্তু বিষয়টি তিনি চেপে যান। আনারের আসনে সংসদ সদস্য হতে দীর্ঘদিনের চেষ্টা ছিল ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌরসভার সাবেক এ মেয়রের। পাশের একটি আসনের এমপির মৃত্যুর পর সেখান থেকেও তিনি মনোনয়নপত্র কেনেন।
Advertisement
নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের হাতে গ্রেফতার মিন্টু বর্তমানে আট দিনের রিমান্ডে আছেন। এ হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত কয়েকজনের সঙ্গে মিন্টুর যোগাযোগ, কিলার আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়াকে জিজ্ঞাসাবাদে তার নাম আসা, তার আগে থেকে আনারের সঙ্গে দ্বন্দ্ব প্রভৃতি বিষয় সামনে এনে ঘটনার সঙ্গে তার যোগসূত্র খুঁজছেন গোয়েন্দারা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ঝিনাইদহ-৪ সংসদীয় আসন ও সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্ব লাগে আনারের সঙ্গে। টানা তিনবার আনার ওই আসনটি দখল করে আছেন। এ আসনের সংসদ সদস্য হওয়ার স্বপ্ন অনেক আগে থেকেই ছিল মিন্টুর। ঝিনাইদহ-১ (শৈলকুপা) আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল হাই মারা যাওয়ার পর সেখান থেকেও মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন মিন্টু। কিন্তু তিনি দলীয় মনোনয়ন পাননি। সাবেক এ মেয়রের অনেক দিনের ইচ্ছা তিনি এমপি হবেন।
যেভাবে রাজনীতিতে আসেন মিন্টু
Advertisement
ঝিনাইদহে দীর্ঘদিন দাপটের সঙ্গে ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছেন। ১৯৭৮ সালে ঝিনাইদহ সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। এরপর ১৯৮৩ সালে জেলা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে ভারমুক্ত হয়ে পূর্ণ সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৮৯ সালে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক।
১৯৯৭ সালে ছাত্রলীগের সক্রিয় সাবেক কর্মীদের নিয়ে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন তিনি। ১৯৯৯-২০০০ সালে জেলার সব সহযোগী সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে শ্রমিক লীগ গঠনে উদ্যোগী হন। এরপর ২০১৫ সালের ২৫ মার্চ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
২০১১ সালের ১৩ মার্চ ঝিনাইদহ পৌরসভার নির্বাচনে সাইদুল করিম নির্বাচিত হন মেয়র। আইনগত জটিলতায় নির্বাচন না হওয়ায় এরপর ২০২২ সাল পর্যন্ত টানা ১১ বছর তিনি এই পদে ছিলেন।
স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাব
Advertisement
ঝিনাইদহের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক নেতার ভাষ্য, কেন্দ্রীয় বেশ কয়েক নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় দীর্ঘদিন স্থানীয় আওয়ামী লীগে একক আধিপত্য মিন্টুর। যাকে খুশি সংগঠনে পদ দেন, আবার খেয়ালখুশিমতো বাদও দেন। সংসদ সদস্য আজীম হত্যায় অভিযুক্ত কাজী কামাল গিয়াস আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুকে এভাবেই জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদে বসান। এখন রিমান্ডে থাকা গ্যাস বাবু তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত। ঝিনাইদহে ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগকেও কার্যত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন তিনি।
আরও পড়ুন
সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন চাওয়াটাই কাল হয়েছে, দাবি মিন্টুর আনারকে হত্যার পর চেয়ারে বেঁধে রাখার ছবি প্রকাশ্যে সীমান্তে সোনা চোরাচালানে দিতে হতো ‘আনার ট্যাক্স’২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি সফিকুল ইসলাম অপু ঝিনাইদহ-২ আসন থেকে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পান। নিজের পছন্দের প্রার্থী না হওয়ায় জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেন মিন্টু। ২০১৪ সালেও ঝিনাইদহ-২ আসন থেকে মনোনয়ন পান অপু।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাইদুল করিম মিন্টুর কাজই বিরোধিতা করা। জেলা আওয়ামী লীগ যাকে সমর্থন করে তিনি তার বিপক্ষে যায়। সংসদ নির্বাচনে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার এবং ঝিনাইদহ–১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল হাইয়ের বিপক্ষে কাজ করেছেন মিন্টু। এটা নিজের স্বার্থসিদ্ধি ও প্রতিহিংসাপরায়ণতার কারণেই করেন। তিনি সব সময় দলের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টিতে ব্যস্ত থাকেন, সভা-সমাবেশে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অশালীন বক্তব্য দেন। এতে অনেকেই তার ওপর ক্ষুব্ধ।’
এমপি আনারের স্বজনদের দাবি, এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষ জড়িত। ২০১৭ সালেও বিরোধী পক্ষ এমপি আনারকে হত্যাচেষ্টা করে। সে ঘটনায় থানায় মামলা হয়, আসামিরাও সব স্বীকার করে। তবে মামলাটি পরে মীমাংসা করা হয়।
রিমান্ডে মিন্টুর কাছে যেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে ডিবি
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আনার হত্যায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর জড়িত থাকার বিষয়টি প্রথমে সামনে আসে কিলার আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়াকে জিজ্ঞাসাবাদে। শিমুল ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিতে তার নাম বলেন। এছাড়া ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুর নামও ফাঁস করেন শিমুল। এরপর গোয়েন্দারা খুঁজতে থাকেন কেন, কীভাবে, কী কারণে এ হত্যাকাণ্ডে মিন্টুর নাম সামনে আসছে। এর উত্তর মেলাতে গিয়ে গোয়েন্দাদের তদন্তে সন্দেহভাজন কিছু বিষয় ঘুরপাক খায়।
আনার হত্যার বিষয়টি জানাজানি হওয়ার আগে কেন গ্যাস বাবুর মোবাইল থেকে ছবি দেখে তা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন মিন্টু? নিজ জেলার একজন সংসদ সদস্যকে ভিন দেশে হত্যা করার মতো লোমহর্ষক ঘটনার ক্লু পেয়েও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাননি তিনি। ওই সময় আনারের পরিবারের সদস্যরা নানা জায়গায় আনারকে খোঁজাখুঁজি করেছিলেন। যখন অনেকেই জানতেন আনার হয়তো নিখোঁজ, তখন মিন্টু নিশ্চিত হয়ে যান আনারকে হত্যা করা হয়েছে। কলকাতা থেকে মরদেহ উদ্ধারের আগেই কেন হঠাৎ বাবুর তিনটি মোবাইল গায়েব? এ ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন বাবু। পরে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে বাবু দাবি করেন, তার ব্যবহৃত তিনটি মোবাইল নিয়ে গেছেন মিন্টু। এসব নষ্ট করে ফেলা হতে পারে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওই মোবাইলে খুনের অনেক আলামত ছিল। সবকিছু সামনে আসার শঙ্কায় তিনটি মোবাইল সরিয়ে ফেলা হয়। এ ব্যাপারে মিন্টুকে এখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এছাড়া কেন খুনের এক সপ্তাহ আগে ৬ মে সঞ্জীবা গার্ডেনস থেকে মিন্টুকে ফোন করেন শাহীন ও শিমুল- এ বিষয়েও জানতে চাওয়া হচ্ছে মিন্টুর কাছে।
গোয়েন্দাদের ভাষ্য, অগ্রিম ২০ লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। আর হত্যা মিশন সফল করতে টাকার অঙ্ক ছিল ২ কোটির বেশি। এমনকি হত্যা মিশন সফল করে ১৫ মে ঢাকায় আসেন শিমুল ভূঁইয়া। এরপর টাকা পরিশোধের জন্য গ্যাস বাবুকে ফোন করেন। দিন-তারিখ ঠিক হওয়ার পরও শেষ পর্যন্ত টাকা পরিশোধ করেননি বাবু।
৬ দিন আগে হত্যার ছবি পান মিন্টু
আনার হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায় ২২ মে। তবে এমপি আনার হত্যার ছবি মিন্টু ১৬ মে দেখেছেন। তাহলে মিন্টু এত আগে জেনেও কেন গোপন করলেন। সাইদুল করিম মিন্টু কয়েকবার চেষ্টা করেছিলেন কালীগঞ্জ থেকে এমপি হওয়ার, নমিনেশন পেপারও তিনি কিনেছিলেন। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় টাকা-পয়সার ইস্যুও আসামিদের জবনাবন্দিতে এসেছে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারের ভাই এনামুল হক ইমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘গ্রেফতার বাবুর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিন্টু। এছাড়া হত্যার মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামন শাহীনেরও ঘনিষ্ঠ তিনি। আমরা প্রথম থেকেই বলে এসেছি, আনারকে হত্যার পেছনে মিন্টুর হাত থাকতে পারে। গত সংসদ নির্বাচনে আনারের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হন আব্দুর রশীদ খোকন। খোকনের পক্ষে কাজ করেন সাবেক মেয়র সাইদুল করিম মিন্টুসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মী।’
টিটি/এএসএ/জিকেএস