প্রতি বছর ঈদুল আজহা কেন্দ্র করে গরু লালন-পালন করেন খামারিরা। এবারও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে এবার অন্যবারের চেয়ে গরুর দাম একটু বেশি। খামার মালিকরা বলছেন, গোখাদ্যের দামসহ আনুষঙ্গিক খরচ বেড়ে যাওয়ায় দাম বেড়েছে। ফলে খামারে ১-৩ লাখ টাকা দামের গরুর ক্রেতাই বেশি। এসব গরু মাঝারি সাইজের হয়।
Advertisement
নারায়ণগঞ্জের কয়েকটি ফার্ম সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমনটি জানা গেছে। তারা বলেন, গত এক বছরে গোখাদ্যের দাম বেড়েছে। ফলে গরুর দামও বাড়তি। খরচের আনুপাতিক হারে বাড়তি দাম চাইলে গরু বিক্রি করতে পারছেন না। এতে অনেকটাই হতাশ খামার মালিকরা। খামারের কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ বিল, গরুর ওষুধের খরচ মিটিয়ে অতিরিক্ত লাভের আশা ছেড়ে দিয়েছেন তারা। খরচের টাকা উঠলেই কম লাভে গরু বিক্রি করছেন।
নারায়ণগঞ্জের এসএস এগ্রো ফার্মের মালিক শাফকাত আহমেদ বলেন, গত এক বছরে গরুর খাবারের দাম বেড়েছে। আমরা প্রতিটি গরু কমপক্ষে এক বছর লালন-পালন শেষে বিক্রি করি। এই এক বছরে একটি গরু যে পরিমাণ খাবার খায়, এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক অনেক খরচ আছে, সব মিলিয়ে আগের মতো লাভ নেই। শখে গরুর খামার করা।
তিনি বলেন, প্রতিদিন খামারে সাড়ে চার টন ঘাসের প্রয়োজন হয়। গম, ভুসি, ছোলা, ভুট্টাসহ অন্য খাবার তো আছেই। খামারে প্রায় ১৩০০ গরু রাখা যায়, তবে আমরা রাখি ৬০০টি। দুটি চাড়ি (গরুর খাবারের পাত্র) মিলে একটা গরু রাখি। কেননা স্বাস্থ্যগত দিকটাও খেয়াল রাখতে হয়। আবার অনেক সময় গরু অসুস্থ হয়ে মারা যায়। ১০ লাখ টাকার একটা গরু মারা গেলে বিরাট ক্ষতি হয়ে যায়। সব হিসাব করে দেখি লাভের টাকা ঘরে তোলা দায়। বেশির ভাগই খরচ বাদ দিয়ে সমান সমান থাকে।
Advertisement
আরও পড়ুন:
কোন পশুর বয়স কত হলে কোরবানি করা যায় গরু কোরবানিতে সাত নাম থাকা কি জরুরি? যাদের কোরবানি কবুল হবে নাখামারিরা বলছেন, ভুট্টার কেজি আগে ছিল ২৮-৩০ টাকা। এখন ৩৫ টাকা। ৭০-৭৫ টাকার ছোলা ৮৫ টাকা, ২৫ টাকার ধান ৩০-৩২ টাকা, ৩০-৩৫ টাকার গম ৪৫ টাকা বেড়েছে। যাদের খামার রয়েছে তাদের প্রত্যেকেরই নিজেদের ঘাস চাষের জমি রয়েছে। এরপরও কৃষকদের থেকে ঘাস কিনতে হয়। যার প্রতি কেজি ৫ থেকে সাড়ে ৫ টাকা। এভাবে খাবারের দাম বাড়ায় খরচ চালাতে অনেকটা হিমসিম খেতে হচ্ছে।
কয়েকটি খামার ঘুরে দেখা গেছে, ১৫০-৫০০ কেজির গরুর চাহিদা বেশি। এসব গরু ৯০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এরমধ্যে ১৫০০-২৫০০ কেজি ওজনের গরু ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা, ৩৫০-৫০০ কেজির গরু ১ লাখ ৮০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খামারে থাকা এসব গরুর চাহিদাই বেশি। তবে ৫ লাখ টাকার ক্রেতাও আসছে কিছু। এছাড়া ১০-১৫ লাখ টাকার ক্রেতা ১০ শতাংশের মতো। আর ২০ লাখ বা তার বেশি টাকা দিয়ে গরু কেনার ক্রেতার সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকজন।
খামারে রয়েছে সিন্ধি, শাহীওয়াল, ব্রাহমা, হলিস্টিন ফ্রিজিয়ান, মীর কাদিমের হাসা, ক্রস, ভুটানের ভুট্টিসহ নানা প্রজাতির গরু। যেগুলোর দাম চাওয়া হচ্ছে ১৫-৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত।
Advertisement
খামারিরা বলছেন, বড় গরু যেগুলো ২০ লাখ বা ৩০ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে সেগুলোর তুলনায় ছোট গরুর চাহিদা বেশি। মূলত গরুর ওজনের ওপর ভিত্তি করে খাবার দেওয়া হয়। প্রতি ৭০-১০০ কেজি ওজনের জন্য ১ কেজি থেকে ১ কেজি ২০০ গ্রাম পর্যন্ত দানাদার খাবার দেওয়া হয়। বড় গরু খাবার বেশি খায়, আর অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। আবার অসুস্থ হয়ে বড় গরুর কোনো একটা মারা গেলেও ক্ষতি হয় অধিক। এছাড়া ছোট গরু অসুস্থ হয় কম, খাবার লাগে কম আবার চাহিদাও বেশি। তাই খামারে ছোট গরু লালন-পালন হয় বেশি।
এছাড়া অ্যালবিনো মহিষ, জাফরাবাদী মহিষ, মুররাহ মহিষ, নিলিরাভী মহিষসহ বেশ কয়েক প্রজাতির মহিষ বিক্রি হচ্ছে। এসব মহিষ ২-৭ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া দেশি ছাগল বিক্রি হচ্ছে ১৫-৩৫ হাজার টাকার মধ্যে। ভারতের ছাগলের দাম ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখের মধ্যে। ৯০ থেকে ১২০ কেজি ওজনের দুম্বা বিক্রি হচ্ছে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকায়। ৬৫-৮০ কেজি ওজনের গাড়ল বিক্রি হচ্ছে ৬০-৮০ হাজার টাকার মধ্যে।
এসএস ক্যাটল ফার্মের ডেপুটি ম্যানেজার মোহাম্মদ সুমন বলেন, আমাদের খামারে ১৮ লাখ টাকা পর্যন্ত দামের গরু আছে। দেড় লাখ থেকে আড়াই বা তিন লাখের ক্রেতা বেশি। খামারিদের জন্য দেশি গরুতে লাভও বেশি। এখানে মধ্যবিত্ত থেকে সব ধরনের ক্রেতা আসেন। অনেকে তো এক বছর আগেই কিনে রেখে যান। আমরা এক বছরের অতিরিক্ত সব খরচ হিসাবে দাম করি। কিস্তিতে টাকা দেওয়ারও সুযোগ থাকে।
খামারে গরু কিনতে আসা জেসমিন আক্তার বলেন, কোরবানির জন্য গরু কিনতে আসছি। নারীদের হাটে গিয়ে গরু কেনা ঝামেলা। তাই এখানে আসছি। পছন্দ মতো গরু কিনবো। সর্বোচ্চ বাজেট সাড়ে ৩ লাখ টাকা।
আবু তাহের নামের আরেক ক্রেতা বলেন, হাটে ঘুরেছি গরু পছন্দ হয়নি। তাই খামারে এলাম। এখানে স্বাচ্ছন্দ্যে গরু দেখতে পারছি। খামার থেকে পছন্দ করেই একটা কিনবো। বিক্রেতারা দাম বেশি চাইবেই। দরদাম করে কিনতে হবে।
নারায়ণগঞ্জের আর. কে. এগ্রো ফার্ম লিমিটেডের ম্যানেজার আব্দুস সামাদ বলেন, যেসব গরু বিক্রি হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত ক্রেতা বেশি। ৫ লাখ টাকার ক্রেতাও মোটামুটি আছে। খামারে এখন খরচ অনেক বেশি। গোখাদ্যের দাম বেড়েছে কিন্তু গরুর দাম সে অনুপাতে বাড়েনি। আমাদের এই খামারে ৪০ জন কর্মচারী কাজ করেন। এদের বেতন দিতে হয়। সব মিলিয়ে খরচের পরিমাণ অনেক।
এনএস/জেডএইচ/জেআইএম