প্রতিষ্ঠার ৯ বছরেও স্থায়ী ক্যাম্পাস পায়নি হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ। সদর আধুনিক হাসপাতালের নতুন ভবনের কয়েকটি ফ্লোরে কোনো রকমে চলছে পাঠদান। ছোট ছোট কয়েকটি কক্ষে চলছে প্রশাসনিক কার্যক্রম। ক্লাসরুমের সংকটে এক বর্ষের পাঠদান চলাকালে অন্য বর্ষের শিক্ষার্থীদের অপেক্ষায় থাকতে হয়। ছোট ছোট কক্ষে চলে ল্যাব, লাইব্রেরি। অডিটরিয়ামতো স্বপ্নের মতো।
Advertisement
শিক্ষার্থীদের জন্য বিনোদনেরও কোনো ব্যবস্থা নেই। নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থাও নেই শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের। অথচ এরইমধ্যে প্রথম ব্যচের শিক্ষার্থীরা ডাক্তার হয়ে বেরিয়ে গেছেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কেউই পাচ্ছেন না প্র্যাকটিক্যালসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা। নিজস্ব ক্যাম্পাস না করতে পারায় ক্ষোভ ও আক্ষেপের শেষ নেই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের।
পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী ফারজানা আক্তার মুনমুন বলেন, এরইমধ্যে প্রথম ব্যাচ তাদের শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করেছে। অথচ এতদিন যাওয়ার পরও একটি স্থায়ী ক্যাম্পাস না থাকার কারণে আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্লাসরুম নেই। হলরুম নেই। বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। ক্যান্টিন নেই। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আমাদের ক্লিনিক্যাল শিক্ষকের সংখ্যা খুবই নগন্য। ফলে শিক্ষকদের শত চেষ্টার পরও কিছুটা সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। কিছু ডিপার্টমেন্ট রয়েছে যেগুলোতে কোনো শিক্ষকই নেই।
একই বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী মো. হাসান বলেন, মেডিকেল শিক্ষার্থীদের সবসময়ই প্রচুর চাপে থাকতে হয়। তাই আমাদের বিনোদনের ব্যবস্থা থাকলেও ভালো হতো। আমাদের খেলাধুলারও কোনো সুযোগ নেই।
Advertisement
শিক্ষার্থী তাসিয়া আক্তার হলি বলেন, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ মেডিকেল কলেজ একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। কিন্তু ২-৩টা ব্যাচ আসার সঙ্গে সঙ্গে সুনামগঞ্জ মেডিকেল কলেজ স্থায়ী ক্যাম্পাস পাচ্ছে। অথচ আমরা ৬টি ব্যাচ চলমান থাকা সত্ত্বেও আমাদের নিজস্ব ক্যাম্পাসের কোনো উদ্যোগ নেই। স্থায়ী ক্যাম্পাস না থাকার কারণে আমাদের মেয়েদের নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা হচ্ছে না। বর্তমানে আমাদের শহর থেকে অনেকটা দূরে আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে আমাদের যাতায়াতে প্রচুর সমস্যা হয়। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর যাতায়াত অনেকটা অনিরাপদ। ক্যান্টিন, ক্লাসরুম সমস্যা। ওয়ার্ডে রেজিস্ট্রার নেই, সিএ নেই। এমন পরিস্থিতিতে আমরা কীভাবে একটি বিষয় পরীক্ষা করবো তা বুঝতে পারি না। সিমিলেশন ল্যাব না থাকায় আমরা প্র্যাকটিক্যালও করতে পারছি না।
মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কান্তি প্রিয় দাশ বলেন, আমাদের শিক্ষকদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আবাসন ব্যবস্থা। অনেক সময় দেখা যায় সার্জারি, মেডিসিন বিভাগ, বিশেষ করে ক্লিনিক্যাল বিভাগে সবসময় রোগী ভর্তি থাকেন। তাদের সার্বক্ষণিক বিশেষ মনিটরিংয়ের প্রয়োজন পড়ে। তাদের সেবাটা নিশ্চিত করার জন্য আসলে প্রথমেই ডাক্তারদের প্রয়োজন নিরাপদ আবাসন ব্যবস্থা। ল্যাব সমস্যাও আছে। কিন্তু আমরা স্বল্প পরিসরেই চেষ্টা করে যাচ্ছি।
শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সুনির্মল রায় বলেন, আমাদের নিজস্ব ক্যাম্পাস না থাকায় ২৫০ শয্যা আধুনিক হাসপাতালের নতুন ভবনের দুটি ফ্লোর নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছি। আমাদের শিক্ষকের পদ আছে ৭৬টি। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষক আছেন ৪২ জন। আমাদের এখানে জায়গার স্বল্পতা রয়েছে। ক্যান্টিন নেই। অডিটরিয়াম নেই। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সভা এসব করা আমাদের জন্য অনেক কঠিন। আমাদের জন্য যে জায়গা অধিগ্রহণ হয়েছে সেখানে যদি দ্রুত বেগে কাজ শুরু হয় তাহলে অনেক সমস্যারই সমাধান হবে।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমার কাছে এখনো সঠিক কোনো তথ্য নেই। আমরা প্রতিনিয়তই অধিদপ্তর এবং মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। চিঠিপত্র দিচ্ছি। এটি দ্রুত হলে হবিগঞ্জে চিকিৎসার মান আরও অনেক বেড়ে যাবে। এখানে আমাদের শিক্ষকদের বাসস্থানতো নেইই, বসার স্থান পর্যন্ত দিতে পারছি না। বছরে ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়েই আমাদের পাঠদান কঠিন, অথচ এবার ১০০ জন করে ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
Advertisement
সদর আধুনিক হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ আমিনুল হক সরকার বলেন, আমাদের হাসপাতালটি ২৫০ শয্যা হলেও এখানে রোগী ভর্তি থাকে ৪০০ থেকে ৫০০ জন। ফলে আমাদের স্থান সংকুলান করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ছে। এছাড়া আমাদের হাসপাতালের দুটি ফ্লোরে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম চলমান আছে। ফলে এগুলো হাসপাতালের জন্য ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বশেষ হবিগঞ্জ সফর করেন। তখন সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মো. আবু জাহির একটি মেডিকেল কলেজ ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী তা প্রতিষ্ঠা করার প্রতিশ্রুতিও দেন। ফলে ২০১৫ সালেই মেডিকেল কলেজ অনুমোদন লাভ করে। একই বছর শিক্ষার্থী ভর্তির প্রশাসনিক অনুমোদন পায়। কিন্তু একাডেমিক ভবন নির্ধারণ না হওয়ায় সে বছর শিক্ষার্থী ভর্তি করা সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত অস্থায়ী ক্যাম্পাস হিসেবে ২৫০ শয্যা আধুনিক হাসপাতালের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা নির্ধারণ হলে ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষে ৫১ জন শিক্ষার্থী ভর্তির মাধ্যমে মেডিকেল কলেজটির যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে মেডিকেল কলেজটিতে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছেন। এরইমধ্যে গত ৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম ব্যাচের ৩৩ জন শিক্ষার্থী শিক্ষানবিশ চিকিৎসক হিসেবে শপথ নিয়েছেন। এর মাধ্যমে প্রথম ব্যাচ ডাক্তার হয়েছেন। মেডিকেল কলেজের পরিধি দিন দিন বাড়ছে। শিক্ষার্থীও বাড়ছে। কিন্তু শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজটির স্থায়ী ক্যাম্পাস এখনো আলোর মুখ দেখছে না।
এফএ/এএসএম