কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে এক সপ্তাহ ধরে কোনো নৌযানই স্বাভাবিকভাবে সেন্টমার্টিন যাতায়াত করতে পারছে না। ৫ জুন সেন্টমার্টিনে ভোটগ্রহণ শেষে টেকনাফ ফেরার পথে নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের বহন করা ট্রলার লক্ষ্য করে মিয়ানমারের উপকূল থেকে গুলি চালানো হয়। এরপর থেকে নাফনদ হয়ে সেন্টমার্টিন আসা-যাওয়া করা স্পিডবোটে গুলির ঘটনা ঘটছে। তবে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘাত চলমান থাকায় কারা গুলি করছে তা জানা যাচ্ছে না। সবশেষ মঙ্গলবার (১১ জুন) স্পিডবোট লক্ষ্য করে গুলি করা হয়।
Advertisement
এরপর থেকে ভয়ে কোনো ধরনের নৌযান টেকনাফ-সেন্টমার্টিন যাতায়াত করছে না। ফলে এক ধরনের ‘বন্দিজীবন’ কাটাচ্ছেন দেশের একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিনের অধিবাসীরা। নাফনদীতে বাংলাদেশি নৌযান দেখলেই মিয়ানমার উপকূল থেকে বৃষ্টির মতো গুলি ছোড়ায় এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
এ অবস্থায় দেশের স্থলভাগের সঙ্গে সেন্টমার্টিনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নের পাশাপাশি দ্বীপে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ভোগ্যপণ্য সংকট তীব্র হচ্ছে বলে দাবি করেন সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান।
আরও পড়ুন
Advertisement
চেয়ারম্যান জানান, গত ৬ জুন থেকে টেকনাফ-সেন্টমার্টিনের নৌযান চলাচল বন্ধ। ফলে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় চাল, ডাল ও তেলের চরম সংকট চলছে। এগুলো এক-দুদিন পর পর স্থল টেকনাফ হয়ে সেন্টমার্টিন আনা হয়। কিন্তু সাতদিন ধরে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে কোনো ধরনের খাদ্য সরবরাহ করা যাচ্ছে না।
ইউপি চেয়ারম্যান আরও জানান, এখনো চালের সংকট পড়েনি। এ অবস্থা চলতে থাকলে তরকারিহীন শুকনা ভাত খাওয়া ছাড়া বিকল্প থাকবে না। এ নিয়ে দ্বীপবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
বুধবার পর্যন্ত টানা সাতদিন ধরে এই পরিস্থিতি চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে কেউ কেউ সাহস করে টেকনাফ ঘাট থেকে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে নৌযান ছেড়ে দিচ্ছেন। তবে নাফনদীর মাঝামাঝি অংশে (বাংলাদেশ সীমান্ত) নৌযান লক্ষ্য করে ওপার থেকে মুহুর্মুহু গুলি এসে পড়ছে। এ অবস্থায় নৌযান আবার ঘুরিয়ে নিয়ে আবার ভিড়ছে টেকনাফ ঘাটে। চলমান পরিস্থিতিতে আমরা চরম উৎকণ্ঠায় রয়েছি।’
ভুক্তভোগীদের বরাত দিয়ে সেন্টমার্টিনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘মঙ্গলবার টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়ার পথে নাফনদী পেরিয়ে সাগরের ঘোলচর এলাকায় স্পিডবোটকে নৌযান নিয়ে ধাওয়া দিয়ে গুলি করেছে মিয়ানমারের সৈন্যরা। তবে এ ঘটনায় কেউ হতাহত হননি। এর মধ্যে তিন দফা গুলির ঘটনা ঘটেছে। টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়ার পথে নাফনদীর মোহনার শেষে নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকা অতিক্রম করার সময় মিয়ানমারের প্রান্ত থেকে বাংলাদেশের বোটগুলো লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হচ্ছে। গত ৫ জুন টেকনাফ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষে ফেরার পথে নির্বাচন কর্মকর্তা ও ৮ জুন সেন্টমার্টিনে ইট-বালু ও খাদ্যসামগ্রী বহনকারী ট্রলার লক্ষ্য করে মিয়ানমার সীমান্ত থেকে গুলি বর্ষণ করা হয়েছিল।’
Advertisement
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের স্পিডবোট লক্ষ্য করে মিয়ানমার সীমান্ত থেকে ফের গুলি-এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার উইংয়ের মহাপরিচালক মিয়া মো. মাইনুল কবির একটি বিদেশি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘প্রথম যেদিন এই ঘটনা ঘটে, সেদিনই আমরা প্রতিবাদ জানিয়েছি। আজকের (মঙ্গলবারের) ঘটনার পর কূটনৈতিক চ্যানেলে আবারও প্রতিবাদ জানাব। তবে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যে এখন স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে না, সেটা তো আমরা বুঝতেই পারছি। ওই এলাকা এখন কাদের নিয়ন্ত্রণে সেটিও পরিষ্কার নয়। তবে আমাদের কূটনৈতিক তত্পরতা অব্যাহত আছে।’
মঙ্গলবার গুলির মুখে পড়া স্পিডবোটটির মালিক সৈয়দ আলম বলেন, ‘আগের গুলির ঘটনার পর গত পাঁচদিন আমরা নদীতে যাইনি। প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনার পর মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে স্পিডবোটে রোগী তুলে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিই। আগে আমরা নিশ্চিত ছিলাম না, কারা গুলি ছুড়ছে। কিন্তু যখন ছোট ছোট নৌযান নিয়ে আমাদের স্পিডবোটে গুলি করা হয়, তখন সেখানে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর জাহাজ ছিল। ফলে আমরা ধারণা করছি জান্তার সৈন্যরাই এটা করছে।’
আরও পড়ুন
মিয়ানমার থেকে আমাদের নৌযানে কে গুলি করেছে নিশ্চিত নইটেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরীর বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌপথে স্পিডবোট-ট্রলারে গুলির ঘটনায় নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। আপৎকালীন রুট হিসেবে শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিমে জেটি ঘাট চালু করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আমি নিজে নৌযানের মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। দুদিন আগে কক্সবাজারের ডিসি অফিসেও বৈঠক হয়েছে। আমরা নৌযান মালিকদের ডেকে বলেছি, বিকল্প রুট দিয়ে আপাতত খাদ্য পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে।’
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, ‘সংকট হওয়ার আগে সংকট চলছে বলে প্রচার করে বাড়তি দাম আদায় করতে কোনো অসাধু ব্যবসায়ী প্রপাগান্ডা চালিয়ে থাকতে পারেন। দ্বীপে সংকট এড়াতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।’
একটি সূত্র বলছে, উপকূলীয় জলসীমায় নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে কোস্টগার্ড। বিষয়টি কোস্টগার্ড সদর দপ্তর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। সার্বিক বিষয়টি মনিটরিং করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সায়ীদ আলমগীর/এসআর/জিকেএস