অর্থনীতি

এলাচের স্লিপ বেচে ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে ব্যবসায়ীর চম্পট

পুরো বছরে সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে ছয় হাজার টন এলাচের চাহিদা থাকে দেশে। অথচ চট্টগ্রামের বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে একদিনেই বিক্রি হয় হাজার টনের বেশি। তবে বাস্তবে কোনো এলাচ বিক্রি হয় না। ডিও ব্যবসার নামে স্লিপ হাত বদল করে দাম বাড়িয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয় টাকা। এতে দেড় হাজার টাকা কেজির এলাচ গত মাস থেকে বিক্রি হচ্ছে চার হাজার টাকার বেশিতে।

Advertisement

খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা এলাচের এ ব্যবসাকে ‘জুয়া’ আখ্যা দিয়েছেন। এবার সেই এলাচ বিক্রির নামে সাদা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে ৫০ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা নাজিম উদ্দিন নামে এক ব্যবসায়ী। এতে ধরাশায়ী অন্তত ৪০ ব্যবসায়ী। তবে কোটি কোটি টাকা হারিয়েও কেউ আইনের আশ্রয় নিচ্ছেন না। কেউ থানায় অভিযোগও করেননি।

যা বলছেন ব্যবসায়ীরাখাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিগত কয়েক মাস ধরে খাতুনগঞ্জে এলাচের বাজার অস্থির। ডিও ব্যবসার নামে কাগজ বিক্রির মাধ্যমে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা হাত বদল হয়ে আসছিল গত কয়েক মাসে। এবার সেই এলাচের ডিও ব্যবসায় প্রতারণার ফাঁদে আটকালেন ব্যবসায়ীরা। খাতুনগঞ্জের সোনামিয়া মার্কেটের ব্যবসায়ী নূর ট্রেডিংয়ের মালিক নাজিম উদ্দিন ব্যবসায়ীদের অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। মূলত ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) বাণিজ্যের সুযোগে এ প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাতুনগঞ্জের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী জাগো নিউজকে বলেন, আগে তেল, গম, চিনিতে ডিও ব্যবসা হতো। এখন তেল, চিনিতে সরকার দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পর থেকে ডিও ব্যবসায়ীরা এলাচে বিনিয়োগ করছেন। এ সুযোগে অসাধু কিছু ব্যবসায়ী ডিও’র নামে শুধু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে প্রতিদিন শত শত টন এলাচ কেনাবেচা করছেন।

Advertisement

ডিও যারা কেনাবেচা করছেন তাদের অনেকেই এসব এলাচের সত্যিকার মজুতের বিষয়েও জানেন না। পণ্যের চেয়ে টাকার বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ায় এলাচের ডিও ব্যবসা ‘জুয়া খেলায়’ রূপ নিয়েছে বলে মন্তব্য করেন ব্যবসায়ীরা। এসব ডিও ব্যবসার বৃহৎ অংশই নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে সোনামিয়া মার্কেট থেকে।

খাতুনগঞ্জের মসলা ব্যবসায়ীরা জানান, ডিও ব্যবসায় যুক্ত হওয়ায় বর্তমানে বাজারে সবচেয়ে বেশি অস্থির এলাচের দাম। ডিও ব্যবসায় বর্তমানে ভালোমানের এলাচের চেয়ে মধ্যমমানের এলাচের দাম বেশি। আবার যারা বাজার থেকে এলাচ কিনছেন, একই এলাচ ট্রেডিংয়ের চেয়ে প্রতি কেজিতে ৮শ থেকে হাজার টাকা কম।

এলাচের ধরন ও আমদানিমূল্যজানা যায়, গরম মসলার মধ্যে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এলাচ। বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন ক্যাটাগরি ও মানের এলাচ আমদানি হয় দেশে। ‘আরএস-জাম্বো’, ‘জেবিসি’, ‘এলএমজি’, ‘এসএমজি’ ও ‘এসবি’ নামের এলাচ রয়েছে। ‘আরএস-জাম্বো’ হচ্ছে অপেক্ষাকৃত বড় ও উৎকৃষ্ট মানের (গ্রেড-১) এলাচ, ‘জেবিসি’, ‘এলএমজি’ হলো মধ্যমমানের (গ্রেড-২), ‘এলএমজি ওল্ড’ এবং ‘ওয়াইএম-২’ নিম্নমধ্য মানের (গ্রেড-৩) এবং ‘এসএমজি’ ও ‘এসবি’ হচ্ছে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের (গ্রেড-৪) এলাচ। ২০১৭ সালেও এসব এলাচের কেজি এক হাজার থেকে ১ হাজার ৫শ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ৫০টি প্রতিষ্ঠান তিন হাজার ৬৭১ টন ২৫৬ কেজি এলাচ আমদানি করে। ওই বছর ঘোষিত মূল্য ও রাজস্বসহ প্রতি কেজি এলাচের শুল্ক-উত্তর মূল্য ছিল ৮৫৪ টাকা ৪১ পয়সা। ২০২০ সালে ৬০টি প্রতিষ্ঠান তিন হাজার ১০১ টন ৬৮৩ কেজি এলাচ আমদানি করে। ওই বছর ঘোষিত মূল্য ও রাজস্বসহ প্রতি কেজি এলাচের শুল্ক-উত্তর মূল্য ছিল ৮৭৪ টাকা ৪৬ পয়সা।

Advertisement

আরও পড়ুন

এলাচের দামে পাইকারি-খুচরায় বিস্তর ফারাক এলাচ-হলুদের বাজার চড়া, জিরা-লবঙ্গে স্বস্তি খাতুনগঞ্জে ‘স্লিপ’ বেচাকেনার কুচক্রে এলাচ

২০২৩ সালে ৮৫টি প্রতিষ্ঠান চার হাজার ৬৭৭ টন ২৯০ কেজি এলাচ আমদানি করে। ওই বছর ঘোষিত মূল্য ও রাজস্বসহ প্রতি কেজি এলাচের শুল্ক-উত্তর মূল্য পড়ে এক হাজার ২৫৭ টাকা ১২ পয়সা এবং ২০২৪ সালের প্রথম দুই মাসে (২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) ১৩টি প্রতিষ্ঠান ২৩৭ টন ৮০ কেজি এলাচ আমদানি করে। ঘোষিত মূল্য ও রাজস্বসহ প্রতি কেজি এলাচের শুল্ক-উত্তর মূল্য পড়ে এক হাজার ২৬৭ টাকা ৩৭ পয়সা। জাহাজ ভাড়া, খালাস খরচ, পরিবহন ব্যয়, ব্যাংক সুদসহ এসব এলাচের দাম কেজিপ্রতি দেড় হাজার টাকা পড়ার কথা।

খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী সেকান্দার হোসেন বলেন, ‘এখন এলাচের ডিও ব্যবসা এক ধরনের জুয়া খেলা। যেখানে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার এলাচের ডিও বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু এসব ডিও’র ক্রেতা-বিক্রেতা কেউ জানেন না এলাচ কোথায়। এই ডিও বেচাকেনায় বিনিয়োগ বেড়ে গিয়ে পণ্যের দাম সর্বোচ্চ হয়ে যায়। আবার হঠাৎ বড় দরপতন হয়। তখন ডিও বা স্লিপগুলো যাদের হাতে থাকে, তারা বড় লোকসান গোনেন। এভাবে একবার যারা লোকসানে পড়েন, তারা মার্কেট থেকে উধাও হয়ে যান।’

মূলহোতা নাজিম উদ্দিন

খাতুনগঞ্জের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সোনামিয়া মার্কেটে দীর্ঘদিন ধরে চিনি ও ভোজ্যতেলের ব্যবসা করেন নূর ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী নাজিম উদ্দিন। কয়েক মাস ধরে তিনি এলাচের ডিও ব্যবসা করছেন। ধারাবাহিক ব্যবসার পর গত বুধবার (৫ জুন) বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছে এলাচের ডিও বিক্রি করে তাদের কাছ থেকে নেওয়া চেক নগদায়ন করে নেন। ওই একদিনেই প্রায় পাঁচ কোটি টাকার এলাচের ডিও বিক্রি করেন নাজিম। পরে তিনি তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ করে দেন।

এ ঘটনার পর ভুক্তভোগী কয়েকজন নাজিম উদ্দিনকে ধরে খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের অফিসে নিয়ে যান। ওই সময় ৪০-৫০ জন পাওনাদার নাজিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন অ্যাসোসিয়েশনের কাছে। ওইদিন রাতে নাজিমকে সমিতির অফিসে আটকে রাখা হয়। পরদিন তার ভগ্নিপতি সমিতির অফিসে গিয়ে ১০ কোটি টাকার চেক দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান।

এ ব্যাপারে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী ও চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক আলমগীর পারভেজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘খাতুনগঞ্জের বাজারে ডিও ব্যবসা অনেক পুরোনো। এখানে পণ্যের বিপরীতে টাকা নিশ্চায়নের জন্য ডিও দেওয়া হয়। এসব ডিও গুদামে জমা দিয়ে ক্রেতারা পণ্য ছাড়িয়ে নেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সোনামিয়া মার্কেটে এলাচের ডিও ব্যবসার নামে জুয়া চলে আসছিল। এখানে ডিও সত্যিকারের পণ্য বা এলাচ গুদামে থাকে না। শূন্যের ওপর কোটি কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘গত বুধবার নাজিম উদ্দিন নামে এক ব্যবসায়ীকে ধরে সমিতির কার্যালয়ে নিয়ে আসেন ৪০-৫০ জন ব্যবসায়ী। তাদের প্রায় ৫০ কোটি টাকার মতো পাওনা রয়েছে বলে তারা অভিযোগ করেন। এজন্য সত্যিকারের পাওনা নির্ধারণের জন্য আমরা তিনজনের একটি কমিটি গঠন করেছি। পরে পাওনদারদের পাওনা পরিশোধের আশ্বাসে অভিযুক্ত নাজিম উদ্দিনকে তার ভগ্নিপতির জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ছাড়া পাওয়ার পর নাজিম লাপাত্তা।’

স্লিপ কিনে ধরা খেলেন ব্যবসায়ীরাব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত মঙ্গলবার নূর এন্টারপ্রাইজ থেকে ১১ টন এলাচের ডিও কেনেন তানিশা এন্টারপ্রাইজের আবদুল মান্নান। বাজারে ১১ টন এলাচের মূল্য প্রায় চার কোটি টাকার ওপরে। এসব ডিও’র বিপরীতে দেওয়া চেক নাজিম নগদায়ন করে নেন। পরে মান্নানের বিক্রি করা এসব ডিও’র বিপরীতে এলাচ কিংবা চেক কোনোটাই না পেয়ে নাজিমের দ্বারস্থ হলে ওইদিন তার ফোন বন্ধ পেয়ে প্রতারণার বিষয়টি ফাঁস হয়।

পাশাপাশি নূর ট্রেডিংয়ের কাছ থেকে এর আগে খাতুনগঞ্জের এসকে ট্রেডার্সের কফিল উদ্দিন ২০ টন এলাচের ডিও কেনেন। এতে কফিলের পাওনা সাড়ে আট কোটি টাকা। একই সঙ্গে দ্বীন কোম্পানির কামাল উদ্দিনের ৮৪ লাখ টাকা, এএম ট্রেডার্সের মো. লিটনের এক কোটি টাকা, মেহের স্টোরের মো. আলীর ৮০ লাখ টাকাসহ ৪০-৫০ জন ব্যবসায়ীর অর্ধশত কোটি টাকা পাওনা আটকে গেছে নাজিমের কাছে।

এ বিষয়ে জানতে তানিশা এন্টারপ্রাইজের মালিক আবদুল মান্নানকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। দ্বীন কোম্পানির কামাল উদ্দিনের ছেলে আসিফই মূলত এলাচের ব্যবসা করেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘যাদের টাকা আটকে গেছে সবাই টেনশনে রয়েছে। আমরাও টেনশনে আছি। যে যার মতো করে পাওনা আদায়ের চেষ্টা করছেন। অনেকে থানায় অভিযোগ দিয়েছেন।’

তবে থানায় অভিযোগ করা নিয়ে আসিফের কথার সত্যতা মেলেনি। নগরীর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম ওবায়েদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘খাতুনগঞ্জে প্রতারণার ঘটনার বিষয়ে অনেকে থানায় ফোন করে জানতে চেয়েছেন। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো ভুক্তভোগী থানায় অভিযোগ নিয়ে আসেননি।’

এমডিআইএইচ/এএসএ/এমএস