ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার ভারতে গিয়ে নিখোঁজের পর মিডিয়ার সামনে আসেন ছোট মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। ছোট থেকে রাজনীতির মাঠে বাবার সঙ্গে থাকতেন তিনি। একজন মেয়ে হিসেবে কালীগঞ্জে রাজনীতি করা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও তিনি ধরে রাখতে চান রাজনীতির হাল।
Advertisement
আইনের ছাত্রী ডরিন বাবাকে যে হত্যা করা হয়েছে তার প্রমাণ চান, বিচার চান। সম্প্রতি ডরিন বাবার হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক তৌহিদুজ্জামান তন্ময়।
জাগো নিউজ: আপনার বাবার মৃত্যু সংবাদ প্রথমে কীভাবে জানতে পারেন?
মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন: কলকাতা থেকে একজন সাংবাদিক প্রথমে আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে জানান বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। এরপর ডিবি অফিস থেকে আমাকে ডাকা হয়। তারা বললো- এমন একটি খবর তারা পেয়েছে এবং গ্রেফতার আসামিরা হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে স্বীকারোক্তিও দিয়েছেন।
Advertisement
জাগো নিউজ: মৃত্যুর খবর জানার আগে এমন কিছু আঁচ করতে পেরেছিলেন?
মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন: না। প্রথমে বুঝতে পারিনি। তবে বাবার মোবাইল থেকে হোয়াটসঅ্যাপে আসা টেক্সট দেখে সন্দেহ হয়। কারণ এই কনভারসেশন আমার বাবার হতে পারে না। কারণ প্রতিদিন বাবার সঙ্গে আমার কথা হতো। বাবা কী ধরনের মেসেজ করতে পারেন তা আমি জানি। এরপর প্রধানমন্ত্রীকে তার মোবাইলে আমি টেক্সট করেছিলাম। পরে প্রধানমন্ত্রী আমাকে ফোন করেন। তাকে ঘটনা খুলে বলি। প্রধানমন্ত্রী আমাকে আশ্বাস দেন ঘটনা দ্রুত আইডেন্টিফাই করার।
আমার অভিভাবক ছিলেন বাবা, এখন আমার অভিভাবক প্রধানমন্ত্রী। তিনি আমাকে সহযোগিতা করবেন। তিনিই (প্রধানমন্ত্রী) খোঁজ-খবর নিচ্ছেন।
জাগো নিউজ: আপনার বাবার মৃত্যুর পর এলাকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন?
Advertisement
মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন: মনে হচ্ছে মানুষ কিছুটা আতঙ্কের মধ্যে আছে। দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি বাবা যখন ছিলেন কালীগঞ্জে মানুষের মধ্যে কোনো আতঙ্ক ছিল না। পাখি যেমন ছেড়ে দিলে আপন মনে ঘুরে বেড়ায়, মানুষও তেমন আপন মনে ঘুরেছে। কিছুদিন হলো সন্ধ্যার পর পর দোকানপাট বন্ধ করে ব্যবসায়ীরা বাসায় চলে যাচ্ছেন। বাবা থাকাকালীন কোথাও চাঁদাবাজি, চুরি, ছিনতাই কিংবা ডাকাতি ছিল না।
জাগো নিউজ: এলাকায় কোনো রাজনৈতিক কিংবা অন্য কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন কি না?
মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন: বাবার মৃত্যুর পর আমাদের বিভিন্ন ইউনিয়নের নেতাকর্মীদের হুমকি-ধামকি দেওয়া হচ্ছে। তারা নাকি আমাদের লোকদের দেখে নিতে চেয়েছেন। বাবা আজ নেই বলেই আমাদের লোকজনের ওপর হুমকি দেওয়া হচ্ছে। রাজনীতিতে গ্রুপিং থাকবেই। গ্রুপিং রাজনীতির সৌন্দর্য। বাবার ইমেজ নষ্ট করার জন্য একটি গ্রুপ লেগেই আছে। প্রতিপক্ষরা অনেক রকম স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। অনেকেই মনে করছে উপ-নির্বাচনের মনোনয়ন কিনবেন।
জাগো নিউজ: এই বিপদের সময় সবচেয়ে বেশি কার সমর্থন পাচ্ছেন?
মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন: ওপরে আল্লাহ আছেন। প্রধানমন্ত্রী আমাকে সহযোগিতা করছেন। প্রধানমন্ত্রী আমার বাবাকে ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন এটিই তার বহিঃপ্রকাশ। ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে ৩০০ জন সংসদ সদস্য। তার মধ্যে আমার বাবা ছিলেন তিনবারের এমপি। আমার অভিভাবক ছিলেন বাবা, এখন আমার অভিভাবক প্রধানমন্ত্রী। তিনি আমাকে সহযোগিতা করবেন। তিনিই (প্রধানমন্ত্রী) খোঁজ-খবর নিচ্ছেন।
আমার প্যাশন রাজনীতি করা এবং আমি ভবিষ্যতে রাজনীতি করবো। আল্লাহ যদি কপালে রাখেন, বাবার অসম্পূর্ণ কাজগুলো বাস্তবায়ন করবো। বাবার আশা পূরণ করবো।
জাগো নিউজ: ভবিষ্যতে আপনার রাজনীতির কোনো পরিকল্পনা আছে?
আরও পড়ুন
শাহীন যুক্তরাষ্ট্রে, বাংলোবাড়ির পাহারায় জার্মান শেফার্ড এমপি আনার হত্যা: ফেঁসে যাচ্ছেন একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা এমপি আনোয়ারুল খুনের নেপথ্যে ব্যবসা না রাজনীতি? এমপি আনোয়ারুল খুনের রোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন ডিবিপ্রধানমুমতারিন ফেরদৌস ডরিন: আমার বাবার দেখানো পথে চলেছি এতদিন। অষ্টম শ্রেণিতে থাকাকালীন ছাত্রলীগের মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ শুরু করি। জেলা ছাত্রলীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও আমার সরব উপস্থিতি ছিল। ছাত্রলীগ রাজনীতির আঁতুড়ঘর। সেজন্য আমি দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। কালীগঞ্জের প্রত্যেকটি ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা আমাকে চেনেন। রাজনীতি করবো। কারণ আমার বাবার স্বপ্ন ছিল রাজনীতি করার। এজন্য আমাকে আইন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে বলেছেন। আমার প্যাশন রাজনীতি করা এবং আমি ভবিষ্যতে রাজনীতি করবো। আল্লাহ যদি কপালে রাখেন, বাবার অসম্পূর্ণ কাজ বাস্তবায়ন করবো। বাবার আশা পূরণ করবো।
জাগো নিউজ: বাবা নেই, এই মুহূর্তে রাজনীতির মাঠ কতটা সহজ হবে?
মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন: যেহেতু বাবা নেই, রাজনীতি আমার জন্য কঠিন হবে বলে মনে করি। তবে মমতাময়ী মা প্রধানমন্ত্রী যদি আমার পাশে থাকেন, সহযোগিতা করেন তাহলে কোনো কিছুতেই অসুবিধা হবে না। কারণ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হালটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই ধরেছেন। আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি, তিনি (প্রধানমন্ত্রী) তার পুরো পরিবারকে হারিয়েছেন। সেক্ষেত্রে একটা মেয়ে হয়ে যদি মফস্বলে রাজনীতি করতে চাই অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী আমাকে সহযোগিতা করবেন। প্রমাণস্বরূপ ভবিষ্যতে হয়তো দেখতেও পারবেন আপনারা।
জাগো নিউজ: আপনার বাবার সঙ্গে কাদের বিরোধ ছিল?
মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন: রাজনীতি করতে গেলে অনেকের সঙ্গেই মনোমালিন্য থাকে। তবে কারও নাম ধরে আমি বলতে চাচ্ছি না। অনেকেই আছেন যারা সংসদ সদস্য হতে চান। রাজনৈতিক রেষারেষি সব জায়গায়ই থাকে। এর আগেও আট থেকে ১০ বার আমার বাবাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, আমার বাবার মতো এমন সাধারণভাবে চলাফেরা অন্য কোনো এমপি করেন না। সাধারণ মানুষের সঙ্গে খুব সহজেই তিনি মিশে যেতেন। মানুষের কিছু ভালো কাজ থাকতে হয়।
আমি অপহরণের মামলা করেছি। প্রমাণ পেলে হত্যা মামলা করবো। যদি সত্যিই আমার বাবা খুন হয়ে থাকেন তাহলে এর বিচারও আমি চাই।
জাগো নিউজ: মরদেহের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না পেলে কী করবেন?
মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন: প্রমাণ না পাওয়া গেলে হত্যা হয়েছে আমি মেনে নেবো না। আমি আইন পড়ি... আইনে কোন ধারায় কী মামলা করতে হয় তা আমি জানি। আমি অপহরণের মামলা করেছি। প্রমাণ পেলে হত্যা মামলা করবো। যদি সত্যিই আমার বাবা খুন হয়ে থাকেন তাহলে এর বিচারও আমি চাই।
জাগো নিউজ: আক্তারুজ্জামান শাহীনসহ জড়িত আসামিদের সঙ্গে আপনার বাবার বিরোধ কী নিয়ে ছিল?
মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন: গ্রেফতার আসামিদের সঙ্গে আমার বাবার ব্যবসার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ডিবি আমাকে জানিয়েছে, গ্রেফতাররা প্রফেশনাল কিলার। পাঁচ কোটি টাকার কন্ট্রাক্টে বাবাকে হত্যা করা হয় বলে তারা বলেছেন। কেন মারতে বলা হয়েছে তারা নাকি জানেন না। জাতীয় নির্বাচনের আগেও বাবাকে হত্যা করার চেষ্টা করে তারা, তবে পারেনি। তিনবার চেষ্টা করেছিল বাবাকে হত্যার জন্য। আগে থেকেই সবকিছু পরিকল্পনা করে বাবাকে হত্যা করা হয়। এটা রাজনৈতিক ইস্যু হতে পারে। কারণ নির্বাচনের আগে থেকেই মারার চেষ্টা হয়। অনেক শত্রুই তার আছে।
জাগো নিউজ: আপনার বাবার ব্যবসা-বাণিজ্য এখন সামলাতে পারবেন?
মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন: সামলাতে পারবো না কেন। আমি একজন শিক্ষিত মেয়ে। আমার বাবা জন্ম দিয়েছেন, শিক্ষিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরি করেছেন। আমাকেও সেভাবে তৈরি করতে হবে। সেদিক থেকে আমি নিজেকে অনেক সক্ষম বলে মনে করি। প্রধানমন্ত্রী একটি দেশ চালালে আমি সামান্য এটুকু (কালীগঞ্জ) পারবো না? রাজনীতি ও বাবার ব্যবসা এখন দেখভাল করবো।
জাগো নিউজ: আপনি ব্যক্তিগতভাবে জীবনের নিরাপত্তার ঝুঁকি অনুভব করছেন?
মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন: জীবনের নিরাপত্তার ঝুঁকি অনুভব করছি। কারণ আমি যেভাবে মিডিয়ার মুখোমুখি হচ্ছি অন্য কেউ তা হচ্ছে না। আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। আমি তার সন্তান। ঝুঁকি থাকলেও সবকিছু আমাকেই হ্যান্ডেল করতে হবে। সন্তান হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব। তবে যারা নিষ্ঠুরভাবে একজন মানুষকে হত্যা করতে পারে তাদের দ্বারা সবকিছুই সম্ভব।
জাগো নিউজ: বাবার সঙ্গে আপনার স্মৃতির বিষয়ে জানতে চাই।
মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন: আমার মায়ের চেয়েও বাবার সঙ্গে বেশি স্মৃতি। জোট সরকারের সময় ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাবা বাসায় থাকতে পারেননি। তখন অনেক মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। তবে মামলাগুলো পরবর্তীসময়ে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে এক বেলাও ভাত খেতে পারিনি। ছোটবেলায় দেখেছি, এমনও দিন গেছে বাবা একটু ভাত খেতে বসেছেন তখনই ভাত রেখে বের হয়ে যেতে হয়েছে। কারণ জীবনের ঝুঁকি ছিল। এরপর বাবা যখন উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তখন থেকে বাবাকে কাছে পাই।
একটা মানুষ জীবনে সংগ্রাম না করলে কাউন্সিলর থেকে সংসদ সদস্য হওয়া সম্ভব নয়। কারণ আমার পূর্বপুরুষ কেউই সংসদ সদস্য ছিলেন না। বাবা খুব কষ্ট করে এ পর্যন্ত এসেছিলেন। বাবার সঙ্গে স্মৃতিগুলো কখনো ভুলতে পারবো না।
জাগো নিউজ: ভবিষ্যৎ কালীগঞ্জকে আপনি কীভাবে দেখতে চান?
মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন: বাবার যে স্বপ্ন পূরণ হয়নি সেগুলো পূরণ করতে চাই। দৃঢ় বিশ্বাস আমাকে কেউ ফেলবে না। আমি রাজনীতি করতে চাই। আমাকে সবাই সহযোগিতা করবেন। আসামিদের সর্বোচ্চ বিচার চাই। সে দেশেই থাকুক, বিদেশে থাকুক আর পাতালে থাকুক আসামিদের সর্বোচ্চ বিচার চাই। আক্তারুজ্জামান শাহীনকে ধরে আনা হোক।
জাগো নিউজ: আপনার বাবার স্বর্ণ চোরাচালানের বিষয়ে কি বলবেন?
মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন: বাবার নিখোঁজের কথা বলে আমি ভুল করে ফেলেছি...! বাবাকে খুঁজে দেওয়ার জন্য আমি বললাম। আমার বাবাকে নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়া বিভিন্ন নিউজ করছে। একটি কথা আমি বলতে চাই- বাবা যদি এ ধরনের কাজ (পত্রিকায় যেসব সংবাদ প্রকাশ হয়েছে) করতো তাহলে এতদিন কেন তথ্য-প্রমাণ পাইনি? কালীগঞ্জের প্রত্যেকটি মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করে দেখেন তারা কেউ এমপি সাহেবের এ ধরনের কোনো খবর পেয়েছে কি না। গর্বের সঙ্গে বলতে পারি কখনো আমার বাবা খারাপ কিছুর সঙ্গে জড়িত ছিল না। জোট সরকারের সময় অনেকগুলো মামলা ছিল। সেই মামলার থ্রু দিয়ে অনেকেই নিউজ করছে। কিন্তু সেই মামলা সবগুলো মিথ্যা বলে প্রমাণিত।
জাগো নিউজ: হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড শাহীনকে চিনতেন কি না?
মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন: শাহীনকে ওভাবে চিনতাম না। শাহীনকে কেউ টাকা দিয়ে এ কাজ করিয়েছে কি না দেখা দরকার। তাকে হয়তো ১০ কোটি টাকা দিয়ে বলেছে তুমি পাঁচ কোটি রাখো আর পাঁচ কোটি টাকা দিয়ে মেরে ফেলো। শাহীন দ্বিতীয় ম্যান হিসেবে কাজ করলেও করতে পারে। কারণ জাতীয় নির্বাচনের আগেও বাবাকে মারার জন্য ঢাকায় চেষ্টা করা হয়েছে; তবে মেলাতে পারেনি। এই হত্যার সঙ্গে রাজনৈতিক ভূমিকা থাকতেও পারে। শাহীনকে আইনের আওতায় আনা গেলে সবকিছু পানির মতো বের হয়ে আসবে।
এছাড়া শাহীনের ভাই কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়রকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হোক। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক। শাহীনকে তার ভাই কেন শেল্টার দিয়েছে? আমার এখন অনেক কিছুই মনে হচ্ছে।
টিটি/এএসএ/জিকেএস