মতামত

সংকটের উপলব্ধি আছে সমাধান নেই

স্বীকার করছি, বাজেট ব্যাপারটা আমি একদমই বুঝি না। আরো অনেকের মত কোন জিনিসের দাম বাড়লো আর কোনটার কমলো; এটা মনোযোগ দিয়ে দেখি। আয়কর কাঠামোতে কোনও পরিবর্তন আসলো কিনা দেখি। তবে এটুকু বুঝি, একটা সংসারের যেমন সারা বছরের একটা পরিকল্পনা থাকে, আয়-ব্যয়ের একটা হিসাব থাকে, অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে, বেড়ানোর পরিকল্পনা থাকে, চিকিৎসার জন্য খরচ বরাদ্দ থাকে; দেশেরও তেমনি।

Advertisement

বাজেট মানে দেশের সারা বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব। এখানে সরকারের প্রায়োরিটি ঠিক করা থাকে। পরিবারের আয়-ব্যয়ের হিসাব করার সময়ও আমরা প্রায়োরিটি ঠিক করি। পারিবারিক হিসাবের সময় আমরা অনেক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা করি, যেমন বেড়ানোর পরিকল্পনা থাকে হয়তো মরিশাস, শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয় কক্সবাজার। তেমনি দেশের বাজেটেও অনেক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা থাকে, যা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয় না।

বাজেট প্রস্তাবনার সঙ্গে বাজেট বাস্তবায়নের অনেক ব্যবধান থাকে। সরকার যত দক্ষ, ব্যবধান তত কম। এখানেই মুন্সিয়ানা। বাজেট নিয়ে সাংবাদিকতার শিক্ষক সাখাওয়াত আলী খানের একটি গল্প আছে। সাখাওয়াত আলী খান একবার রিকশায় যেতে যেতে বাজেট নিয়ে কথা বলছিলেন। রিকশাচালক বললেন, এটুকু বুঝি বাজেট দিলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। তার কৌতূহল ছিল, যে জিনিস দিলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, সে জিনিস না দিলে কী হয়? তবে বিষয়টা অত সরল নয়। জিনিসপত্রের দাম বাড়ুক আর কমুক, আলোচনা-সমালোচনা যাই হোক; সরকারকে নির্ধারিত সময়ে বাজেট পেশ করতে হয়।

বর্তমান সরকারের আগের বাজেটগুলো অনেক উচ্চাভিলাষী ছিল। এবার সেটা নেই। এটা ভালো লক্ষণ। ঋণ করে ঘি খাওয়ার কোনো মানে হয় না। কিন্তু অর্থনীতিও একটা চক্রের মত। অর্থনীতি সঙ্কুচিত করলে প্রবৃদ্ধিও শ্লথ হয়ে যাবে। উৎপাদন কমবে, বিনিয়োগ কমবে, কর্মসংস্থানের পথ রুদ্ধ হবে। তাতেও সাধারণ মানুষই চাপে পড়বে। নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য সরকারের নানা সামাজিক নিরাপত্তার কর্মসূচি থাকে। কিন্তু লজ্জায় যাদের মুখ ফোটে না, সেই মধ্যবিত্তের হয় করুণ দশা। তারা না পারে লাইনে দাঁড়াতে, না পারে বাজারে যেতে।

Advertisement

একসময় বাজেট পেশ শেষ হওয়ার আগেই ‘এই বাজেট গণবিরোধী, এই বাজেট মানি না’ ব্যানার নিয়ে মিছিল বেরিয়ে যেতো। এখন আর ঢালাও প্রতিবাদের সেই সংস্কৃতি নেই, সেই সুযোগও নেই। রাজপথ থেকে প্রতিবাদ এখন ভার্চুয়াল জগতে চলে এসেছে। মূল প্রতিবাদটা হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। এরপর তার ঢেউ লাগে গণমাধ্যমে। যারা বাজেট বোঝেন, মানে অর্থনীতিবিদদের প্রতিক্রিয়া দেখে আমরা বাজেটের ভালোমন্দ বোঝার চেষ্টা করি। বিশেষ করে বাজেট প্রস্তাবনার পরদিন সিপিডির আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া আর অর্থমন্ত্রীর বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন নিয়ে কৌতূহল থাকে সবার।

দুইটা কারণে এবারের বাজেট প্রথম। টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের চতুর্থ মেয়াদের প্রথম বাজেট এটি। অর্থমন্ত্রী হিসেবে এ এইচ মাহমুদ আলীরও প্রথম বাজেট এটি। অর্থনীতির ছাত্র হলেও এ এইচ মাহমুদ আলী ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট। সাবেক এই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাঁধে সঙ্কটকালে অর্থনীতি সামাল দেয়ার দায়িত্ব পড়েছে। বাজেটে সঙ্কটের উপলব্ধি থাকলেও সমাধানের স্পষ্ট পথরেখা নেই, নেই কোনো সৃষ্টিশীল পরিকল্পনাও। গতানুগতিক বাজেটে খালি আকার ছোট রাখার চেষ্টা হয়েছে। আকার ছোট হলেও তা আগেরবারের চেয়ে বেশি। তবে বাজেটের আকার বাড়ার হার কমেছে। আগে যেখানে ১০ শতাংশ বা তার বেশি বাড়তো, এবার আকার বেড়েছে ৫ শতংশের মত।

অঙ্কের হিসাবে বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। তার মানে ঘাটতি থাকছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। দেশী-বিদেশী নানা উৎস থেকে ঋণ নিয়ে এই ঘাটতি পূরণের চেষ্টা হবে। বলছিলাম সংসারের সারাবছরের হিসাব-নিকাশের সাথে বাজেটের সাদৃশ্যের কথা। তবে একটা বৈসাদৃশ্যও আছে। সংসারে মানুষ আগে তার আয় হিসাব করে, তারপর সে অনুপাতে ব্যয়ের হিসাব করে। সামর্থ্য থাকলে ঋণ নেয়, আবার সঞ্চয়ের চেষ্টাও থাকে।

কিন্তু দেশের বাজেটে আগে ব্যয়ের হিসাব করা হয়। তারপর সে অনুপাতে আয়ের খাত বের করা হয়। ঋণ নেয়া ব্যক্তি বা রাষ্ট্র কারো জন্যই খারাপ নয়। গরীব মানুষ নেয় দান-অনুদান বা ভিক্ষা। সামর্থ্যবান মানুষই ঋণ নেয়, বলা ভালো নিতে পারে। সামর্থ্য না থাকলে কেউ আপনাকে ঋণ দেবে না। ব্যক্তির মত দেশের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সত্যি। সামর্থ্য না থাকলে কেউ আপনাকে ঋণ দেবে না, সামর্থ্যের অতিরিক্তও দেবে না। আইএমএফ যে বাংলাদেশকে ঋণ দিচ্ছে, তা কিন্তু দয়া করে দিচ্ছে না।

Advertisement

প্রত্যেকবার ঋণের কিস্তি দেয়ার আগে তাদের প্রতিনিধিদল এসে, দেখে, পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করে তবেই ঋণ ছাড় করে। তবে সামর্থ্য থাকলেও অতিরিক্ত ঋণ নেয়া ভালো নয়। চমৎকার গতিতে এগুতে থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমশ ঋণের ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে। ঋণ আর সুদ পরিশেোধেই বড় অঙ্ক ব্যয় করতে হয়। আয় বাড়ানোর নানা চেষ্টা আছে বটে, তবে আয় বাড়ানোর চেয়ে ব্যয় কমানো সহজ। কিন্তু সেই সহজ কাজটাই আমরা করি না বা করতে চাই না। ‘সরকারকা মাল দরিয়া মে ঢাল’ এই মনোভাব আমাদের মজ্জাগত। অর্থমন্ত্রী মুখে সংযমের কথা বলেন। আর আমরা চারপাশে দেখি অপচয়ের মহোৎসব। দুই পাশে কোনো রাস্তা নেই, মাঠের মাঝখানে একটি সেতু, এমন অংসখ্য সেতু বা কালভার্ট আছে বাংলাদেশে। স্রেফ ঠিকাদারের পকেট মোটা করা আর প্রকৌশলীদের কমিশনের জন্যই এইসব সেতু বা কালভার্ট বানানো হয়েছে; যা জনগণের কোনো কাজেই আসে না, আসবেও না।

পত্রিকায় দেখলাম, ফরিদপুরের কোনো একটা হাসপাতালে ১২ বছর আগে কেনা যন্ত্রপাতির প্যাকেটই খোলা হয়নি। এমন অসংখ্য ঘটনা আপনি খুঁজে পাবেন চারপাশে। পুকুর খনন শেখার মত অপ্রয়োজনীয় কাজে আমলাদের দল বেধে বিদেশ ভ্রমণের প্রবণতা কমলেও বন্ধ হয়নি। অর্থনীতির যে সঙ্কট, তা অর্থমন্ত্রীর কথায় কাটবে না। প্রতিটি পদক্ষেপে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। প্রত্যেকটা পয়সা হিসাব করে খরচ করতে হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

অর্থমন্ত্রী যখন সংসদে বাজেট পেশ করছেন, তখনই খবর আসে, খেলাপী ঋণ আরো বেড়েছে। তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ৩৬ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা বেড়ে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। খেলাপী ঋণ নিয়ে এত এত আলোচনার মধ্যেও তিন মাসে খেলাপী ঋণ কী করে ৩৬ হাজার কোটি টাকা বাড়লো? এই প্রশ্নের জবাব কে দেবেন। আপনার কলসি যত চমৎকারই হোক, তলায় ছিদ্র থাকলে তার কোনো মূল্য নেই। যত বড় বড় কথাই বলেন, খেলাপী ঋণের সংস্কৃতি, টাকা পাচারের সংস্কৃতি বন্ধ করতে না পারলে; কোনো সমস্যারই সমাধান হবে না।

বাংলাদেশের এখন মূল সমস্যা মূল্যস্ফীতি, যা সাধারণ মানুষের জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে। গত বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার আকাঙ্খার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তা বাড়তে বাড়তে এখন প্রায় ১০ শতাংশ। টানা উর্ধ্ব মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের গলায় ফাঁস হয়ে গেছে। সরকারও এটা জানে। নির্বাচনী ইশতেহারে যেমন, বাজেটেও মূল্যস্ফীতি নিয়ে উদ্বেগের কথা আছে। কমানোর আকাঙ্খা আছে। বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আগামী ছয় মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু কীভাবে কমবে, তার কোনো পথনকশা নেই।

বরং সরকারের নানা পদক্ষেপে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ আরো বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আয় বাড়ানোর চেষ্টা হিসেবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ- দুই ক্ষেত্রেই করের চাপ আরো বাড়বে। আইএমএফ’এর শর্ত মানতে সরকার করছাড় কমিয়ে আনার পদক্ষেপ নিয়েছে। শূন্য শুল্কের অনেক পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। টেলিফোনে কথা বলার খরচ বাড়বে, মেট্রোরেলের ভাড়াও বাড়বে। সব মিলে সাধারণ মানুষের জন্য বাজেটে কোনো সুখবর নেই। করের আওতা না বাড়িয়ে হার বাড়িয়ে আয় বাড়ানো চেষ্টাও শেষ পর্যন্ত মধ্যবিত্তকেই চাপে ফেলবে।

বর্তমান সরকারের আগের বাজেটগুলো অনেক উচ্চাভিলাষী ছিল। এবার সেটা নেই। এটা ভালো লক্ষণ। ঋণ করে ঘি খাওয়ার কোনো মানে হয় না। কিন্তু অর্থনীতিও একটা চক্রের মত। অর্থনীতি সঙ্কুচিত করলে প্রবৃদ্ধিও শ্লথ হয়ে যাবে। উৎপাদন কমবে, বিনিয়োগ কমবে, কর্মসংস্থানের পথ রুদ্ধ হবে। তাতেও সাধারণ মানুষই চাপে পড়বে। নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য সরকারের নানা সামাজিক নিরাপত্তার কর্মসূচি থাকে। কিন্তু লজ্জায় যাদের মুখ ফোটে না, সেই মধ্যবিত্তের হয় করুণ দশা। তারা না পারে লাইনে দাঁড়াতে, না পারে বাজারে যেতে।

বাজেটের মোটা মোটা দলিলপত্র দেখলেই ভয় লাগে। অত বুঝি না, বুঝতে চাইও না। আমরা চাই শুধু অপচয় বন্ধ হোক, খেলাপী ঋণ বন্ধ হোক, টাকা পাচার বন্ধ হোব। আর মূল্যস্ফীতি কমে আসুক। আমরা যাতে খেয়েপড়ে বাঁচতে পারি।

৯ জুন, ২০২৪

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/এএসএম