২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষিখাতের বরাদ্দ বেড়েছে। তবে সুখবর নেই কৃষিক্ষেত্রের কারিগর কৃষকের জন্য। কমানো হয়েছে ভর্তুকি। নেই ক্রমবর্ধমান সার, সেচ ও কৃষি উপকরণের দাম কমানোর কোনো উদ্যোগ। কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায়ও নেই কোনো বরাদ্দ। কৃষিপণ্য রপ্তানি ও প্রক্রিয়াজাত খাতের জন্যও তেমন কোনো সুবিধা রাখা হয়নি।
Advertisement
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারও কৃষিখাতের বাজেট গতানুগতিক। কৃষক ও কৃষিখাতের স্বার্থ রক্ষায় নতুন কিছু নেই।
প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং খাদ্যনিরাপত্তা খাতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩৮ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছর (২০২৩-২৪) এ বরাদ্দ ছিল ৩৫ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষিখাতে ১৭ হাজার ২৬১ কোটি টাকার ভর্তুকি ও প্রণোদনা প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মোট ভর্তুকি ও প্রণোদনার ৭ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ভর্তুকির চেয়ে যা অনেক কম। চলতি অর্থবছরে প্রস্তাব করা হয়েছিল ১৭ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা, যা পরে বাড়িয়ে ২৫ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করেছিল সরকার।
Advertisement
বাজেটে বরাদ্দ বাড়লেও সেটি খুব অপ্রতুল। আবার শস্যখাতের ভর্তুকি কমানো হয়েছে। এটি অনাকাঙ্ক্ষিত। এতে উৎপাদন খরচ বাড়বে। খাদ্যনিরাপত্তা ব্যাহত হবে। কৃষির ভর্তুকি কমানো একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।- কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম
কৃষি অর্থনীতিবিদ ও ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজের সাবেক উপাচার্য ড. জাহাঙ্গীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাজেটে বরাদ্দ বাড়লেও সেটি খুব অপ্রতুল। আবার শস্যখাতের ভর্তুকি কমানো হয়েছে। এটি অনাকাঙ্ক্ষিত। এতে উৎপাদন খরচ বাড়বে। কৃষি উৎপাদন বিঘ্নিত হবে। খাদ্যনিরাপত্তা ব্যাহত হবে। কৃষির ভর্তুকি কমানো একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।’
আরও পড়ুন
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দুর্নীতিবিরোধী নীতির সঙ্গে ‘সাংঘর্ষিক’ প্রস্তাবিত বাজেটে সন্তুষ্ট নয় ১৪ দল! করজালে আটকিয়ে সুখী-সমৃদ্ধ-স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকারতিনি বলেন, ‘বাজেট খুব গতানুগতিক। রপ্তানি বাড়ানো ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত নিয়ে কোনো প্রতিফলন নেই। বিশেষ করে রপ্তানির ক্ষেত্রে আরও কীভাবে আমরা এগিয়ে যাবো সেটা থাকা দরকার ছিল। প্রক্রিয়াজাত পণ্য আরও কীভাবে বহুমুখীকরণ করা হবে, এসব সহজীকরণ কীভাবে হবে- কোনো নির্দেশনা নেই। জলবায়ু নিয়ে কৃষি অনেক সমস্যায় রয়েছে। তারও কোনো খবর নেই। কৃষি গবেষণায় বরাদ্দ দেওয়া হয় শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। এটি ন্যূনতম এক শতাংশ হওয়া উচিত।’
Advertisement
কৃষি অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘কৃষিতে ভর্তুকি কমেছে। এখন কোন খাতে এ বরাদ্দ দেবে। সার-সেচ সবকিছুর খরচ বেড়েছে। যেগুলো নিয়ে কৃষকরা হিমশিম খাচ্ছে। তারা কি সুফল পাবে?’
‘খাদ্যনিরাপত্তার জন্যও বড় বরাদ্দ দরকার ছিল। যেহেতু ভর্তুকি কমেছে সবখানে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এটা সমন্বয় করা বড় চ্যালেঞ্জ।’
এম আসাদুজ্জামান আরও বলেন, ‘কোটি কোটি মানুষের এখন পেঁয়াজ-রসুনসহ নানা কৃষিপণ্য কিনতে দম ছুটে যাচ্ছে। তাদের কী হবে? যেসব কৃষিপণ্য আমদানি হচ্ছে, সেখানে কীভাবে সুবিধা দেবে? দাম কমে মানুষ কীভাবে পাবে, নাকি বর্তমান দাম স্থিতিশীল রাখতে হবে- সবকিছু অস্পষ্ট।’
কৃষিতে ভর্তুকি কমেছে। এখন কোন খাতে এ বরাদ্দ দেবে। সার-সেচ সবকিছুর খরচ বেড়েছে। যেগুলো নিয়ে কৃষকরা হিমশিম খাচ্ছে। তারা কি সুফল পাবে?- বিআইডিএসের সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামান
বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণার (উবিনীগ) নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার বলেন, ‘কৃষকদের উৎপাদন ও ফসল বিক্রির সমস্যা। তারা ন্যায্যমূল্য পায় না। ফসল সংরক্ষণও করতে পারে না টাকার অভাবে। সাধারণ মানুষ প্রচণ্ড চড়া দামে সেসব কৃষিপণ্য কিনছে। বাজেটে এসব প্রতিরোধে জন্য কোনো উদ্যোগ নেই।’
সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন কৃষিখাত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে নিচ্ছে। তবে এ সেক্টরের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। অ্যাগ্রো প্রসেসিংয়ের বিষয়টি অনেক সময় শিল্পমন্ত্রণালয়, কখনো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চলে যায়। কৃষিতে কোনো বাজেট আসে না। দেশের পোস্ট হারভেস্ট ম্যানেজমেন্ট লস কমানোর জন্য ভ্যালু চেইনে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। সেই জায়গায় বেসরকারিখাতকে বিনিয়োগে উৎসাহী করতে কোনো পদক্ষেপ নেই। তাদের ক্রেডিট সাপোর্ট, ক্যাশ সাপোর্ট বা প্রণোদনা দিয়ে সহায়তার অঙ্গীকার থাকা দরকার ছিল।’
তিনি বলেন, ‘এখন উৎপাদনের পাশাপাশি কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণে যত্নশীল হওয়া দরকার। কারণ উৎপাদনকারী দাম পাওয়ার জন্য সেটা জরুরি। দাম পেলে উৎপাদন এমনি বাড়বে। এছাড়া রপ্তানিকারকদের সুবিধা দিতে হবে।’
দেশের অর্থনীতি সম্প্রসারণ ধারায় রয়েছে প্রধানত দুটি সূচকের উন্নয়নে। একটি কৃষি এবং অপরটি ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদনখাত। পারচেজিং ম্যানেজারস ইনডেক্সের (পিএমআই) সবশেষ তথ্য বলছে এমনটি। অথচ সেই কৃষিখাতে ক্রমেই কমছে বাজেটের হিস্যা।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষিখাতের বরাদ্দ ৫ দশমিক ৯ শতাংশ, যা দেশের অর্থনীতিতে এ খাতের প্রত্যক্ষ অবদানের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। গত একযুগে কৃষিখাতে বাজেটে বরাদ্দ নেমেছে অর্ধেকে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে কৃষিখাতের হিস্যা ছিল ১১ শতাংশের ঘরে।
এনএইচ/এএসএ/এমএস