নেত্রকোনা সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়নের ভাসাপাড়া গ্রামে একটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। ঢাকা থেকে আসা বোম ডিসপোজাল ইউনিট ও সোয়াত টিম রোববার (৯ জুন) সকাল সাতটায় স্থানীয় পুলিশকে নিয়ে এ অভিযান পরিচালনা করে।
Advertisement
এরআগে নেত্রকোনা মডেল থানা পুলিশ প্রথম দফায় শনিবার (৮ জুন) দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই নির্জন বাড়িটিতে অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় বাড়িটির নিচ তলার একটি কক্ষে একটি বিদেশি পিস্তল, ১৭ রাউন্ড গুলি, একে-ফোরটি সেভেন আদলের কয়েকটি খেলনা অস্ত্র, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট, দুটি ওয়াকিটকি, একটি হ্যান্ডকাপ, জিহাদি বই, প্রচুর পরিমাণ কোমরে বাঁধার বেল্ট ও ব্যায়ামের যন্ত্রপাতি জব্দ করা হয়। তবে অভিযানের আগেই জঙ্গিরা পালিয়ে যায় এমন দাবি পুলিশের।
পুলিশের ধারণা, এটি জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। বাড়িটিতে আরও বিস্ফোরক দ্রব্য থাকতে পারে। সেজন্য বোম ডিসপোজাল ইউনিট ও সোয়াত টিমকে খবর দেওয়া হয়। শনিবার বিকেল থেকে বাড়িটির চারপাশ পুলিশ সদস্য দিয়ে ঘেরাও করে রাখা হয়।
জানা গেছে, নেত্রকোনা সদর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণ দিকে বালি বাজারের কাছে এ দোতলা বাড়িটির অবস্থান। এটির মালিক ডুয়েটের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আব্দুল মান্নান। তিনি প্রায় ২০ বছর আগে এটি নির্মাণ করেন। প্রায় আড়াই একর জমির ওপর নির্মিত বাড়িটিতে একটি দোতলা বিল্ডিং, একটি টিনশেড হাফবিল্ডিং ছাড়াও তিনটি পুকুর, মুরগির খামার এবং গরুর খামার রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে নারকেল ও আমসহ নানান রকমের ফলদ গাছ। সিসি ক্যামেরা ও ইন্টারনেট সংযোগ সংযুক্ত বাড়িটির চারপাশ উঁচু দেওয়ালে ঘেরা। গ্রামবাসীর কাছে বাড়িটি আগে থেকেই রহস্যে ঘেরা ছিল।
Advertisement
ওই গ্রামের বাসিন্দারা জানান, বাড়িটি করার সময় আব্দুল মান্নান সেখানে গার্লস ক্যাডেট কলেজ করা হবে বলে তাদের জানিয়েছিলেন। কলেজের একটি সাইনবোর্ডও লাগিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ২০ বছরে তারা কলেজের কোনো কার্যক্রম শুরু করতে দেখেননি। তবে অদূরেই বনোয়াপাড়া এলাকায় তার একটি প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ রয়েছে।
বছর দুয়েক ধরে রহস্যে ঘেরা এ বাড়িটিতে ভাড়াটিয়া পরিচয়ে দুজন পুরুষ, দুজন নারী ও কয়েকটি শিশু বাচ্চা অবস্থান করছিল। তাদের সঙ্গে গ্রামের বাসিন্দাদের কোনো ধরনের যোগাযোগ ছিল না। বাড়িটির গেট সবসময় লাগানো থাকতো বলে জানান এলাকাবাসী।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা এ বাড়িতে কয়েকজন ভাড়াটিয়া থাকেন বলে জানতাম। কিন্তু তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো পরিচয়-সম্পর্ক ছিল না। আব্দুল মান্নান সাহেব বাড়িটি করার সময় এখানে কলেজ করবেন বলে জানিয়েছিলেন। দুই বছর আগে জানতে পারি, তিনি এটি ভাড়া দিয়েছেন।
একই এলাকার চান মিয়া বলেন, আমারা দেখেছি, বাড়িটিতে দুজন পুরুষ লোক থাকতেন। তাদের বয়স ২৫ থেকে ৩০ এর মধ্যে। এছাড়া দুজন নারী থাকলেও কখনো তাদের দেখিনি। ওই পুরুষ লোকগুলো বলতেন, দুজন নারীই পর্দানশীন। তবে তাদের চার-পাঁচটি বাচ্চা ছিল। এছাড়াও বাড়িটিতে একটি জিপ গাড়ি দিয়ে প্রায় সময়ই দু-একজন লোক আসা যাওয়া করতেন।
Advertisement
প্রথম দফা অভিযানের পর তাৎক্ষণিক ব্রিফিংয়ে জেলা পুলিশ সুপার ফয়েজ আহমেদ বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এখানে অভিযান পরিচালনা করেছি। এছাড়াও আরও দুটি জায়গায় অভিযান চালিয়েছি। তবে ওই দুটি স্থানে জঙ্গি আস্তানার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। এখানে অভিযান পরিচালনা করে নিশ্চিত হয়েছি যে, এই বাড়িটিতে জঙ্গিদের অবস্থান ছিল।
তিনি বলেন, অভিযানে পাওয়া আলামতের ভিত্তিতে প্রাথমিকভাবে আমাদের কাছে মনে হয়েছে যে, এ বাড়িটিকে জঙ্গিরা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করছিল। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় আমরা আর তল্লাশি করিনি। বোম ডিসপোজাল ইউনিটসহ সোয়াত দলকে খবর দেওয়া হয়েছে। তারা এসে বাদবাকি তল্লাশি পরিচালনা করবে। বাড়ির মালিককেও আসতে খবর পাঠানো হয়েছে। এখানে যারা অবস্থান করছিল- তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।
এদিকে অতিরিক্ত ডিআইজি আসাদুল্লাহ চৌধুরীর নেতৃত্বে ময়মনসিংহের এন্টি টেররিজম ইউনিটের একটি দলও এসে বাড়িটি পরিদর্শন এবং তল্লাশি করে। এছাড়া ডিবি পুলিশের সদস্যরাও অভিযানে যোগ দেয়।
একটি বিশেষ সূত্রে জানা গেছে, এর আগে গত ৫ জুন নরসিংদীর রায়পুরা থানার মাহমুদাবাদ টানপাড়া এলাকায় পুলিশি অভিযানে একটি একনলা ২২ একে রাইফেল, ২টি লোহার খালি ম্যাগাজিন ও ১৬ রাউন্ড গুলিসহ হামিম হোসেন ফাহিম ওরফে আরিফ (৩২) নামে এক যুবককে আটক হয়। ওই যুবকের বাড়ি পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার উত্তর বালিহাড়ি (মাঝিবাড়ি) গ্রামে। তার বাবার নাম সেলিম মিয়া। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে ওই যুবক তার বর্তমান ঠিকানা হিসেবে ভাসাপাড়া গ্রামের আব্দুল মান্নানের ওই বাড়িটির কথা উল্লেখ করেন। ধারণা করা হচ্ছে, ওই সূত্র ধরেই পুলিশ এ জঙ্গি আস্তানাটি আবিষ্কার করে।
তবে জেলা পুলিশ সুপার ফয়েজ আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছেন, নরসিংদীতে আটক হওয়া যুবকের সঙ্গে এ বাড়ির কোনো কানেকশন আছে কি না তা আমরা খতিয়ে দেখছি।
এদিকে শনিবার রাত দশটার দিকে জেলা শহরের বনুয়াপাড়ায় তানভির কটেজ নামে বাড়িটিতে জঙ্গি সদস্য আছে সন্দেহে ঘেরাও করে রাখে পুলিশ।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফয়েজ আহমেদ জানিয়েছেন, জেলা শহরের বনুয়াপাড়া এলাকায় শমসের নগর তানভির কটেজ নামে বাড়িটির মালিক আব্দুল খালেক। তার বাড়িতে জঙ্গি সদস্য রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য পাওয়া গেছে। এ কারণে বাড়িটি ঘেরাও করে রাখা হয়। সকাল সাড়ে আটটায় ঢাকা থেকে আসা বোম ডিস্পোজাল টিম তল্লাশি চালায়। অভিযানের নেতৃত্ব দেন এটিইউ এর পুলিশ সুপার সানোয়ার হোসেন ও জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফয়েজ আহমেদ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহেদ আহমেদ। অভিযানে কাউকে আটক করা যায়নি। আজ সন্ধ্যায় এ ঘটনায় প্রেসব্রিফিং করবে জেলা পুলিশ।
এইচ এম কামাল/এফএ/এমএস