দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে, এমন সন্দেহ শুরু থেকেই ছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় আসার আগে এমন অনেক প্রতিশ্রুতিই দেয়, কিন্তু ক্ষমতালাভের পর বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয় কিংবা প্রতিশ্রুতির কথা বেমালুম ভুলে যায়।
Advertisement
এবারও প্রতিশ্রুতি শুনে মানুষ ভিন্নতর কিছু ভেবেছে এমনটা মনে করার কারণ নেই। তবে প্রতিশ্রুতি দানকারী এবং প্রতিশ্রুতিপ্রাপ্ত এই দুই শ্রেণির মধ্যে এক জায়গায় ঐকমত্য আছে- তা হচ্ছে, দুর্নীতি নির্মূল সম্ভব নয়। সহনীয় পর্যায়ে আনাটাই উভয়পক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এই দুর্নীতির ধারাবাহিকতা এতই শক্ষিশালী ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত যে, প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহটা থেকেই যায়। সমালোচনা হয়েছে, আইওয়াশ কিংবা লোক দেখানো এমন বিশেষণ যুক্ত করে।
দুর্নীতির প্রসঙ্গ এলে বরাবরই আলোচনা হতো রাঘবদের কথা। রাঘবরা নিরাপদ থাকে, তাদের ধরা হয় না কিংবা তাদের ধরার সাহস রাখে না- সরকার, ইত্যকার নানা মুখরোচক কথা তো ছিলই। বিরোধী দলগুলো ক্ষমতার বাইরে থেকে নিত্য দুর্নীতির অভিযোগ আনে, এটাও সেই রুটিন ওয়ার্ক যেন। মোট কথা সবই চলে সমান্তরালে।
এরমধ্যে পুলিশের সাবেক আইজি, জাদরেল অফিসার বেনজীর আহমেদ দৃশ্যপটে এসেছেন দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে। গণমাধ্যমগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়েছে দুর্নীতির খোঁজ নিতে। একের পর এক বেরিয়ে আসছে অবাক করা দুর্নীতির তথ্য। কী বলছে এসব, এমনতর প্রশ্নই শোনা যায় এর সূত্র ধরে। বেনজীরকে অভিযুক্ত করার পর অন্তত এটুকু বলা যায়-রাঘবরাও ধরা খায়।
Advertisement
প্রশ্ন এসেছে শুধু বেনজীরই কি নজির স্থাপনকারী দুর্নীতিবাজ? আশার কথা, জবাব পাওয়া যাচ্ছে দুদকের কর্মকাণ্ড দেখে। সংবাদ হয়েছে, দুদকের জালের আওতায় ইতোমধ্যে অর্ধশতাধিক পুলিশ সদস্য এসে গেছেন। যাদের অবস্থান কনস্টেবল থেকে শুরু করে ডিআইজি পর্যন্ত। আছে বর্তমান ও সাবেকও। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী দুদকের অনুসন্ধানের তালিকায় এখনও সাবেক ও বর্তমান অতিরিক্ত আইজিপি ছাড়াও ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি, এসপি, অ্যাডিশনাল এসপি, এএসপি, ইন্সপেক্টর, সাব-ইন্সপেক্টর, সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর, কনস্টেবলসহ প্রায় সব পদের পুলিশ সদস্য রয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন, ঘুস বাণিজ্য, সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয়, আইন অমান্য করাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।
পুলিশ বাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়া ডিআইজি মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে হওয়া মামলায় দেশের আদালত তাকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেন। অভিযোগ ছিল তিনি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ৩ কোটি ২৮ লাখ টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন। ডিআইজি মিজানুর রহমানকে ২০২৩ সালের ২১ জুন ১৪ বছরের সাজা দেন নিম্ন আদালত। ডিআইজি মিজানের আপিলের পর সেই সাজা বহাল রেখে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি (২০২৪) আদেশ দেন উচ্চ আদালত। বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার হাইকোর্ট বেঞ্চ বিচারিক আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করা মিজানুর রহমানের আপিল খারিজ করে দেন। (সূত্র বাংলা ট্রিবিউন,২ জুন ২০২৪)
পুলিশ বাহিনীর ২ লাখ ১২ হাজার সদস্যের মধ্যে অর্ধশতাধিক এই সংখ্যাটা খুবই সামান্য মনে হতে পারে। তবে ২ লাখ ১২ হাজার পুলিশের শতভাগই যে বেনজীর আহমেদ নয় তাও স্বীকার করতে হবে। এটাও বলতে হবে, দুই লক্ষাধিক পুলিশের মধ্যে ৫/১০ হাজার দুর্নীতিগ্রস্ত এটাও সাধারণ ধারণা। তবে এই পদক্ষেপ এর পর সন্তোষ প্রকাশ করা যায়- রাঘবদেরও ধরা হচ্ছে।
দুর্নীতি কি শুধু পুলিশেই ঘাপটি মেরে বসে আছে? তাইলে দুর্নীতিবাজদের হাতে হাতকড়া লাগায় কে? পুলিশের সবাই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নন। অনেকেই যুক্ত এটাও প্রচারিত। বছর দুই আগে প্রকাশিত একটি সংবাদে দেখা যায় বাংলাদেশে সর্বাধিক দুর্নীতি হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানে। মনে করা যেতে পারে, সরকার হয়তো সর্বাধিক দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানটির মধ্য দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। যে সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বাধিক দুর্নীতির প্রতিষ্ঠান বলে অভিহিত করা হয়েছিলো তখনই দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান লাভকারী হিসেবে দেখানো হয়েছিল পাসপোর্ট ও বিআরটিকে।
Advertisement
একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সূত্র অনুযায়ী বিচারিক সেবা খাতে দুর্নীতির হিস্যা ছিল ৫৬.৮%, স্বাস্থ্য খাতে ৪৮.৭%, স্থানীয় সরকার-এ ৪৬.৬ এবং ভূমি সেবায় ৪৬.৩%। সুতরাং এটা বলার সুযোগ নেই যে শুধু পুলিশ বাহিনীতেই দুর্নীতিবাজরা ঢুকে পড়েছে।
এসব প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি এবং তাদের এই দুর্নীতির কারণে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের চিত্র প্রায়ই সংবাদে আসে। সেগুলো দেখার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান দুদক। এই দুদকও শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত নয় এমন সংবাদও আমাদের চোখে পড়ে। সরিষাক্ষেতে ভূত মনে হলেও এই প্রতিষ্ঠানটি এখনও ১০/২০তম স্থানে পৌঁছায়নি। তাই এখনও মানুষ ভরসা করতে চায়, দুর্নীতির গলা টিপে ধরতে পারে এই প্রতিষ্ঠানটি।
এই দুদককে নখদন্তহীন বাঘ আখ্যায়িত করতে দেখা গেছে, একসময়কার কমিশন চেয়ারম্যানকে। এই বাঘের দাঁত গজানোর ব্যবস্থা কি ওইভাবে করা হচ্ছে? তাদের সক্ষমতা এবং প্রতিবন্ধকতাগুলো কি? তাদের কাজের মূল্যায়নও বা কি? যত বড় প্রতিষ্ঠানই হোক না কেন, এ সম্পর্কে দেশের নাগরিকদের জানার অধিকার আছে। দুদকের শক্তিমত্তা নিয়ে আলোচনার প্রথমেই আসবে রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয়টি। যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা কার্যকর হয়, তাহলে এই দুদকই ধীরে ধীরে প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের জাল ছড়িয়ে দিতে পারে। সেখানে হয়তো বেনজীর, ক্যাসিনো সম্রাট জাতীয় রাঘবরা সবসময় ধরা পড়বে না। তবে বড় মাঝারি কিংবা ছোটরা যদি নিয়মিত ধরা খেতে থাকে, তাহলে এর প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে পড়তে পারে।
হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে, এটা কীভাবে সম্ভব? হুন্ডিকে আয়ত্বে আনার সুযোগ কম এমন বলা হয়। কিন্তু তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকবে এটাও কি বিশ্বাস করতে হবে? এই যে বেগমপাড়ার কথা বলা হচ্ছে, তাদের নাড়ি-নক্ষত্র বের করে প্রকাশ করা কি অসম্ভব? এমন প্রশ্ন শতেক হয়ে যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই রোগমুক্তির উপায়টা কি? বিশ্লেষকদের প্রায় সবার কাছ থেকে প্রথম যে পরামর্শটি আসে, তা হচ্ছে প্রশাসনে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দুদককে শক্তিশালী ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা। সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে ব্যক্তির সততা। এজন্য শাস্তি এবং পুরস্কার নিশ্চিত করা যেতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।
এইচআর/ফারুক/এমএস